পাহাড়ে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর কাছে ভয়ানক যুদ্ধাস্ত্র: জিম্মি সাধারণ নাগরিক

fec-image

অবৈধ অস্ত্রদেশের তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ের সশস্ত্র গ্রুপগুলোর কাছে হালকা-ভারী সব অস্ত্রই আছে। এদের হাতে পাহাড়ি-বাঙালি সব সাধারণ নাগরিকই জিম্মি। গহীন জঙ্গল আর দুর্গম পাহাড়ি জনপদে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর কাছে অসহায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। বিভিন্ন সময় পাহাড়ের সশস্ত্র গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে অনেক অত্যাধুনিক অস্ত্র উদ্ধার করেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা–যা সন্ত্রাসীদের কাছে থাকা অস্ত্রের অতি সামান্য একটি অংশ। আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সদস্যরাও বলছেন, সমতল ভূমির মতো যদি সব এলাকায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যেতে পারতো, তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। তাছাড়া এলাকায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর আগমনের খবর সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর কাছে সরবরাহ করা স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য বাধ্যতামূলক। ব্যতিক্রম হলে চরম মাশুল গুনতে হয় তাদের।

আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, পাহাড়ে লুকিয়ে থাকা সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো আন্তর্জাতিক অস্ত্র চোরা কারবারিদের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে থাকে। মর্টার, রকেট লাঞ্চার, এলএমজি, এসএমজি, একে-৪৭, স্নাইপার রাইফেল, হ্যান্ড গ্রেনেডসহ দেশি-বিদেশি বন্দুক ও রাইফেলের মতো হাজার হাজার ভারী অস্ত্র রয়েছে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর হাতে। আর এসব অস্ত্র কেনার অর্থ যোগান দিতে হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের। যার মধ্যে পাহাড়ের সাধারণ জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। অপহরণের পর জিম্মি করে মুক্তিপণ ও নিয়মিত চাঁদা আদায় সন্ত্রাসীদের আয়ের অন্যতম উৎস। মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হলে জীবন দিতে হয় তাদের। রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির বিভিন্ন এলাকায় এসব সশস্ত্র গ্রুপ বছরের পর বছর নৈরাজ্য চালিয়ে আসছে।

জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), জনসংহতি সমিতি (জেএসএস-এম এন লারমা), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)— এই চারটি আঞ্চলিক সংগঠনের স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত তাদের ৭২ জন সদস্য নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৪০ জন ইউপিডিএফের সদস্য, জেএসএস-এর সদস্য ২৭ জন। তাদের হাতে নিহত হয়েছেন ৫ জন বাঙালি। এক বাঙালিসহ অপহরণ হন ৬৩ জন। গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে ৩৯টি।

এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত গত ছয় বছরে ২০৭ জন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ ও ১১৪ জন বাঙালি নিহত হয়েছেন। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ৩৪৭ জন অপহরণ হয়েছেন। এ সংখ্যা বাঙালিদের মধ্যে ১৬৯ জন।

শান্তিচুক্তি
তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এলাকার সশস্ত্র পাহাড়ি গ্রুপগুলোর নৈরাজ্য বন্ধ করতে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার তাদেরকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে শান্তিচুক্তি করে। সরকারের প্রতি এসব গ্রুপের শর্ত ছিল ৭২টি। আর সরকারের পক্ষ থেকে শর্ত ছিল একটি। আর সেটি হচ্ছে অস্ত্র সমর্পণ বা অস্ত্রবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করা। কিন্তু সরকারকে দেওয়া সেই প্রতিশ্রুতি তারা রক্ষা করেনি। উপরোন্তু আধিপত্য বজায় রাখতে গিয়ে নিজেরাই চরম হানাহানিতে জড়িয়ে পড়ছে। রক্ত ঝড়ছে প্রতিনিয়ত। বিপরীতে সরকার ৭২টির মধ্যে ৪৮টি শর্তই পুরোপুরি মেনে নিয়েছে। নয়টি বাস্তবায়নের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বাকি কয়েকটি শর্ত আইনি জটিলতায় আটকে আছে।

অবৈধ অস্ত্রপাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠন
বর্তমানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের চারটি সংগঠন রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে- জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), জনসংহতি সমিতি (জেএসএস-এম এন লারমা), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, এসব আঞ্চলিক সংগঠনের কাছে ছোট অস্ত্রের পাশাপাশি অনেক ভারী অস্ত্র মজুত রয়েছে। গত ১৮ আগস্ট (২০১৯) সকালে সেনাবাহিনীর একটি টহল দলের ওপর পোয়াইতুখুম নামক স্থানে সেনাবাহিনীর একটি নিয়ামিত টহল দলের ওপর পূর্ব থেকে ওঁৎ পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা অতর্কিত গুলি চালায়। এতে নাসিম নামে এক সেনা সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।

৬ বছরে ৫৬১ অস্ত্র উদ্ধার
২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বিগত ছয় বছরে পাহাড়ে সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে ৫৬১টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ২০১৮ সালের ১৮ এপ্রিল রাঙামাটি সদর উপজেলার বালুখালী ইউনিয়নের কাইন্দা এলাকা থেকে সেভেন পয়েন্ট ৬২ এমএম দু’টি এসএমজি ও দু’টি ম্যাগাজিন, একটি অ্যাসল্ট রাইফেল ও একটি ম্যাগাজিন, দু’টি পিস্তল ও দু’টি ম্যাগাজিন, ১৬ রাউন্ড অ্যামুনেশনসহ অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

একই বছরের (২০১৮) ২৩ এপ্রিল খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলায় এক অভিযানে ইউপিডিএফ-এর আস্তানা থেকে বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি ও সামরিক সরঞ্জাম উদ্ধার করে সেনাবাহিনীর ২০-ই বেঙ্গল দীঘিনালা জোনের সদস্যরা। ওইদিন দুপুর বারোটার দিকে দীঘিনালা উপজেলার কবাখালী ইউনিয়নের কৃপাপুর গ্রামে অভিযান চালিয়ে ৩৫০ রাউন্ড গুলি ও সামরিক সরঞ্জাম উদ্ধার করে সেনাবাহিনী। এসব গুলি মেশিনগান, এসএমজি-এলএমজির, পিস্তলের।

এছাড়াও ওয়ারলেস এন্টেনাসহ ইউপিডিএফের বেশ কিছু সামরিক বই ও চিকিৎসা সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী ইউনিয়নে ২০১৭ সালের ৩১ মার্চ সেনাবাহিনী ও বিজিবি সমন্বিত অভিযান চালায়। ওই অভিযানে চারটি রকেট লাঞ্চারসহ জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) কাপ্তাই উপজেলার সাবেক সভাপতি থোয়াই সুইনু মারমা (৪৩) ও তার ছেলে উপজেলা পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি ক্যাহিংহলা মারমাকে (২২) আটক করা হয়।

অবৈধ অস্ত্রবান্দরবানের থানচির একটি পাহাড়ে ২০১২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর অভিযান চালাতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের না পেলেও তাদের ফেলে যাওয়া ৩০টি মর্টার শেল ও দু’টি হ্যান্ড গ্রেনেড উদ্ধার করে সেনাবাহিনী। রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়িতে ২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট অভিযান চালিয়ে একটি এসএমজি, একটি একে-৪৭, দুটি চাইনিজ রাইফেল, তিনটি এসএলআর ও একটি পিস্তল উদ্ধার করে সেনাবাহিনী। এছাড়া ১২০ রাউন্ড রাইফেলের গুলি, ৮৪ রাউন্ড এসএমজির গুলি, ১৪৫ রাউন্ড এসএলআরের গুলি, ৯৪ রাউন্ড পয়েন্ট টু টু বোর রাইফেলের গুলি, সাত রাউন্ড পিস্তলের গুলি ও সেনাবাহিনীর তিনটি ইউনিফর্ম উদ্ধার করা হয় সেখান থেকে।

একই বছরের (২০১৫) ৭ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির দীঘিনালার জেএসএস (সংস্কারপন্থী) এর একটি আস্তানা থেকে একটি মেশিনগান, একটি গ্রেনেড, দুটি এসএলআর (সেলফ লোডেড রাইফেল), একটি ফাইভ পয়েন্ট ৫৬ এমএম এসএমজি, একটি সেভেন পয়েন্ট ৬২ ফোল্ডেড এসএমজি, এসএমজির তিনটি ম্যাগাজিন, একটি রাইফেল ম্যাগাজিন, ৬২ রাউন্ড মেশিনগানের গুলি, ১০৬ রাউন্ড সেভেন পয়েন্ট ৬২ বোরের গুলি, ১২৫ ডাউনলোড এসএমজির গুলি ও সামরিক সরঞ্জাম উদ্ধার করে সেনাবাহিনী। বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার গহীন জঙ্গল থেকে ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ এম-১৬ রাইফেল, এসএলআরসহ দেশি-বিদেশি বেশ কিছু অস্ত্র উদ্ধার করে সেনাবাহিনী।

যেসব অস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে
সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী পাহাড়ের সশস্ত্র গ্রুপগুলোর কাছে থাকা ভারী অস্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে, এলএমজি ১৪৪টি, এসএমজি ও একে-৪৭, সেভেন পয়েন্ট ৬২ মি.মি. রাইফেল ৩২৩টি, এম-১৬ রাইফেল ১২২টি, জি-৩ রাইফেল ৫৯টি, জিরো পয়েন্ট ২২ রাইফেল ৮৫টি, স্নাইপার রাইফেল ৫টি, দেশি-বিদেশি পিস্তল ৩৬০টি, মর্টার ৪০টি, দেশি-বিদেশি বন্দুক প্রায় ৩০০, দেড় হাজারের মতো হ্যান্ড গ্রেনেড এবং অর্ধশতাধিক রকেট লাঞ্চার।

পুলিশ সুপার যা বললেন
পাহাড়ে অস্ত্রবাজি ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সুপার আলমগীর কবির বলেন, শান্তি চুক্তির আগে ও পরে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জন্য এবং নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য পাহাড়ে থাকা সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো হত্যা ও অপহরণসহ নানা অপরাধ করছে। তিনি বলেন, উপজাতিদের নিজস্ব একটা কালচার আছে। সেই কালচারটা শুধু ভাষা কিংবা জীবন যাত্রাতেই নয়, অপরাধের ক্ষেত্রেও তারা নির্দিষ্ট একটা কালচার ফলো করে। পুলিশ সুপার বলেন, যেসব দুর্গম জায়গাতে তাদের অবস্থান ও যোগাযোগ, সেসব জায়গায় যদি আমরা পৌঁছাতে পারতাম,তাহলে তাদের অস্তিত্ব থাকতো না। সেজন্য তাদের কাছে থাকা অস্ত্রের সংখ্যা কতো সেটা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়।

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: অবৈধ অস্ত্র, অস্ত্র উদ্ধার, পাহাড়ে অস্ত্র
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন