আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২৩

নারী-পুরুষের সমতা পৃথিবীর কোথাও নেই: মিথিলা

fec-image

প্রতিবছর মার্চ মাসের ৮ তারিখ বিশ্বজুড়ে উদ্‌যাপিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। চলতি বছরও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। যথারীতি নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও দিনটি (৮ মার্চ) পালন করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় এবং বেসরকারি নানা আয়োজনের মাধ্যমে। সোশাল হ্যান্ডেলে বয়ে যাচ্ছে নানান আলাপ। এই দিনটিকে একজন নারী তারকা ঠিক কোন দৃষ্টিতে বিবেচনা করেন। তিনি যদি সিঙ্গেল মাদারের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, তাহলে তো সেই অভিজ্ঞতা শোনা জরুরি। সেই তারকার গতিবিধি যদি আন্তর্জাতিক হয়, তবে তো দেশের প্রেক্ষাপটে বিদেশের নারীচিত্রটাও তুলে আনা দরকার। মূলত এসব ভাবনা থেকেই নারী দিবসের বিশেষ আয়োজনে বিস্তর কথা হলো দুই বাংলার অভিনেত্রী রাফিয়াত রশিদ মিথিলার সঙ্গে-

সিঙ্গেল মাদার
আমি বিবাহিত হয়েও সত্যিই একজন সিঙ্গেল মাদার! কারণ আমার মেয়ের (আইরা) লালন-পালন, লেখা-পড়া, বড় করার সকল দায়-দায়িত্ব আমারই। তবে হঁ্যা, আমার আশেপাশে একটা সাপোর্ট সিস্টেম আছে। যেমন আমার আব্বু-আম্মু, শাশুড়ি, ভাই-বোন সবাই আমাকে সাপোর্ট দিয়েছে সর্বোচ্চ। সেটা ছাড়া আমার কিছু করাই সম্ভব ছিলো না।

আফ্রিকা অঞ্চলে একটা প্রবাদ আছে, ‘ইট টেকস আ ভিলেজ টু রেইজ আ চাইল্ড’। এর মানে হচ্ছে, সন্তান প্রতিপালনের জন্য প্রয়োজন পরিবার ও সমাজের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। সেখানে একজন সিঙ্গেল মাদারের জন্য আরও অনেক বেশি সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে সমাজের পক্ষ থেকে। কারণ, সেই সন্তানের মা প্রাথমিক এবং একমাত্র অভিভাবক। অথচ আমাদের এই সমাজ, সিঙ্গেল মাদারদের নিয়ে সেভাবে কি ভেবেছে কখনও! ভাবেনি, বরং সন্তান ও মায়েরা নানাভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হতে হতে নিজেদের টিকিয়ে রাখে।

নারী দিবস
নারী দিবস কেন, কী তাৎপর্য কিংবা যুগযুগান্তর ধরে নারীদের সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন হিসেবে রাখা হয়েছে- এগুলো আসলে নতুন করে বলার কিছু নেই।

যেটা বলার আছে। ২০২৩ সালে এসে এখনও নারীদের সম অধিকার দাও, বাল্যবিবাহ বন্ধ করো, নির্যাতন বন্ধ করো, চাকরি দাও, রেপ বন্ধ করো, মানসিক নির্যাতন করো না- এই কথাগুলো বলতে হয়। এটা খুব ক্লান্তিকর একটা বিষয়।

হুম অনেকে বলবে নারীরা এখন অনেক এগিয়েছে। বিমান চালাচ্ছে পাহাড়ে উঠছে…। কিন্তু হিসাব করলে তো সেটা নিতান্তই তলানিতে থাকবে, বিপরীত লিঙ্গের তুলনায়। বিষয়টা কিন্তু এমন না, নারীরা মেধায় যোগ্যতায় পুরুষের চেয়েও কম। আসলে কাঠামোটাই এমন করে রাখা হয়েছে। একজন নারীকে আগাতে গেলে যে প্রতিবন্ধকতা পেরুতে হয়- সেটাই আসলে পুরুষের সঙ্গে ভারসাম্যহীন ব্যবধান করে রেখেছে।

নতুন ট্রেন্ড
এই সময়ে এসে নারীদের নিয়ে নতুন ট্রেন্ড শুরু হয়েছে। নারীরা উপার্জন করছে। এটা খুব পজিটিভলি দেখছে সমাজ ও পাত্র পক্ষ। যেটা আগে ছিলো অপরাধের মতো। অথচ এখন চাকরিজীবী নারীদের ঘরের বউ হিসেবে বেশ আদর করে বরণ করে পুরুষ পক্ষ! যার ফলে, একটা সংসারে নারীর অর্থনৈতিক কন্ট্রিবিউশনও এখন থাকছে। যেটা আগে ছিলো না। এই বিষয়টিকে তুলে ধরে নারীদের একটা উন্নতির সূচক প্রকাশের চেষ্টা করে সমাজ।

কিন্তু একটা বিষয় খেয়াল করেছেন, সংসার চালানোর আয় ভাগাভাগি হলেও ঘরের কাজগুলো কিন্তু কেউ ভাগ করে নেয়নি। অফিস শেষে ঘরে ফিরে রান্না করা, সন্তান পালন, বিছানা গুছানো, টবে পানি দেওয়া- এই কাজগুলো নারীর ভাগেই রয়ে গেছে। এটার ভাগ বা দায় কিন্তু পুরুষরা নেয়নি।

মেন্টাল লোড নামের একটা টার্ম আছে। যেটা আসলে নারীদেরই বহন করতে হয় আজও। ছোট ছোট বিষয়গুলো- যেমন আজ কী রান্না হবে, কে বাচ্চাটাকে স্কুল থেকে আনবে, স্কুলের টিফিনে কী দেওয়া হবে, জামাই রাতে ফিরে কী খাবে, শাশুড়ি ওষুধ আছে কিনা- বিষয়গুলো কিন্তু ছোট ছোট। অথচ এসব মিলে কিন্তু প্রতিদিন একটা মেন্টাল লোড তৈরি করে নারীদের মগজে। সমাজ বলে দিচ্ছে এই চিন্তাগুলো আসলে নারীদেরই। পুরুষরা এসবের ভাগ নেবে না! কথায় আছে না ‘ট্রিপল বার্ডেন’- সংসার, সন্তান এবং মেন্টাল লোড। নারীদের চাকরি বা ব্যবসার অনুমতির ফলাফল হলো এই- সে এখন বাইরেও কাজ করবে, ঘরের কাজগুলো আগের মতোই বহাল তবিয়ত!

আদর্শ নারী
আগে আদর্শ নারীর সংজ্ঞা ছিলো- যে নারী শুধুই মন দিয়ে সংসার করে সে। এখন আদর্শ নারী মানে হচ্ছে যে নারী ঘর করে, বাইরেও কাজ করে, উপার্জন করে- সেই। সো ব্যাসিকলি একটা আদর্শ নারী বা সুপার ওমেন নামের যে কনসেপ্ট গ্রো করানো হয়েছে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে, তার মাধ্যমে একজন নারীকে আরও ধরেবেঁধে রাখার নতুন প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছু নয়।

পৃথিবীর চিত্র
আমি আফ্রিকায় দীর্ঘদিন কাজ করি। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ব্র্যাক) সাথে ১৪ বছরের বেশি। আফ্রিকার বাইরে পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে গিয়েছি, থেকেছি, সেখানকার নারীদের সঙ্গে কাজ করেছি। আফ্রিকাতে তো নিয়মিত যাচ্ছিই। সব দেখে আমার মনে হয়েছে, নারী-পুরুষের সমতা পৃথিবীর কোথাও নেই। হুম, পার্থক্যের মাত্রাটা বা ধরনটা আলাদা।

সহজ ভাষায় গাড়ির উদাহরণ দিয়ে বলি। গাড়ির একটা চাকা যদি ছোট আরেকটা যদি বড় হয়, সেটা আলটিমেটলি কোথাও পৌঁছাতে পারবে না। হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়বেই। একইভাবে একটা পরিবার, একটা দেশ বা একটা পৃথিবী যদি সুস্থভাবে এগুতে চায়, তাহলে দুটো চাকা সমান হতে হবে। এই সহজ বিষয়টি কেন আমরা বুঝি না, সেটা আমি বুঝি না।

মানুষের অধিকার
আমরা যে এই অসমতার বিষয়টি বুঝি না, তাও নয়। বুঝেও বুঝতে চাই না। পুরুষরা যেহেতু প্রিভিলেজড অবস্থানে থাকে, ফলে তারা তাদের সুবিধাটুকু ছেড়ে নারীদের বিষয়টি বুঝতে চায় না। শুধু নারী না, তৃতীয় লিঙ্গের কথাও যদি বলি। এমন আরও অনেক জেন্ডারের মানুষ আছে পৃথিবীতে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন প্রচুর মানুষ আছে। এরা সবাই নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে থাকে। আমি যতগুলো জনগোষ্ঠীর কথা বলছি, যেমন পুরুষ, নারী, তৃতীয়লিঙ্গ, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন- এরমধ্যে কে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। জবাব- পরুষ বিভাগ। এখানে আমি কিন্তু মোটেও পুরুষ বিদ্বেষের কথা বলছি না। বলছি সম অধিকার বা মানুষের অধিকারের কথা। আমি তো মনে করি অন্যরা যদি শিক্ষিত ও সচল হয় বা সমান গতির হয় তাহলে পুরুষরাই লাভবান হবে। গাড়ির দুটো সমান চাকা হবে তখন।

তাই নয়। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ- সবগুলোর অভিযোগ পুরুষের কাঁধে যাচ্ছে। পুরুষরা হিংস্র হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। নারী হিসেবে এটা তো আমারও শুনতে খারাপ লাগছে। বিপরীতে এই নারীদের দাবিয়ে রাখার জন্য অনেক কিছু করতে হচ্ছে পুরুষদের। সমাজ পুরুষদের শেখায়- তোমাকে কাঁদা যাবে না, তোমাকে গরম দেখাতে হবে, শাসন করতে হবে, কনট্রোল করতে হবে- কারণ তুমি পুরুষ, তুমি পিতা! এতে করে পুরুষেরই আদতে ক্ষতি হচ্ছে।

তাই এখনও নারী দিবসটি পালন করার প্রাসঙ্গিকতা আছে পৃথিবীজুড়ে। কারণ নারী এখনও সমঅধিকার পায় না। তৃতীয়লিঙ্গ আরও পিছিয়ে আছে। নারী ও তৃতীয়লিঙ্গ এখনও পৃথিবীর বুকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক। সেজন্য এগুলো মনে করিয়ে দেয়ার জন্য এই দিবসটি পালনের প্রাসঙ্গিকতা আছে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: নারী, পুরুষ, পৃথিবী
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন