ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে সিংহের মৃত্যুর আশঙ্কা

fec-image

কক্সবাজারের চকরিয়ায় ডুলাহাজারাস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে বার্ধক্য জনিত অসুস্থতার কারণে সম্প্রতি সময়ে সোহেল নামে একটি বয়স্ক সিংহ (পুরুষ) মৃত্যু হয়েছে। পার্কের রেকর্ডমতে সিংহটির বয়স হয়েছিল প্রায় ২২ বছর। সিংহ সোহেল মারা যাওয়ার পরে বর্তমানে পার্কে আরো ৪টি সিংহ রয়েছে। তারা হলো, রাসেল (১৩), টুম্পা (১০), সম্রাট (১০) ও নদী (১১)। সাফারি পার্কের সিংহ বেষ্টনীতে তাদের বসবাস। ‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলিয়া দেয় ‘ চিরন্তন এই উক্তির এবার প্রতিফলন ঘটেছে সাফারি পার্কের বেষ্টনীতে যুগল সঙ্গী সিংহ সম্রাট ও নদীর জীবনে। এছাড়াও এ সঙ্গী জীবনে অভিসারে দুইজনের মধুর সময় কাটছিল। হঠাৎ তাদের একে অপরকে মনোমালিন্যে ক্ষিপ্ত আক্রমণ করে তারা। এতে স্ত্রী সঙ্গিনী নদীর আঘাতেও আহত হয় সম্রাট। আর সম্রাটের পাল্টা আঘাতে সঙ্গী নদীও গুরুতর আহত হয়ে এখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। যে কোন মুহূর্তে নিঁভে যেতে পারে সিংহ নদীর জীবন প্রদীপ!

জানাগেছে, গত ২ ফেব্রুয়ারি সম্রাট ও নদী দম্পতির মধ্যে কলহ শুরু হয়। পার্কের নির্দিষ্ট বেষ্টনিতে থাকাবস্থায় ওইদিন তারা কামড়া কামড়িতে লিপ্ত হলে উভয়েই আঘাতপ্রাপ্ত হয়। পরে পার্কের বন্যপ্রাণি হাসপাতালে তাদের আলাদা করে রেখে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হলে সুস্থ হয়ে উঠে পুরুষ সিংহ সম্রাট ও নদী (স্ত্রী) সিংহটি। এই দম্পতি বেষ্টনিতে সঙ্গ নিরোধকালে আবারও ১৭ দিনের মাথায় প্রচন্ড মারামারিতে লিপ্ত হয়। এতে স্ত্রী সিংহ নদীর গলার নিচে গভীর জখম হয়। তা থেকে অনবরত ঝরতে থাকে পানি। পার্কের চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসার পর সম্রাট পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলেও বর্তমানে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে (স্ত্রী) নদী।

পার্ক কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্কের সিংহ বেষ্টনীতে সম্রাট ও নদীর মিলনের সময় হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ওইসময় একে অপরকে কামড়ে আহত করে। দুইজনের আঘাত এতটাই গুরুতর যে, পার্ক কর্তৃপক্ষকে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। পার্ক কর্তৃপক্ষ ঘটনার বিষয়টি লিখিতভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে। গত ২২ ও ২৭ ফেব্রুয়ারি দফায় দফায় চিকিৎসাসেবা দেওয়া হলেও উন্নতি ঘটেনি নদীর। ক্ষতস্থান থেকে পানি ঝরা বন্ধ না হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রামের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী আহত সিংহ নদীর চিকিৎসায় পাঁচ সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করেন। উক্ত কমিটিতে ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মেডিসিন ও সার্জারি বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডা. বিবেক চন্দ্র সূত্রধরকে প্রধান করা হয়। এছাড়াও কমিটিতে সদস্য রয়েছেন উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সুপন নন্দী, ভেটেরিনারি সার্জন হাতেম সাজ্জাদ জুলকারনাইনসহ পাঁচজন।

চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের মেডিসিন ও সার্জারি বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডা. বিবেক চন্দ্র সূত্রধরসহ বলেছেন, সিংহীর অবস্থা ভালো নয়। মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে দফায় দফায় চিকিৎসাসেবা প্রদানের পরও দিন দিন খাবার গ্রহণ একেবারেই কমিয়ে দেয় নদী। অনবরত মুখ থেকে লালা বের হতে থাকে তার। এত দিন একটু একটু খাবার গ্রহণ করলেও গত ২৭ মার্চ থেকে খাবার খাওয়া বন্ধ করে দেয়। তখন থেকেই সিংহীটি জিহ্বা বের করে রাখে এবং মুখ থেকে লালা ঝরার পরিমাণ মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো দুজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারসহ মেডিকেল বোর্ডের অন্য সদস্যরাও ব্যাপক চিকিৎসা কার্যক্রম চালু রাখলেও অবস্থার কোনো উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। দিন দিন আরো বেশি দুর্বল হয়ে পড়ছে সিংহী নদী।

চকরিয়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সুপন নন্দীর কাছে জানতে চাইলে বলেন, যেকোনো মুহূর্তে নিভে যেতে পারে (স্ত্রী) নদীর জীবন প্রদীপ। বর্তমান নদীর বয়স ১১ বছর। তার আঘাতের অবস্থা খুবই গুরুতর। সারাক্ষণ জিহ্বা বের করে রাখছে এবং লালা ঝরার পরিমাণ বেড়েই চলছে। সিংহ নদীর লালা ঝরার কারণে সে ঠিকভাবে খেতেও পারছে না। বলতে গেলে খাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে সে। ফলে দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। এটি শুভ লক্ষণ নয়। যেকোনো সময় তার মৃত্যু হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।

ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাফারি পার্কের তত্ত্বাবধায়ক (রেঞ্জ কর্মকর্তা) মো. মাজহারুল ইসলাম জানান, মেডিকেল বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী অসুস্থ সিংহ (স্ত্রী) নদীকে পার্কের বন্যপ্রাণী হাসপাতালের কোয়ারেন্টিন শেডে আলাদা করে রেখে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। নদীর উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ২৮ মার্চ সিরাম ও রক্তের নমুনা পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো হয়। গত ১২ এপ্রিল ল্যাবের পরীক্ষার ফলাফল এবং মেডিকেল বোর্ডের মতে নদীর শরীরে ভাইরাল ইনফেকশন হয়। যা ফিলাইন ইমুনোডিফিসিইনসি ভাইরাস বা ফিলাইন লিকোমিয়া ভাইরাস হিসেবে শনাক্ত হয়। তাই ধরা পড়া ভাইরাসের ব্যাপারে আরো বেশি নিশ্চিত হতে ফের পরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ল্যাবের ফলাফল এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের আশঙ্কা, যেকোনো মুহূর্তে নদী মারা যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। নদীর চিকিৎসা প্রদানসহ সিরাম ও রক্তের নমুনা সংগ্রহ করার জন্য এর আগেও দুবার নদীকে অবচেতন করা হয়। গত ১ এপ্রিল নদীকে অবচেতন করার পর তার চেতনা ফিরতে প্রায় ৫ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। বর্তমানে নদীর অবস্থার আরো অবনতি ঘটেছে। ২৭ মার্চ থেকে সে পানি ছাড়া অন্য কোনো খাবারও গ্রহণ করেনি। তাই নতুন করে নমুনা সংগ্রহের জন্য অবচেতন করা হলে তা চরম ঝুঁকিপূর্ণ এবং চেতনা ফিরে না আসার আশঙ্কা রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা মতামত দেন।

উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে সম্প্রতি বার্ধক্য জনিত অসুস্থতার কারণে ২২ বছর বয়সী সিংহ সোহেল তার সঙ্গীনি নদীকে রেখে মারা যায়। বর্তমানে পার্কে বিপরীত লিঙ্গের দুটি করে ৪টি সিংহ রয়েছে। এছাড়াও সাফারী পার্কের বেষ্টনীতে বর্তমানে নানা আক্রা একটি স্ত্রী হাতি (রংমালা), লামচিতা ও আসামী বানর বয়সের ভারে অনেকটা কাবু হয়ে পড়েছে। যে কোন মুহূর্তে নিঁভে যেতে পারে তাদেরও জীবন প্রদীপ।
বৈশ্বিক মহামারি কোভিড়-১৯ করোনা মহামারী জনিত কারণে সাফারি সরকারি নির্দেশনায় দীর্ঘ সময় পার্কে দর্শনার্থী প্রবেশ সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ ছিল। এসময় নিরাপদ পরিবেশে পার্কে থাকা সব প্রাণীর সংসারে নতুন অতিথি আসলেও শুধুমাত্র আসছেনা বাঘ ও সিংহ পরিবারে। এদিকে, মেডিকেল টিম গঠন করে পার্কের রংমালা নামের ৮৫ বছর বয়সী অসুস্থ স্ত্রী হাতিটিকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এতে সে কিছুটা সুস্থ হয়েছে। তবে পুরোপুরি আশঙ্কামুক্ত নয়।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন