ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের সন্নিকটে অবৈধ ৮ ইটভাটা: হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য
কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারাস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক সীমানা ঘেঁষে লামার ফাঁসিয়াখালীর বনাঞ্চলের ভেতরে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ ৮টি ইটভাটা। এসব ইটভাটা স্থাপনে পরিবেশ অধিদপ্তর, বনবিভাগ ও প্রশাসনের কোন অনুমতিপত্র নেয়া হয়নি। তিনটি ড্রাম সিমনি ও পাঁচটি উচু চিমনি দিয়ে এসব ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতরে।
এসব ইটভাটায় জালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে ভাটা লাগোয়া সরকারি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মূল্যবান গাছপালা। ইটভাটা গুলো ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ককে তিন পয়েন্ট থেকে ঘেরাও করে রেখেছে। এসব ইটভাটার চিমনি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ার কার্বন ধুলা পড়ে সাফারি পার্ক ও পার্ক লাগোয়া বনাঞ্চলের গাছপালা বিবর্ণ হচ্ছে। হুমকির মুখে পড়েছে সাফারি পার্কের জীববৈচিত্র্য।
পাশাপাশি বনবিভাগের পাহাড় কেটে মাটি দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ইট। এ ছাড়াও ইটভাটা গুলোর কারণে বনজ সম্পদ উজাড় হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ অবস্থার কারনে বনাঞ্চলের বন্যহাতি ও বন্য পশুপাখির প্রাকৃতিক চলাচল পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে এসব ইটভাটার পরিবেশ বিধ্বংসী বিরূপ প্রভাবের কারণে পার্কের বেশ কটি বন্যপ্রাণী ও পাশের বনাঞ্চলে অন্তত তিনটি বন্যহাতির মৃত্যু ঘটেছে। পাশাপাশি ইটভাটার কারণে পরিবেশগত সংকট দেখা দেয়ায় পার্কের দর্শনার্থীদেরও নানা ভোগান্তিতেও পড়তে হচ্ছে ।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, মিউনিসিপ্যাল এলাকা ব্যতিত অন্য এলাকায় ইটভাটা স্থাপন করতে হলে বনবিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অন্তত ১০মাইল দুরে স্থান নির্ধারণপুর্বক সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো থেকে অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু সাফারি পার্কের পাশে ফাসিয়াখালীতে গড়ে তোলা অবৈধ ৮টি ইটভাটার ক্ষেত্রে সরকারি কোন ধরণের নিয়ম কানুন মানা হয়নি। শুধুমাত্র প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে অভিযুক্ত ভাটা মালিকরা পরিবেশ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সাফারি পার্কের একেবারে পাশে ভাটা স্থাপনপুর্বক সেখানে ইট পুড়ানো প্রতিযোগিতা শুরু করেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারাস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাফারি পার্কটি বন বিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতরে প্রকৃতিক পরিবেশে গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে বহু প্রজাতির পশুপাখি নির্দিষ্ট বেস্টনীর ভেতরে মুক্তভাবে বসবাস ও বিচরণ করে থাকেন। বাইরের বনাঞ্চল থেকেও বিপন্ন বন্যপ্রাণীরা এই পার্কের বাইরের বনাঞ্চলে গিয়ে অবস্থান নেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু এই পার্কটির তিনদিকে লামার ফাঁসিয়াখালীতে গড়ে উঠেছে অবৈধ ৮টি ইটভাটা।
এসব ইটভাটা স্থাপনে জেলা প্রশাসন, বনবিভাগ ও পরিবেশ অধিদফতরের কোন ধরনের অনুমতিপত্র নেই। ওইসব ইটভাটার কারণে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল থেকে সাফারি পার্কের পাশের প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে বন্য জীবজন্তুর যাতায়াতের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ইটভাটার জন্য জালানি সংগ্রহ ও মাটি দিয়ে ইট তৈরির জন্য পাহাড় কাটার কারণে বনাঞ্চলে পশুর খাদ্যাভাব দেখা দেয়ায় এ বছর লামা বনাঞ্চলে অন্তত ৫টি বন্যহাতি মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
এসব ইটভাটার কয়েকটিতে উঁচু চিমনি থাকলেও বেশির ভাগই বাংলা চিমনি। সব ইটভাটায় বনাঞ্চল থেকে অবৈধভাবে কাঠ সংগ্রহ করে জ্বালানি হিসেবে পোড়ানো হচ্ছে। পাহাড় কেটে মাটি নিয়ে তৈরি হচ্ছে ইট। ইটাভাটার কালো ধোঁয়া ও ধুলাবালি পার্কের পরিবেশকে বিষিয়ে তুলেছে। এ পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে বনাঞ্চলের অনেক পশুপাখি, গাছপালা ও লতাগুল্ম মরে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে বিপদাপন্ন বন্যপ্রাণী এখন পার্কের বাইরের খোলা বনাঞ্চলে ঢুকতেই পারছে না।
সরেজমিন দেখা গেছে, ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক ঘেঁষে লামার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের এসব ইটভাটার মধ্যে ফাঁসিয়াখালী সাপেরগাড়া পুলিশ ফাঁড়ির পাশে প্রভাবশালী ব্যক্তি পিয়ারু ও শামসুদ্দিনের একটি ইটভাটা, সাফারি পার্ক ঘেঁষে পিয়ারু ও বশির চেয়ারম্যানের আরও দুটি ইটভাটা, হারগেজা এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতা নুর হোসেন চৌধুরীর একটি, সাপেরগাড়ায় ইমরানের একটি, ইয়াংছায় সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানের ভোটভাই বাদশা মিয়া ও নাছির উদ্দিনের তিনটি ইটভাটা রয়েছে।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের চকরিয়া উপজেলার ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জের বনাঞ্চল উজাড় করে সংগৃহীত কাঠগুলো ইটভাটায় নেয়া হচ্ছে। এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের অভিযোগ এসব অবৈধ ইটভাটার মালিকদের সাথে কিছু অসাধু বনকর্মকর্তা-কর্মচারী, পরিবেশ অধিদফতরের কিছু ব্যক্তি ও পুলিশের যোগসাজশ রয়েছে। সাফারি পার্কের বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে রয়েছে সড়ক। এ সড়ক দিয়ে ট্রাকে করে মাটি ও বালু পরিবহন করা হয়। ট্রাকে করে এসব মাটি ও বালু পরিবহনের সময়ও ধুলাবালি জীবজন্তুর বেস্টনীর ভেতরে গিয়ে পড়ছে। ওই ধুলাবালির কারণে পার্কের দর্শনার্থীদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। গাড়ি চলাচলের শব্দেও পার্কের পশুপাখির মধ্যে বিরূপ প্রতিতক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
জানতে চাইলে ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের বনবিট কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বেশ ক’বছর আগে থেকে পার্কের পাশে এসব ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে। আমাদের জানা মতে, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতরে বা পার্কের পাশে ইটভাটা স্থাপনে সরকারি কোন ধরণের অনুমোদন দেয়ার কথা না। এসব ইটভাটার কারণে সাফারি পার্কের জীববৈচিত্র মারাত্বকভাবে হুমকির মুখে পড়েছে। বিষয়টি আমরা উর্ধ্বতন প্রশাসনকে অবগত করেছি।
তিনি বলেন, এসব ইটভাটা ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ককে তিন পয়েন্ট থেকে ঘেরাও করে রেখেছে। এসব ইটভাটার চিমনি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ার কার্বন ধুলা পড়ে সাফারি পার্ক ও পার্ক লাগোয়া বনাঞ্চলের গাছপালা বিবর্ণ হচ্ছে।