পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি অস্তাচলে-২

দিনের আলোয় বিদ্বেষ ছড়ালেও রাতে সেনাবাহিনীর কাছে নিরাপত্তা চাইতেন জেএসএস নেতা

fec-image

পানছড়ি কলেজ গেট থেকে আধা মাইল পূর্বে মন্জু আদাম নামক স্থানে থাকতেন জনসংহতি সমিতি পানছড়ি থানার সভাপতি ভবদত্ত। উনার সাথে আমার প্রায় সময়ই কথা হতো এলাকার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে। আমি তাকে আস্থায় নেওয়ার চেষ্টা করি, যেন উনি আমাকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন। কিন্তু উনি উনার দীর্ঘদিনের লালিত মানসিকতা থেকে বের হয়ে সেনাবাহিনীকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিজেকে জড়াতে চাইতেন না। অথচ, প্রকাশ্যে সেনাবাহিনীর সমালোচনা করতেন। অন্যদিকে কোনো রাতে উনার এলাকায় সেনা পেট্রোলের আভাস না পেলে অনুযোগ করতেন, যেন তার বাড়ির পাশে সেনাবাহিনীর টহল দল ঘন ঘন যায়।

আমি একদিন তাকে মুখের উপর বলে দিলাম, ‘দত্ত বাবু, আপনারা তো চান সেনাবাহিনী পাহাড় থেকে চলে যাক, তবে এখন কেন বাড়ির পাশে টহল দলের উপস্থিতি চান?’
তিনি বললেন, ‘এটা আমাদের রাজনৈতিক বক্তব্য, সেনাবাহিনী চলে গেলে আমাদের এখানে থাকা সম্ভব হবে না।’

তার এই কথার প্রমাণ পরবর্তীতে পাওয়া যায়, পানছড়ি জোন গুটিয়ে নেওয়ার পর গুটিয়ে গেছে কলেজ গেট সংলগ্ন জনসংহতি সমিতির অফিসটিও। আমার কার্যকালেই (২০০৩-২০০৬) জেএসএস দ্রুত তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিলো পানছড়ির বিভিন্ন গ্রাম-জনপদের উপর থেকে। জেএসএসের উপস্থিতি ছিলো সদর এলাকা এবং জোন সদরের আশে পাশে।

প্রতিপক্ষ ইউপিডিএফ (ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট) গ্রামের পর গ্রামে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে যাচ্ছিল। এমনকি প্রায়ই তারা প্রতিপক্ষ জেএসএস’র শক্তিকেন্দ্র কলেজ গেট-বাজার এলাকায় আত্মসমর্পণকারী শান্তি বাহিনীর সদস্য ও তাদের সমর্থকদের উপর আক্রমণ চালাতো।

২০০৪ সালে এমন এক আক্রমণে মারাত্মকভাবে আহত হয় জেএসএস’র এক সদস্য (নাম মনে নেই)। পরে সে আহত অবস্থায় খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে মারা যায়।

একটা সময় কলেজ গেটের উল্টো দিকে মীর্জা টিলায় রাতের পর রাত আমরা ফাঁদ পেতে থাকতাম, জাল ফেলে নদীতে মাছ ধরার আশায় যেমনটা জেলেরা করে থাকে। কেননা, জেএসএস‘র ছাত্র সংগঠনের সভাপতি সাগর ভাসা ছিলো ইউপিডিএফ’র অন্যতম টার্গেট। টিএন্ডটি টিলার এক প্রান্তে তার বাড়ি। রাতে কখনোই সে বাড়িতে ঘুমাতো না। তাকে হত্যার জন্য ইউপিডিএফ একাধিক বার চেষ্টা করে।

সাগর ভাসা দিনের আলোতে প্রচন্ড সেনা বিদ্বেষ ছড়ালেও সন্ধ্যায় আমার সাথে জোন সদরে আলাপচারিতার সময় তার মুখে ইউপিডিএফ’র আতঙ্কের স্পষ্ট আভাস দেখতে পেতাম। তাকে মেরে ফেলতে ইউপিডিএফ আসবে, এ আশঙ্কায় আমরা তখন খুব গোপনে টি এন্ড টি টিলার পার্শ্ববর্তী ছড়ার ধারে অ্যাম্বুশ পেতে রাখতাম।

যদি আসে, এ ভাবনায় সাগর ভাসার বাড়িতে নিজেকেই টোপ হিসেবে লুকিয়ে রাখতাম। চিন্তা ছিল, ‘মারফীর ল’-এর মতো ‘If anything to go wrong, will go wrong.’ অর্থাৎ যা ঘটার তা ঘটবেই। বাস্তবতা হলো, তেমন কোনো কিছুই ঘটেনি। তবে দুঃখজনক হলো, যে দিন তা ঘটলো সে দিন আমরা কেউ তার আশেপাশে ছিলাম না। আমি পানছড়ি ছেড়ে চলে আসার বছরখানেক পর সাগর ভাসাকে হত্যা করে প্রতিপক্ষ।

তখন সাগর ভাসাসহ জেএসএস সমর্থকদের সকল কর্মকাণ্ড ছিলো পানছড়ি বাজার কেন্দ্রিক। বাজারের নিয়ন্ত্রণ রক্ষা তাদের অস্তিত্বের জন্য ছিলো অপরিহার্য। অপরদিকে ইউপিডিএফ চাইতো বাজারে অফিস স্থাপন করতে। ওরা পানছড়ি জোন সদর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে পুঁজগাও অভিমুখী সড়কের পাশে অফিস স্থাপন করলে জেএসএস আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

একদিন ভবদত্ত ছুটে আসে ইউপিডিএফ’র অফিস যেন ভেঙে দেই, সে আবদার নিয়ে। আমরা জোন থেকে ইউপিডিএফ’র অফিস স্থাপনে কোনো বাধা প্রদান করি না এই যুক্তিতে যে, ওরা একই রকম অফিস খাগড়াছড়ি রিজিয়ন সদর দপ্তরের কাছেও চালায়।

ব্যাস, দিনরাত সেনা টহলের মধ্যে জীবনযাপন করা ভবদত্তের কাছে আমরা হয়ে গেলাম নিন্দিত। জেএসএস’র অধিকাংশ সামরিক ক্যাডার আত্মসমর্পণের পর নিজ পাড়া বা গ্রামের ভিটিতে না ফিরে উপজেলা সদরের আশেপাশে ঘাঁটি বেঁধেছিলো। তাই রাজনৈতিকভাবে তারা জনসমর্থন হারায়, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

তাছাড়াও দীর্ঘ সংঘাতের সময় শান্তি বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যদের বাড়াবাড়ি এবং সেনাবাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্টতা আছে এই অপবাদে অনেকেই হত্যা এবং জরিমানার মুখে পড়েছিল। চুক্তি পরবর্তী বাস্তবতায় এ ধরনের নির্যাতিত পরিবার ইউপিডিএফ’র পতাকাতলে জড়ো হয়।

আমি সোর্সের মাধ্যমে ইউপিডিএফ’র স্থানীয় পর্যায়ের একজন নেতা আলোক বিকাশের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করি এবং তার কাছ থেকে জানতে চাই, জেএসএস’র সাথে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শগত পার্থক্য কী, কতটা গভীর এবং তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী? এর জবাবে তার কাছ থেকে যে ব্যাখ্যা পেলাম, তাতে বুঝা গেলো, রাজনৈতিক আদর্শের ছিটেফোঁটা গন্ধ থাকলেও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পেছনে মূলত ব্যক্তি বা সামাজিক পর্যায়ের স্বার্থের বিষয়টিই বেশি প্রাধান্য পায়।

জেএসএসকে তারা পাহাড়িদের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছে বলে অভিযুক্ত করে। জেএসএস’র ভ্রান্ত কৌশলের কারণে পাহাড়িরা তাদের অনেক জমি হারিয়েছে। এক্ষেত্রে তারা ১৯৮৬ সালে পাহাড়িদের উদ্বাস্তু হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করতে এবং আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের গ্রামে আক্রমণের কথা উল্লেখ করে। অনেক পাহাড়ি নিজেদের ভূমি ছেড়ে যেতে চায়নি। ভারতের শরনার্থী শিবিরে গিয়েও তারা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে, কিন্তু ওখানে এসবের প্রতিকার পাওয়া সম্ভব হয়নি।
জেএসএস’র অনেকেই গোপনে বাঙালিদের কাছে জমি চাষ করার লিজ দিয়ে ভারতে গিয়ে নিরাপদ জীবন কাটাতো। ফিরে এসে তারা সরকারি সহায়তা পেয়েছে, চাকরি পেয়েছে। কিন্তু প্রান্তিক জনগণ তেমন কিছুই পায়নি।

আলোক বিকাশের কথায় আরো জানা যায়, ইউপিডিএফ তাদের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের স্বপ্ন এবং সেখান থেকে আলাদা জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠাকে চূড়ান্ত লক্ষ্য নির্ধারণ করে তরুণ এবং শিক্ষিত জনগোষ্ঠির মধ্যে তা ছড়িয়ে দিতে চায়। তাদের এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তারা পুনরায় সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ধরার প্রতিশ্রুতি দেয়। সে কারণেই তারা স্থানীয়ভাবে নিজেদের সংগঠিত করতে চায়, আর এজন্য চাই অর্থ, রাজনৈতিক শক্তি এবং গোপন সামরিক শক্তি। তবে এখনই তারা সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে যেয়ে শক্তি ক্ষয় করতে চায় না। সেনা টহলকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলাই তাদের কৌশল। পাহাড়ে সেনাবাহিনীর অবস্থা ৭২-৭৬ সালের মতো নয়। এখন রাস্তাঘাট হয়েছে, পাহাড়ে জুম চাষের কারণে জঙ্গল কমে গেছে, তাই পাহাড়ে আগের মতো ক্যাম্প স্থাপন করা সহজ নয়।

তার এসব কথায় পাহাড়ি জনপদের এই বঞ্চনা ও অস্থিরতার চিত্রটিকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৭২-৭৩ সালের জাসদ গঠনের সময়টির সাথে আমি অনেক মিল খুঁজে পাই।

অন্যদিকে জেএসএস’র নেতা এবং প্রাক্তন শান্তি বাহিনীর সদস্যদের সাথে কথা বলে তাদের জুম্মল্যান্ড স্বপ্ন থেকে সরে আসার একটা চিত্র পাই।

‘২০ বছর জঙ্গলে কাটিয়েছি, আমাদের যৌবনটা পাহাড়ে পাহাড়ে কেটেছে। চুক্তিতে যা পেয়েছি সেটার বাস্তবায়ন হলে আমাদের অস্তিত্ব থাকবে, না হলে এভাবে সরকারের সাথে যুদ্ধ করে করে আমাদের শুধু ক্ষয় হতে থাকবে, যুদ্ধ কী জিনিস ওরা ( ইউপিডিএফ) জানে না।’ নালকাটা ক্যাম্প সংলগ্ন আত্মসমর্পণকারী লে. প্রদীপের এ বক্তব্যে বাস্তবতা অনুধাবনের একটা সুর আছে।

পানছড়ির ১৬ কিলোমিটার পশ্চিমে লোগাং বিডিআর ( প্রাক্তন) জোন সংলগ্ন একটি টিলার নিচে ছিলো দুর্ধর্ষ সোহেল চাকমার বাড়ি। সোহেল ছিলো জেএসএস’র অন্যতম পাওয়ার হাউজ। ইউপিডিএফ তার কারণেই লোগাং জোনে বেশ একটা সুবিধা করতে পারছিলো না। সোহেলের পরিচিতি ছিলো সন্তু লারমার প্রাক্তন দেহরক্ষী হিসেবে। কিশোর বয়সেই সে শান্তি বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। স্থানীয় পাহাড়িদের কারো কারো ক্ষোভ ছিলো তার উপর, তার কারণেই অনেক বয়োজ্যেষ্ঠকে সেনাবাহিনীর সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগে চরম দণ্ড পেতে হয়েছে শান্তি বাহিনীর কাছ থেকে। এরকম অনেক গল্প শুনেছিলাম।

ইউপিডিএফ তাকে হত্যার মিশনে আছে, এটা সোহেল আমার কাছে স্পষ্টভাবে স্বীকার করে জানায়, সে সন্ধ্যার পর বাড়িতে থাকে না। রাতে কার ঘরে ঘুমায় এটা তার স্ত্রীও জানে না। সোহেল একবার আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বলে, ‘স্যার, চুক্তির আগেই ভালো ছিলাম, তখন আর্মি আসলে আগেই খবর পেতাম। এখন বিপদ আরো বেশি, কাউকে বিশ্বাস করা যায় না।’

তার কথার বাস্তব প্রতিফলন ঘটে কয়েক মাসের মধ্যে। একদিন সন্ধ্যা রাতে আশ্রয়দাতা বাড়ির আঙ্গিনায় গল্প করার সময় হঠাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে বের হয় দুই আততায়ী। ক্ষিপ্র গতিতে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে সে। ততক্ষণে আততায়ীর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র গর্জে ওঠে। তবে সোহেলের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল। পিছনের দরজা গলে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে খাদে। অন্ধকারে দিশেহারা হয়ে পড়ে আততায়ী, হারিয়ে ফেলে টার্গেট। কিন্তু তাই বলে তাদের গুলি একেবারে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি, আশ্রয়দাতার ১৩ বছরের কিশোরী কন্যা পুতুলী চাকমার বুক ভেদ করে তার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিয়ে যায়।

শান্তি বাহিনীর প্রাক্তন সদস্য শুক্রসেন চাকমার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ’র ১৩/১৭ জনের একটি সশস্ত্র গ্রুপ এই হামলা চালিয়েছিলো বলে পরে জানা যায়। কাকতালীয়ভাবে এই গ্রুপটির উপর আমরা একটা অ্যাম্বুশ করার একটি সূত্র পেয়ে যাই ১৩ ডিসেম্বর ২০০৪ সালে। কিন্তু আমাদের একটি ভুলে ১টি লাশ ও কয়েকটি অস্ত্র ফেলে বাকীরা অ্যাম্বুশ থেকে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

এই গ্রুপের অন্যতম সদস্য রাজীব চাকমাকে গ্রেফতার করতে অসংখ্য বার তার সম্ভাব্য চলাচলের পথে ছোট ছোট অ্যাম্বুশ ফেলে বহু বিনিদ্র রজনী পার করেছি। জেএসএস ত্রাস এই তরুণকে ধরার জন্য এক রাতে তার বাড়িতে হানা দেই। চলবে—
(০৬-০২-২০২২)

লেখকের আরো লেখা পড়ুন

ইউপিডিএফ ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে গেল আজকের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে

পাহাড়ের লাভ জিহাদ এবং ধর্মান্তকরণের ফ্যাক্ট ও মিথের চিত্র

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন