পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৩ হাজার উপজাতীয় সন্ত্রাসীর হাতে ৩ হাজার ভয়ানক আগ্নেয়াস্ত্র

পার্বত্যনিউজ রিপোর্ট :

পার্বত্য চট্টগ্রামে চারটি উপজাতীয় আঞ্চলিক সংগঠনের সশস্ত্র গ্রুপের রয়েছে আর্ম ক্যাডার ও সেমি আর্ম ক্যাডার বাহিনী। এর মধ্যে আর্ম ক্যাডারের সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। অন্যদিকে সেমি আর্ম ক্যাডারের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। সেমি আর্ম ক্যাডাররা অস্ত্র প্রশিক্ষিত। তারা ভবিষ্যতে সংগঠনগুলোর জন্য কাজে লাগে।

এসব সন্ত্রাসীদের কাছে তিন হাজারের বেশি আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। সেখানে পুরনো অস্ত্রের পাশাপাশি নতুন এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রও রয়েছে। এসবের মধ্যে আছে এম ১৬ রাইফেল, মিয়ানমারে তৈরি এম ১ রাইফেল, একে ৪৭ রাইফেল, একে ২২ রাইফেল এবং এলএমজি (লাইট মেশিনগান), হেভি মেশিনগান, জি-৩ রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল ইত্যাদি ভয়ঙ্কর স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র। প্রতিবেশী দুইটি দেশ থেকে তারা এই অস্ত্র, গুলি ও প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অস্ত্র আসছে। মাঝে মাঝে কিছু ধরা পড়লেও তা খুবই সামান্য। উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের হাত ঘুরে এসব অস্ত্রের একটি অংশ সমতলের জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের হাতেও চালান হচ্ছে বলে জানা গেছে।

সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি কিছু লোক ধর্মীয় নেতার পরিচয়ের আড়ালে অস্ত্র পাচারের সাথে জড়িত রয়েছে। এরকম কিছু ধর্মীয় লেবাসধারী নেতা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরাও পড়েছে। গোয়েন্দারা খোঁজ নিয়ে জেনেছে, তারা বাংলাদেশি নয়। বাংলাদেশের পরিচয়পত্র তাদের হাতে নেই। গহীন অরণ্যে রয়েছে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।তারা স্বীকার করেছে, মিজোরাম সীমান্ত এলাকা দিয়ে পাহাড়ি চারটি সশস্ত্র গ্রুপ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও গ্রেনেড এনে মজুদ করছে।

শান্তিচুক্তি অনুযায়ী পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা অস্ত্র জমা দিলেও পরে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, তারা তিনভাগের একভাগ অস্ত্র জমা দিয়েছে। যা জমা দিয়েছে তাও পুরোনো, ভাঙাচোরা, অচল ও সেকেল। নতুন ও অত্যাধুনিক অস্ত্র জমা দেয়নি। অন্যদিকে শান্তিবাহিনীর একটি অংশ এই চুক্তি না মেনে অস্ত্র জমাদান করেনি। মূলতঃ সরকারের উপর আস্থা স্থাপন না করা ও পরবর্তীকালে প্রেশার গ্রুপ হিসাবে কাজ করার জন্য কৌশলের অংশ হিসাবে শান্তি বাহিনী একটি অংশকে অস্ত্র সমর্পনের বাইরে রেখে দেয় চুক্তি বিরোধী হিসাবে। পরবর্তীতে নানা কারণে তাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। সশস্ত্র গ্রুপগুলোর চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার এবং নির্বাচনের বছরে রাজনৈতিক কারণে হানাহানিতে এসব অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পুলিশসহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সাথে চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত বান্দরবান, বাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে সশস্ত্র সংগঠনের হাতে ১৩০জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও ৮৫জন বাঙালী নিহত হয়েছে। এ সময় আহত হয়েছেন ২২৩জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও ৫৫১জন বাঙালী। অপহরণের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৪০০ ও গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে ১৩০টি। প্রায় ৫০০টি অস্ত্র ও ৭ হাজার গুলি উদ্ধার করা হয়েছে।

গত ১৮ এপ্রিল পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকৃত অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে, ২ টি ৭.৬২ মিঃমিঃ এসএমজি, ১ টি এ্যাসল্ট রাইফেল, ২ টি পিস্তল, ১৬ রাউন্ড এ্যামোনিশন, ২ টি এসএমজির ম্যাগাজিন, ১ টি এ্যাসল্ট রাইফেলের ম্যাগাজিন, ২ টি পিস্তলের ম্যাগাজিন ও ১ টি সিলিং। ১৮ এপ্রিল ভোর ৪ টায় রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার বালুখালী ইউনিয়নের কাইন্দা এলাকায় সন্ত্রাসীদের গোপন আস্তানায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত একটি বিশেষ অভিযান এ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।

জানা গেছে, গত ৬ মাসে পাহাড়ে ৫২ সশস্ত্র হামলা ও অপহরণ হয়েছে। মিয়ানমারের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাথে পাহাড়ের সশস্ত্র গ্রুপের এক শীর্ষ নেতার ফোনালাপের ঘটনায় পার্বত্য অঞ্চলে তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়েছে। মিয়ানমারের ওই শীর্ষ ব্যক্তি পাহাড়ের সশস্ত্র গ্রুপের ক্যাডারদের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নেটওয়ার্কে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

ওই সূত্রগুলো জানিয়েছে, সন্ত্রাস দমনে পার্বত্যাঞ্চলে নিয়োজিত সেনাবাহিনী যথেষ্ট তৎপর থাকলে শান্তিচুক্তির পর সেখানে তাদের অবস্থান ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ করে সরকার হাত পা বেঁধে দিয়েছে। পুলিশ ছাড়া সেনাবাহিনী সেখানে কোনো অপারেশনে যেতে পারে না। কিন্তু আগে থেকে পুলিশ জেনে যাওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে সন্ত্রাসীরা আগাম তথ্য পেয়ে যাচ্ছে।

এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলোকে ৫৫২টি সেনা ক্যাম্পের মধ্যে ৩৩৪টি ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। বর্তমানে ২১৮টি ক্যাম্প রয়েছে। বেশিরভাগ ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেয়ায় সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে দুর্গম খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি রোডের থেকে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেয়ায় বিশাল অংশ সশস্ত্র ইউপিডিএফের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এরই একটি অংশে ৫ মে ঘটে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড।

সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেয়ার পর থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে খুন, অপহরণ, দখল ও চাঁদাবাজি ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। শান্তিপ্রিয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও বাঙালীরা চাঁদা দিয়েও এখন আর শান্তিতে বসবাস করতে পারছেন না। প্রতিটি মুহুর্ত তাদের কাটছে নিরাপত্তাহীনতায় মধ্যে। বিস্তার ঘটেছে ভয়াবহ চাঁদাবাজীর নেটওয়ার্ক। বছরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে থাকে এই উপজাতীয় সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো। চাঁদা না দিয়ে সেখানে কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা এমনকি বসবাসও সম্ভব নয়। এই চাঁদাবাজী, আধিপত্য বিস্তার ও রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার বলি হচ্ছে পাহাড়ী, বাঙালি নির্বিশেষে পাহাড়ের সাধারণ মানুষ।

সম্প্রতি এক দিনের ব্যবধানে নানিয়ারচরে ঘটে যাওয়া ৬ হত্যাকাণ্ডের কারণও এই চাঁদাবাজী, আধিপত্য বিস্তার ও রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা। জেএসএস সংস্কার নেতা সুদর্শন চাকমা আগামী নির্বাচনে প্রার্থি হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি নির্বাচনে দাঁড়ালে স্থানীয় একটি আঞ্চলিক সংগঠনের জন্য ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি হতো। বিশেষ করে নানিয়ারচর ও বাঘাইছড়িতে তারা নির্বিঘ্নে নির্বাচনী কার্যকলাপ পরিচালনা করতে পারতো না। অন্যদিকে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক ও জেএসএস সংস্কার মিলে খাগড়াছড়িতে প্রার্থী দিলে মহালছড়ি, দিঘীনালায় ইউপিডিএফ (প্রসীত) নির্বাচনে প্রবল বাঁধার সম্মুখীন হতো। বর্তমানে জেএসএস মূল ও ইউপিডিএফ মূলের মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতার সূত্রে সিজ ফায়ার রয়েছে বলে স্থানীয়ভাবে প্রচার রয়েছে।

হঠাৎ করে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ায় তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারে শিগগিরই যৌথ অভিযান চালানো প্রয়োজন বলে স্থানীয় শান্তিপ্রিয় সাধারণ বাঙালী ও ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠীর লোকজন মনে করেন।

খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির একাধিক স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে বিপুল পরিমান চাঁদার টাকা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। চাঁদা আদায় এবং এলাকার নিয়ন্ত্রণ রাখতেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে পাহাড়ে।

১৯৯৭ সালে জনসংহতি সমিতির সঙ্গে (জেএসএস) শান্তিচুক্তির পর পাহাড়ে শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করে। এর এক বছরের মাথায় চুক্তির বিরোধিতা করে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে গঠিত হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। মূলত তার পরেই পাহাড়ে আবারও আধিপত্য বিস্তারে রক্তের খেলা শুরু হয়।

এরপর ২০০৭ সালে জেএসএস থেকে বেরিয়ে রূপায়ণ দেওয়ান-সুধাসিন্ধু খীসাদের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা)। এতদিন ইউপিডিএফ ও জেএসএস (এম এন লারমা) দুই সংগঠন অনেকটা এক হয়ে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিল। কিন্তু গতবছরে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে আত্মপ্রকাশ করে পাহাড়ের চতুর্থ আঞ্চলিক দল। মূলত এই চার সংগঠনের ক্ষমতার বিস্তার, চাঁদাবাজি ও আধিপত্যের দ্বন্দ্বে আবারও অশান্ত হয়ে উঠেছে পাহাড়।

গত এক দশকের পাহাড়ে আঞ্চলিক রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ইউপিডিএফের আধিপত্য খাগড়াছড়িতে বেশি। বালাঘাটা ও নাইক্ষ্যংছড়ির কিছু এলাকা বাদে বান্দরবানে আধিপত্য বেশি জেএসএসের। তবে রাঙামাটির বিশাল এলাকায় এক সময় ই্উপিডিএফ আধিপত্য বিস্তার করলেও বর্তমানে তাদের অবস্থান সঙ্কুচিত হয়ে বাঘাইছড়ি, নানিয়ারচর ও কাউখালীর কিছু এলাকায় সীমিত রয়েছে। বাকি অংশ জেএসএস লারমা ও কিছু অংশ সংস্কারের দখলে রয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, তিন পার্বত্য জেলার পরিস্থিতি হঠাৎ করেই জটিল হয়ে উঠছে। আঞ্চলিক দলগুলোর নেতৃত্বে চার ভাগ হলেও তৃণমূল পর্যায়ে এ বিভক্তি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।

পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়া এই সহিংসতার কারণ বিশ্লেষণ করলে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা রিপোর্টে থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে পার্বত্য চুক্তির (শান্তি চুক্তি) ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিক না এমন অভিযোগ এনে ‘পাহাড়ে আগুন জ্বলবে’ বলে হুঁশিয়ারি দেন। এরপরই ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর ইউপিডিএফ সমর্থিত অনাধি রঞ্জন চাকমা (৫৫) নামের নানিয়ারচর উপজেলার সাবেক এক ইউপি সদস্যকে হত্যা করার মধ্যে দিয়ে পাহাড়ে হত্যাযজ্ঞের সূত্রপাত ঘটে। এ হত্যার জন্য ইউপিডিএফ প্রসিত গ্রুপ গণতান্ত্রিককে ইউপিডিএফতে দায়ী করে।

একই দিন রাঙামাটির জুরাছড়িতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অরবিন্দ চাকমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আওয়ামী লীগ এ হত্যাকাণ্ডের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিকে (পিসিজেএসএস) দায়ী করে। একই দিন বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রাসেল মার্মাকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়।

৭ ডিসেম্বর রাঙামাটি শহরের বিহারপুর এলাকায় জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সহ-সভানেত্রী ঝর্ণা খীসার বাসায় হামলা করে সন্ত্রাসীরা। এসময় তাঁকে হত্যা করতে কুপিয়ে জখম করা হলেও প্রাণে বেঁচে যান তিনি।

বিলাইছড়ি আ’লীগ নেতাকে কোপানোর অভিযোগে সেখার উপজেলার চেয়ারম্যান ও পিসিজেএসএস উপজেলা শাখার নেতা শুমঙ্গল চাকমাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এ ঘটনায় চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির নেতা শুভমঙ্গল চাকমাসহ কয়েকজনকে আটকও করা হয়। পরে তারা জামিনে মুক্তি পায়।এসময় প্রাণভয়ে জুড়াছড়ি, বিলাইছড়ি ও বাঘাইছড়ি উপজেলার আওয়ামী লীগ ও তার অংগসংগঠনগুলোর পাহাড়ী নেতাকর্মীরা দলে দলে পদত্যাগ করে উপজেলাগুলো প্রায় শাসকদল শুন্য হয়ে পড়ে। জেএসএসের হুমকির কারণেই এ ঘটনা ঘটে বলে আওয়ামী লীগের অভিযোগ।

১৫ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার বন্দুকভাঙ্গা ইউনিয়নের ধামাইছড়া গ্রামে প্রতিপক্ষের গুলিতে ইউপিডিএফ নেতা অনল বিকাশ চাকমা প্লাটো ওরফে লক্ষী নিহত হয়। ইউপিডিএফ এ হত্যাকাণ্ডের জন্য ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক বার্মা গ্রুপকে দায়ী করেছে।

সর্বশেষ ২১ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটির বন্দুকভাঙ্গা ইউনিয়ন থেকে ৫ ইউপি মেম্বারসহ ২০ জনকে অপহরণ করা হয়। একদিন পর তারা নিজ গ্রামে ফিরে আসে।

এদিকে চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি বিলাইছড়ি উপজেলায় যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিশ্বরায় তঞ্চাঙ্গ্যাকে হত্যার উদ্দেশ্য গুলি করা হলেও তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এ ঘটনার জন্য যুবলীগ সন্তু গ্রুপ জনসংহতি সমিতিকে দায়ী করেছিল।

৩০ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী মহাসমাবেশে অংশ নেওয়ায় বিলাইছড়িতে আওয়ামী লীগের তিন কর্মীকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করা হয়। এ ঘটনার জন্য সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতিকে দায়ী করেছিল আওয়ামী লীগ।

১২ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটি শহরে ছাত্রলীগ নেতা সুপায়ন চাকমাকে মারধর করে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কর্মীরা। প্রতিবাদে রাঙামাটিতে হরতাল পালন করে ছাত্রলীগ।

১১ মার্চ বাঘাইছড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয় ইউপিডিএফের কর্মী নতুন মনি চাকমাকে। ওই দিন রাতে নিজ বাড়িতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে নতুন মনি চাকমাকে হত্যা করা হয়। তাঁর মাথাসহ সারা শরীরে কোপানো হয়। তিনি ইউপিডিএফের প্রসিত বিকাশ খীসা পক্ষের কর্মী ছিলেন।

১৮ মার্চ রাঙামাটির কুতুছড়ি থেকে অপহরণ করা হয় ইউপিডিএফ সমর্থিত হিল উইমেন্স ফেডারেশন নেত্রী মন্টি চাকমা ও দয়াসোনা চাকমাকে। ৩২ দিন পর ১৯ এপ্রিল মুক্তি দেওয়া হয় তাঁদের। এ ঘটনার জন্য ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফকে দায়ী করেছে।

১২ এপ্রিল পাল্টাপাল্টি হামলায় মারা যান তিনজন। রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলায় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) এক সদস্যকে গুলি করে হত্যার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিরও (এম এন লারমা) দুই কর্মীকে হত্যা করা হয়। নিহতরা হলেন ইউপিডিএফের কর্মী জনি তঞ্চঙ্গ্যা (৪০), জনসংহতি সমিতির (এম এন লারমা) কর্মী পঞ্চায়ন চাকমা ওরফে সাধন চাকমা (৩০) ও কালোময় চাকমা (২৯)।

গত ১৭ এপ্রিল রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের মারিশ্যা-দিঘিনালা সড়কের জোড়া ব্রিজ এলাকায় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) কর্মী তপন চাকমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি সীমান্তবর্তী বাঘাইছড়ি উপজেলার মারিশ্যা-দিঘিনালা সড়কের ৮-৯ কিলো নামক স্থানে ইউপিডিফের আরেক কর্মী বিজয় চাকমাকে (৩২) হত্যা করে প্রতিপক্ষ।

এরপর চলতি বছরের এপ্রিলের ২০ তারিখ থেকে ইউপিডিএফ তাদের আধিপত্য বিস্তারে রাঙামাটির দূর্গম বাঘাইছড়ি উপজেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সংস্কার’র (জেএসএস এমএন লারমা গ্রুপ) এলাকায় হানা দেওয়া শুরু করে। তাদের তান্ডবে ওইদিন উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে জনপ্রতিনিধিসহ ৫০পরিবার পালিয়ে এসে উপজেলা শহরে এসে আশ্রয় নেয়।

অপরদিকে চলতি মাসের ২ মে সকালে একই উপজেলার রূপকারী ইউনিয়নের নালকাটা এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপ এবং জেএসএস সংস্কার বন্দুক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তবে উভয়পক্ষের মধ্যে কেউ হতাহত হয়নি।

৩ মে নানিয়ারচর উপজেলায় নিজ কার্যালয়ের সামনের সময় গুলি করে হত্যা করা হয় নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এম এন লারমা) অন্যতম শীর্ষ নেতা শক্তিমান চাকমাকে। এই সময় তাঁর সঙ্গে থাকা সংগঠনটির আরেক নেতা রূপম চাকমা গুলিবিদ্ধ হন।

এর একদিন পরই ৪ মে শক্তিমান চাকমার দাহক্রিয়ায় অংশ নিয়ে চলে যাওয়ার সময় সশস্ত্র হামলায় নিহত হন ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিকের শীর্ষ নেতা তপন জ্যোতি চাকমা বর্মা, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এম এন লারমা) নেতা সুজন চাকমা, সেতুলাল চাকমা, তনয় চাকমা। এ সময় আহত হয় আরো নয়জন। একই সময় খাগড়াছড়িতে ৭ জনকে খুন করা হয়েছে এবং অনেককে অপহরণ করা হয়েছে।

শক্তিমান ও বর্মার উপর ভয়াবহ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে ব্রাশফায়ার করেছিল সন্ত্রাসীরা। দূর্গম সীমান্তের কারণে খুব সহজেই সন্ত্রাসীদের হাতে এ ধরণের মারণাস্ত্র চলে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সীমান্তের ৮৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো সীমান্তচৌকি (বর্ডার আউটপোস্ট-বিওপি) নেই। ফলে সেখানে বাধাহীনভাবে অস্ত্র ঢুকতে পারে। তাছাড়া শান্তিচুক্তি সই করার পর চুক্তি বাস্তবায়নের শর্ত মোতাবেক বেশকিছু নিরাপত্তা ফাঁড়ি প্রত্যাহার করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাহাড়ি সীমান্তে পর্যাপ্ত রাস্তা না থাকায় উন্মুক্ত সীমান্তে বিওপি স্থাপন করা যাচ্ছে না। কেননা বিওপি স্থাপন করতে হলে তার নিরাপত্তার প্রয়োজনে যোগাযোগ জরুরি। বর্তমান অবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামে এমন দুর্গম স্থানও রয়েছে, যেখানে কোনো সশস্ত্র হামলা হলে নিরাপত্তা বাহিনীর পৌঁছতে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগে যায়।

পার্বত্যাঞ্চলের যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে তাতে অভিজ্ঞ মহলের মতে, নির্বাচন যতো এগিয়ে আসবে এই সংঘাত ততোই বৃদ্ধি পাবে। সেকারণে সরকারকে এখনই তৎপর হতে হবে। তাদের মতে, দ্রুততার সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাস নির্মূলে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশের নেতৃত্বে যৌথ অপারেশন পরিচালনা করে সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতায় সন্ত্রাসীদের ভয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা মামলা করতে সাহস পায় না। তাই পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে সন্ত্রাসীদের আটক করতে হবে। পার্বত্যবাসীর দীর্ঘদিনের দাবী মেনে পাহাড়ে র্যাবের স্থায়ী ব্যাটালিয়ন করে র্যাব মোতায়েন করতে হবে এবং সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের কারণে যেসব স্থানে নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে সেসব স্থানে সেনা ক্যাম্প পুণরায় মোতায়েন করতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: অবৈধ অস্ত্র, অস্ত্র উদ্ধার, উপজাতি সন্ত্রাসী
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন