স্ট্রিট উইদাউট জয়: খাগড়াছড়ি টু পানছড়ি

পানছড়িতে সেনাবাহিনীকেও চাঁদা দিতে হবে!

fec-image

তারিখটা ঠিক মনে নেই, তবে সময় সকাল ১১টা, ২০০৬ সালের মার্চ মাসের। পানছড়ি জোন সদরের প্রশিক্ষণ মাঠে চলছে কমান্ডো ট্রেনিং। প্রশিক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে মাঠে থেকে তদারকি করছি। নিজেও কিছুক্ষণ আগে খাগড়াছড়ি থেকে ফিরেছি, ষান্মাসিক শারীরিক দক্ষতা যাচাইয়ের পরীক্ষা দিয়ে। গায়ে তখনও হালকা ব্যথা।

তখনই ব্যথা ভুলানোর মতো সংবাদ নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো রেজিমেন্টের পুলিশ। তার খবর যেন গরম তেল গায়ে ঢেলে দিলো: ‘স্যার, পেরাছড়াতে (পানছড়ি জোন থেকে খাগড়াছড়ির দিকে ১৮ কিলোমিটার) বাস থেকে আমাদের ফ্রেসের (তাজা রসদের) মাছের দুটো পেটি বক্স পাহাড়িরা নামিয়ে রেখেছে। চাঁদা চেয়েছিলো বাস চালকের কাছে, সেনাবাহিনীর মাছ এটা বলার পরও ওরা মাছ নামিয়ে রেখেছে। বলেছে, মাছ নিতে হলে চাঁদা দিয়ে নিতে হবে!’

আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলো সংবাদটা: ‘এত্ত বড় সাহস!!’
রাগে-ক্ষোভে আমার চোয়ালের দু’পাটি দাঁত যেন একসাথে জমাট বেঁধে গেল। মনের গভীরে শোলে ছবির গাব্বার শিংয়ের হুংকার শুনতে পেলাম,
‘শুয়োর কা বাচ্চা!’

আমার আর জানার বাকী নেই, এটা পাহাড়ের নতুন ডন ইউপিডিএফের কাজ। পেরাছড়াতে ইউপিডিএফের রাজত্ব। ঐ এলাকা খাগড়াছড়ি জোনের এলাকা। আমাদের সীমানা পেরাছড়া ব্রিজ থেকে শুরু।

দ্রুত প্রশিক্ষণরত তাগড়া টাইপের ২০টা জোয়ানকে গাড়িতে উঠার নির্দেশ দিয়ে আমার জিপের দিকে এগিয়ে গেলাম। সারা শরীরের রক্ত তখন মাথায়, এ রকম ঘটনা তো ৮০-র
দশকেও ঘটেনি! সেনাবাহিনীকে তো যথেষ্ট সমীহ করেই চলতো শান্তি বাহিনী, তবে এই নব্য ডনরা এতো সাহস কোথায় পেল? এতটাই অরাজকতা!! এই ডন’রা তো হিলটাকে সোমালিয়া বানিয়ে ফেলছে দেখি । আমার মনে ক্ষোভের আগুন এতটাই তীব্র, তা যেন আজ পেরাছড়াকে হিরোশিমা বানিয়ে দেবে। রাস্তার কোনো খানা-খন্দককে তোয়াক্কা না করে ঝড়ের গতিতে চলছি,—।

খাগড়াছড়ি-পানছড়ির মধ্যকার ২৫ কিলোমিটারের এই সড়কটি ভিয়েতনাম যুদ্ধের ইতিহাসে পড়া সেই বিখ্যাত ‘স্ট্রিট উইদাউট জয়’ (Street without Joy)-কেই মনে করিয়ে দেয়। হুয়ে ( Hue) থেকে কোয়াং ট্রি (Quang Tri) পর্যন্ত সাউথ চায়না সি বরাবর দক্ষিণ ও উত্তর ভিয়েতনামকে সংযোগকারী এই সড়কে ফ্রেন্চ বাহিনী কখনোই অ্যাম্বুশ ছাড়া পার হতে পারেনি। ছোট ছোট বালুর ঢিপি আর লবণাক্ত জলাভূমির মাঝে মাঝে ছিল ভিয়েতনামীদের গ্রাম। এসব জনবসতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ভিয়েতনামের গেরিলারা আক্রমণ করতো ফরাসী বাহিনীকে। পানছড়ি-খাগড়াছড়ির সড়কটিরও একই বৈশিষ্ট্য, একপাশে চেঙ্গি নদী আরেক পাশে ছোট ছোট টিলা, তারই ফাঁকে ফাঁকে পাহাড়ি বসতি। অ্যাম্বুশ করার জন্য উত্তম ভূমি।

‘গুলি করো পালিয়ে যাও’- এরকম রণ কৌশলে এ রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী সকল প্রকার টহলকে ব্যাতিব্যস্ত রেখেছিলো শান্তিবাহিনী।

এ রাস্তা দিয়ে চলতে গেলে গুলির মুখোমুখি হওয়া ছিলো একটা নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। সত্তর-আশির দশকে খাগড়াছড়ির আলুটিলা থেকে এ দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে টহল করতো তখনকার সৈনিকরা। ফেরার পথে শান্তিবাহিনীর মুখোমুখি হওয়াটা ছিলো তাদের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার।

এসব উপদ্রুব কমাতে এবং সেনাবাহিনীসহ সর্বসাধারণের চলাচলে সুরক্ষা দিতে এই পথে স্থাপন করা হয় নালকাটা-ভাইবোন ছড়া-পেরাছড়া ক্যাম্প আর রুট প্রটেকশন পোস্ট। শান্তিচুক্তির পর সে রকম আক্রমণ না হলেও পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা এই পথের বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজির পোস্ট বসিয়েছে। চাঁদা না দিয়ে এ পথে কোনো কিছুই চলতে পারে না। পাহাড় থেকে বাজারে বিক্রির জন্য নেওয়া সকল কিছুর উপরই দিতে হয় নির্ধারিত অংকের চাঁদা।
স্থানীয়দের ভাষায়, ‘পাহাড়ে কোনো মুরগির ডিম পারলে, সেই ডিমের উপরও চাঁদা দিতে হয়।’

চাঁদা সন্ত্রাসীদের খুব সহজ আয়ের উৎস। নির্দিষ্ট পোস্টে দাঁড়াও সবাই বিনা বাক্যে কড়ি ফেলবে। কেউ প্রতিবাদ করবে না। কাউকে বলবেও না। ব্যবসায়ীদের কাছে এটা এখন ‘কস্ট অফ বিজনেস’ (Cost of Business).

পানছড়িতে তখনকার হিসাবে মাসে প্রায় বিশ লক্ষ টাকা তোলা হতো এই সড়ক থেকে। তা এমন সোনার খনির দখল কে না পেতে চায়। তাই তো আজ পাহাড়ে একটি থেকে দুটি, দুটি থেকে চারটি দল হয়েছে। মুখে চলে চুক্তি বাস্তবায়নের ধুয়া, স্বায়ত্তশাসনের গরম শ্লোগান। তলে তলে চলে নিবিড় চাঁদাবাজী।

‘পাহাড়ে থাকতে হলে চাঁদা দিয়েই থাকতে হবে’-  এমন দুর্নিবার আস্পর্ধায় ওরা সেনাবাহিনীর রসদের উপরও হাত দিয়েছে? এর পরিণাম তো তাদের ভোগ করতেই হবে। এই প্রত্যয় নিয়েই টর্নেডোর মতো হাজির হলাম পেরাছড়ার বাস স্টপেজে। কিন্তু সবই যেন ‘ বিজনেস এজ ইউজাল (Business as usual). কিছুই ঘটেনি, কেউ কিছু দেখেনি, কেউ কিছু শুনেওনি।

চায়ের দোকান চালান এক দিদি, যার দোকানের সামনেই বাস থেকে নামানো হয় মাছের বক্স দুটি, তিনিও বললেন, ‘মুই কিচছু ন দেহি’, ‘মুই তো সেখন ঘরত ন থেই’, ‘মুই কিচছু ন শুনোন’ টাইপ জবাব দিলেন। ব্যাপারটা খুবই স্পষ্ট ‘ভয়’, ভয়ের কারণে তারা কিছুই বলবে না, এটাই স্বাভাবিক।

এর ফলে পেরাছড়াতে একটা গাব্বার শিং টাইপ শো ডাউন করতেই হলো। আশেপাশের সব দোকানী এবং যুবকদের জড়ো করলাম এবং যারা নিয়েছে তাদেরকে এই ম্যাসেজ দিতে যে, এই ঘটনার জন্য এলাকায় ব্যাপক তল্লাশি হবে।

‘মাছ দে দো, ভারনা গাব্বার শিং তেরা পিছা নেহি ছাড়ে গা!’
গাব্বার শিংয়ের ডায়লগ ধার নিয়ে বললাম, ‘উসকো সাজা মিলেগি, বরাবর মিলেগি!’
শেষ বিকালের মধ্যে মাছ পানছড়িতে ফেরত দেওয়ার সময় বেঁধে দিই। এসময় স্থানীয় একজন মুরুব্বিকে একপাশে ডেকে নিয়ে মাছ উদ্ধারে তাকে ভূমিকা রাখতে বলি।
মাছ ফেরতের মধ্যে সেনাবাহিনীর মর্যাদা মিশে আছে, এ কথাটি মুরুব্বির কানে দিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনতে পানছড়ির দিকে রওনা করি।।

যেতে যেতে পরিকল্পনা করি, এই চাঁদাবাজদের ধরতে ভিন্ন কৌশল ব্যবহার করতে হবে। স্বাভাবিক সেনা টহলে এসব দূর হবে না। স্ট্রিং অপারেশন করতে হবে, ‘যেখানে নিজেই টার্গেট নিজেই হিটার।’ ২/৩ জনের মাইক্রো টিমে সাদা পোশাকে পণ্যবাহী চান্দের গাড়ি, বাস, ট্রাকে লুকিয়ে ‘রোড মার্শাল’ হিসেবে চলাচল করতে হবে। যেমনটা বিমান ছিনতাই প্রতিরোধে ‘এয়ার মার্শালরা’ করে থাকে। তো এসব কাজে রিজিয়িন সদরের অনুমতি লাগবে। আর সেখানেই বড় বাঁধা-রিস্ক এভারটার (Risk Averter) কমান্ডারগণ এ সকল কাজে নিজেকে নিরাপদে রাখতে চান, তাই অনুমতি পাওয়া সহজ নয়।

যাহোক, পাহাড়ি মুরুব্বি কথা রেখেছেন। সন্ধ্যার আগেই বরফ দেওয়া মাছের বক্স দু’টি জোনের সদর গেইটে পৌঁছে দেয় কোনো একজন। স্বস্তির সংবাদ সব জায়গায় পৌঁছে গেল, রিজিয়িন কমান্ডার অনুমতি দিলেন চাঁদাবাজ ‘ড্রাগনের মাথা কাটার’।

কিন্তু সে কাজটা তো আর খুব সহজ ইন্সট্যান্ট নুডুলস নয়; তাছাড়া ‘আমি চাঁদাবাজ’ বা ‘আমি চাঁদা দেই’ এটা কারো গায়েই লেখা থাকে না। পানছড়ির ব্যবসায়ীরা খুব একটা উৎসাহী নয় এসব নিয়ে অভিযোগ করতে বা কোনো বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে। তারা আমাদের দেখে এভাবে,
‘আর্মির লোক চাকরি করতে এসেছে, ৬ মাস ১ বছর পর চলে যাবে। আজ যিনি চাঁদাবাজ ধরতে খুবই উৎসাহী, কাল তিনি চলে যাবেন। নতুন যিনি আসবেন, তিনি পূর্বজনের মতো উৎসাহী নাও হতে পারেন। দিন শেষে পাহাড়িদের সাথেই তো তাদের থাকতে হয়।’

কিন্তু আমার বুকে তখনও মাছের কাঁটা। তাই একদিন ভাইবোন ছড়া ক্যাম্পের পোস্ট থেকে কলা বোঝাই একটা চান্দের গাড়িতে উঠে পড়ি দু’জন সৈনিককে সাথে নিয়ে। চালকের বামপাশে বসে ডান হাতের পিস্তল ওর কোমরে ঠেকিয়ে শীতল কণ্ঠে বলি, ‘চালাকি করবি না, নরমাল গাড়ি চালাবি, পথে কেউ সিগনাল দিলে গাড়ি থামাবি।’

চালকের মুখচ্ছবিতে স্পষ্ট আশংকার ছাপ, আমাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে সে বলতে লাগলো, ‘স্যার, এখন হয়তো আমাকে ওরা ছেড়ে দেবে, কিন্তু ওদের কোনো ক্ষতি হলে তো আমাদের ডেকে নিয়ে আরো বেশি জরিমানা করবে!’ আসন্ন উত্তেজনার কথা ভেবে ওর এই কথাকে আমলে না নিয়ে চালকের গাড়ি চালনার ধরন এবং সড়কের পাশে সম্ভাব্য চাঁদাবাজের উপস্থিতি নজরে পড়ে কিনা সেই ভাবনায় নিমজ্জিত থাকলাম। ভাইবোন ছড়া ক্যাম্প থেকে ৫ কিলো যেতেই রাস্তার বাঁকে একটা ২০/২২ বছরের তরুণকে দেখা গেল, পরনে টি-শার্ট আর হাফপ্যান্ট। হাফপ্যান্টের উপর একটা গামছা জড়ানো।

‘এটা নাকি, এটা নাকি?’ আমার গলায় উত্তেজনা। চালক না শুনার মতো করে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলো। আমি ওকে থামাতে বলি। গাড়ি থামাতে থামাতেই ওকে অতিক্রম করে গেলাম। ভুলটা এখানেই হলো। ছেলেটা আমাদের গাড়ি থেকে নামা দেখলো। আমি ওকে হাতের ইশারায় ডাকলাম।

কোমরে সাঁটা পিস্তলের দিকে হাত বাড়াতেই সুন্দর বনের চিত্রা হরিণের মতো উল্টো ঘুরে ভোঁ দৌড়। আমি লাফিয়ে পড়লাম পাশের ক্ষেতে। নরম মাটিতে পা গেল দেবে, মুখ থুবড়ে পড়লাম পিস্তলটার নলে মাটি লেগে গেল। তখনই বুঝলাম, ছেলেটা আজ বোধহয় লাইফ পেয়ে গেল। আমি পিস্তল দিয়ে ফায়ার করার আগেই সে একটা দূরত্ব তৈরি করে ফেললো আমাদের মাঝে। এটা তার অনুকূলে গেলো।

এর ফলে ১, ২, ৩ করে ম্যাগজিনটাই খালি হয়ে গেল, তবু ওর গতি রোধ করা গেল না। সে দৌড়াচ্ছে ওসাইন বোল্টের মতো, পাড়ার ঘরের চিপা দিয়ে, টেংরা বেড়াগুলোকে অ্যাথলেটদের হার্ডেলস পার হওয়ার মতো করে অতিক্রম করে চেঙ্গী নদীর খাড়া পাড়ে লাফিয়ে পড়লো।

পাড়ে দাড়িঁয়ে শিকার হারানো চিতার মতো হাঁফাতে হাঁফাতে বালুর মধ্যে কুন্ডলী পাকিয়ে ওর গড়িয়ে পড়া দেখা ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিলো না। কারণ, ততক্ষণে পিস্তলের আটটি গুলিই শেষ।

আমার এই ব্যর্থ অভিযানের কথা শুনে সদ্য বঙ্গভবন থেকে বদলী হয়ে আসা প্রেসিডেন্টের এডিসি মেজর জাহাঙ্গীর পরবর্তী অভিযানে আমার সাথে শামিল হতে চাইলো। একদিন সকালে কার কাছ থেকে যেন একটা মোটর বাইক ধার করে আমার ক্যাম্পে এসে হাজির। এসেই বলল, ‘চলেন স্যার, আজ এইটা দিয়ে কোনো একটা চান্দের গাড়ি ফলো করবো, পিছনে টাইম গ্যাপ দিয়ে একটা পিক-আপ থাকবে। আমাদের ‘ইন কেস ইমার্জেন্সি’ সাপোর্ট দেবে।

শুরু হলো পথ চলা, আজও কলা বোঝাই একটা চান্দের গাড়িকে দূর থেকে ফলো করছি। শিব মন্দিরের কাছে আসতেই দেখলাম, কলার গাড়িটা থামছে, কিছু একটা বিনিময় হচ্ছে। মোটর বাইকের স্পিড বাড়িয়ে ওর কাছে থামতেই ‘ওসাইন বোল্ট’ টেক অফ করলো। আজ ওকে কিলিং রেঞ্জের মধ্যে পেলাম। কিন্তু আমি তো আর ওসি প্রদীপ না যে, মাত্র ২শ’ টাকা চান্দার জন্য ‘একটাকে ডাউন করবো!’ আর তা ছাড়া ও পালাচ্ছে বাড়ি-ঘরের ফাঁক দিয়ে। এই অবস্থায় গুলি করলে, সেটা অন্য কারো গায়েও লাগতে পারে।

আমার লেগ ম্যাসলের উপর ভর করে ওর পিছু নিলাম। আঁকাবাঁকা সর্পিল পথে জীবন নিয়ে পালাচ্ছে পাহাড়ি ‘ওসাইন বোল্ট’। এভাবে দ্রুত ধাবমান মানুষকে শর্ট ব্যারেল অস্ত্র দিয়ে থামানো তো কঠিন কাজ, যখন নিজেও দৌড়ের উপর আছি। ওসব সিনেমায় সম্ভব, ক্লিন্ট ইস্টুডও এই ‘ওসাইন বোল্ট’কে লক্ষ্যভেদ করতে পারবে না। ৬ রাউন্ড শেষ করে আমিও ওকে থামাতে পারলাম না।

আমার হতাশার বিষয়টি টের পেয়ে, জাহাঙ্গীর খোচা দিলো, ‘স্যার, ও দৌড়াচ্ছে জীবন নিয়ে, আমি আপনি দৌড়াচ্ছি পয়েন্টের জন্য, ভাগ্য খারাপ না হলে ওদের থামানো যাবে না।’ কিন্তু দ্বিতীয় বার ব্যর্থ হওয়ার পরও মনের মধ্যে রবার্ট ব্রুস ভর করে বসলো, একবার না পারিলে দেখ শত বার।

তৃতীয় প্রচেষ্টায় জাহাঙ্গীর গরুবাহী ট্রাকের পিছনে লুকিয়ে থাকলো গরু ব্যবসায়ীর বেশে। সাথে নিলো বাটখোলা এসএমজি। সেদিনও ৩নং রাবার বাগানের কাছে ওরা একইভাবে পালিয়ে বাঁচলো। জাহাঙ্গীর এসএমজির ১৩ রাউন্ড খরচ করেও কাউকে আটকাতে পারেনি। আমাদের ধারাবাহিক অভিযানে চাঁদাবাজরা দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে, কিন্তু চাঁদা আদায় পুরোপুরি বন্ধ হলো না।

আমরাও মোড অফ অপারেশন পরিবর্তন করে দিনের পরিবর্তে রাতে চলাচলকারী গাড়িতে স্ট্রিং অপারেশন চালানোর সিদ্ধান্ত নেই। এবার অপারেশনের দিক পরিবর্তন করে খাগড়াছড়ি থেকে পানছড়ি অভিমুখী খাতুনগন্জ থেকে আসা মুদিমালের ট্রাকে চড়ে বসি।
তৎকালীন বিডিআরের সহায়তায়, আরপি আমাদের একটা মালবাহী ট্রাকে উঠিয়ে দেয়। রাত দশটায় শিবমন্দির ভয়ংকর রকম নিরব, পাশেই শ্মশান ঘাট। একটা গা ছমছম করা পরিবেশ। এখানেই একজনকে টর্চ হাতে দাড়িঁয়ে থাকতে দেখলাম। ট্রাকের হেডলাইট দেখে ওকেও বার কয়েক টর্চের আলো ফেলতে দেখা গেল।

এখানেও ট্রাক চালক গাড়ি না থামিয়ে সোজা যেতে থাকলে, এতক্ষণ পানছড়ি নিবাসী বাঙালীর পরিচয় ছুঁড়ে ফেলে রুদ্ররূপে আত্মপ্রকাশ করি, ‘থাম শালা’! আমার সহকারী ট্রাকের পিছন থেকে নামার সময় চাদরে ঢাকা এসএমজির অবস্থানকে উন্মোচন করে দেয়।
ব্যাস, আমি ট্রাকের কেবিন থেকে নেমে দু’কদম ওর দিকে এগুতেই অস্ত্র ভর্তি ব্যাগ আর টর্চ ফেলে অন্ধকারে চেঙ্গী নদীর ঢালে লাফ দেয়।
একই কায়দায় লাফ দিয়ে আমাদের আর বীর শ্রেষ্ঠ হওয়ার খায়েশ হলো না। নদীর পাড়ে এসে ওর পলায়ন পথে এসএমজির একটা শর্ট ব্রাস্ট করে একটা মেসেজ দিলাম, ‘চাঁদাবাজী কর, তবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কর।’

আমাদের ৬ষ্ঠ অভিযানে এবার টার্গেট করি পানছড়ি থেকে খাগড়াছড়ি অভিমুখী ট্রাকগুলোকে। এবার নিজেই ট্রাকের চালকের আসনে বসে যাই। তার আগে অবশ্য দুই দিন ইউনিটের প্রশিক্ষণ মাঠে নিজেদের লরিগুলো চালিয়ে একটু হাত ঝালাই করে নিই। গাড়ি চালকরা এসব অভিযানে আন্তরিক সহযোগিতা করে না, তার প্রমাণ পেয়েছি। ওরা চাঁদাবাজদের নানাভাবে সিগনাল দিয়ে সতর্ক করে দেয় বলেই আমার বিশ্বাস। যেমন: যেখানে হর্ন দেওয়ার দরকার নেই, সেখানে হর্ন দেওয়া, গাড়ির ডিপার ব্যবহার করে জানান দেওয়া যে গাড়িতে বিপদ আছে, জায়গা মতো না থেমে আগে পিছনে থামা, তো এসব অসহযোগিতা দূর করতে দরকার ছিল নিজস্ব ড্রাইভার। সে কারণেই নিজেকেই বসতে হয়েছিল ড্রাইভিং সিটে।

পানছড়ি বাজার থেকে ছেড়ে যাওয়া একটি ট্রাককে টার্গেট করলাম। একটি ফাঁকা জায়গায় ট্রাককে থামিয়ে সেটার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলাম। পেছনে থেকে যায় আমাদের ফলো করা সাপোর্ট টিম। ওরা আমাদের ১০ মিনিটের টাইম গ্যাপে ফলো করবে। পেরাছড়ার আনসার ক্যাম্পের কাছে চিকন একটি বেলি ব্রিজের কাছে আসতেই সাইকেল আরোহী এক তরুণকে কাছে আসতে দেখি। সুঠাম দেহী খালী গা, যাদের দেখে আমারা কাছে ওসাইন বোল্টের কাজিন বলে মনে হয়। সে ব্রিজের ওপার থেকে এক হাত উঁচু করে থামার সিগনাল দেয়। যার মানে হলো, ট্রাক যেন ব্রিজে না উঠে। আমি তার সিগনাল অমান্য করে লোহার ব্রিজের উপর উঠিয়ে থামাই। নিশ্চিত হতে চাই, ওটা চাঁদাবাজ কিনা, না, এমনি হাত উঠিয়েছে চিকন ব্রিজ আগে ক্রস করবে বলে। ট্রাকের রিয়ার ভিউ মিররে চোখ গেল, দেখলাম, সে সাইকেল ঘুরিয়ে এদিকে আসছে। আমার সন্দেহ গাঢ় হলো। নিরেট গ্রামবাসী হলে তো তার গন্তব্যে যাওয়ার কথা। ফিরে কেন আসছে? আমার সহযোদ্ধাকে ইংগিত করতেই সে বাম পাশ দিয়ে নেমে গেল। পাশে থাকা গাড়ির অরিজিনাল চালককে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বদ্দা, ইবা হন?’ চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির বাসিন্দা এই চালক আমার মুখে চাঁটগাইয়া ভাষা শুনে মৃদু হেসে জবাব দিলো, ‘যাকে আপনার খুঁজেন’।

‘ওসাইন বোল্টে’র কাজিন সরু ব্রিজ এবং ট্রাকের মাঝের ফাঁকা অংশে সাইকেলসহ প্রবেশ করে ট্রাকের দরজা বরাবর এসে থামে। আমি দরজা খুলে তার দিকে তাকাই। সে জানতে চায়, ‘গাড়িতে কি মাল?’

আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার বলল, ‘৫০০ টাকা দেন।’
আজ আমার দিন, গাড়ির ভিতর বসা অবস্থায়ই ১০০ কেজি ওজনের একটা লাথি ওর কাঁধ বরাবর দিলাম। নিজেকে তখন জ্যাকি চ্যান মনে হলো। ওসাইন বোল্ট বনাম জ্যাকি চ্যান। দীর্ঘদিন পর আন আর্মড কোর্সে শেখা কিছু কৌশলের বাস্তব প্রয়োগের জন্য টার্গেট পেলাম। ব্রিজের রেলিং থাকার কারণে লাফিয়ে পড়ে পালানোর সুযোগ আজ আর নেই। চেঙ্গী নদীর পাড় আজ অনেক দূরে।

কয়েক মিনিট পরেই আমাদের সাপোর্ট টিম হাজির হলো। যদিও চাঁদাবাজীর জগতে সে নিতান্তই একটি পুঁটি মাছ, তবু ওকে ধরার মধ্যে একটা শুভ সূচনা হলো মনে করে সাময়িক তৃপ্তির ঢেকুর তুলে রওনা হই জোন সদরের দিকে।

ওর কাছ থেকে জানা গেল যে, সে এখানকার মূল কালেক্টর না। ইউপিডিএফের শিবমন্দির পোস্টের চিফ কালেক্টর রিকল চাকমার নাম। সারা দিনের সব রেভেনিউ রিকল চাকমার কাছেই জমা হয়। আমাদের টার্গেট দৈনিক খোরাকী বাবদ পায় মাত্র ২/৩’শ টাকা। তার মূল পেশা গাছ-বাঁশ কাটা। চাঁদা কালেকশন তার সাইড বিজনেস। রিকল চাকমা স্থানীয় ছোট খাটো বিবাদ-মীমাংসার কোর্টেরও বিচারক।

আমার জিজ্ঞাসাবাদের মূল আগ্রহ রিকল চাকমা সম্পর্কে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করতে থাকি। তার সম্পর্কেই বেশি জানতে চাই, রিকল কেমন দেখতে, কী কাপড় পড়ে, দৈহিক গড়ন কেমন, ওকে দেখলে কেমন করে চেনা যাবে ইত্যাদি। বিভিন্ন কথার ফাঁকে সে রিকলের দৈহিক বর্ণনা দিতে গিয়ে অসাবধানতার বশে বলে ফেলে, ‘রিকল চাকমার ডান চোখটি টেরা আর পরনে থাকে সাদা চেক শার্ট, পকেটে একটা সবুজ রংয়ের কলমও থাকে।’

মনের মধ্যে টুং করে বেল আইকনটা বেজে উঠে, ‘টেরা চোখ’ মানে ‘লক্ষী টেরা’! পাইছি তোমারে!! এতো বড় আইডেন্টিটি মার্ক তো সে লুকাতে পারবে না। রিকল জনসম্মুখেই থাকে, সেনাটহল দেখলেও পালিয়ে যায় না। কারণ, সে জানে, কোনো পাহাড়ি তার পরিচয় বলে দেবে না। আর বলে দিলেই কী! সে অস্বীকার করবে, সে তো প্রকাশ্যে অস্ত্র বহন বা প্রদর্শন করে না। ওটা তার দরকারও নেই। চাঁদা তুলতে তাকে অস্ত্র ব্যবহার করতে হয় না।

এই লক্ষী টেরাকে ধরার জন্য শুক্রবার জুমার নামাজের আগ মুহূর্তটি বেছে নেই। সাধারণত এই দিনের এই সময়ে সেনাটহল থাকে না, সবাই নামাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে বলে। একটা পিকাপে ক্যাম্পের সিনিয়র জেসিওকে পাঠাই লক্ষী টেরার খোঁজে। নামাজ শেষে মসজিদের বাইরে আসতেই আরপি সংবাদ দিলো, ‘লক্ষী টেরা ধরা পড়েছে, এখন রেজামনি ক্যাম্পে আছে।’

লক্ষী টেরার কাছে পাওয়া যায় বিভিন্ন পোস্টের দায়িত্বপ্রাপ্তদের নাম, বিভিন্ন তারিখে তোলা চাঁদার তথ্য এবং তার ব্যক্তিগত অস্ত্রের খোঁজ । সেই সময় লক্ষী টেরাকে খাগড়াছড়ি সদরে চালান করার ফলে শিব মন্দির এলাকায় শিবের আশীর্বাদক্রমে যেন শান্তি নেমে এলো কয়েক দিনের জন্য।

স্ট্রিট উইদাউট জয় কিছু দিনের জন্য স্ট্রিট উইদাউট ভয় হিসেবে জনমনে স্বস্তি নিয়ে আসে।

ফরাসী বাহিনীর ১৩ দিনের বিশেষ অভিযান, ‘অপারেশন কামারগু (Camargue)’ শেষ হওয়ার পর ভিয়েতনামের গেরিলারা পুনরায় ঐ এলাকার দখল নিয়ে নেয়। পানছড়িতেও এখন নতুন নতুন লক্ষী টেরার আবির্ভাব হয়েছে। মাঝে মাঝেই তারা নিজেদের মধ্যে খুনাখুনিতে লিপ্ত হয়, চাঁদাবাজির এই সোনার খনির দখল নিতে। সেসব খবর এখন পড়ি নাান গণমাধ্যমের খবরে। আর চিন্তা করি,

‘পানছড়ি টু খাগড়াছড়ি এখনো স্ট্রিট উইদাউট জয় হিসাবেই আছে।’

 লেখকের আরো লেখা পড়ুন:

পানছড়ির জীবনম্বয়ীর মতো কত পাহাড়ি তরুণীর স্বপ্ন যে ভেঙে যাচ্ছে তার হিসাব কেউ জানে না

দিনের আলোয় বিদ্বেষ ছড়ালেও রাতে সেনাবাহিনীর কাছে নিরাপত্তা চাইতেন জেএসএস নেতা

ইউপিডিএফ ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে গেল আজকের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে

পাহাড়ের লাভ জিহাদ এবং ধর্মান্তকরণের ফ্যাক্ট ও মিথের চিত্র

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন