পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের অবস্থানের প্রেক্ষাপট

জেনারেল ইব্রাহীম

♦ সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক

সূচনা বক্তব্য
পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান সমস্যাটি প্রসঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তরুণসমাজ পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতায় অসচেতন। তাই বর্তমান প্রজন্মকে অবহিত ও সচেতন করার জন্য কষ্ট করে কলাম লিখছি। যদিও একটি বা দু’টি বা চার-পাঁচটি কলামে সব কথা কোনোমতেই বলা সম্ভব নয়, তথাপি চেষ্টা করছি। প্রথম দু’টি কলাম ব্যয় হয়েছে প্রেক্ষাপট বোঝাতে। তৃতীয় কলামে গিয়ে বলেছি বাঙালি ও ভূমি সমস্যা প্রসঙ্গে। আজকেও বাঙালি ও ভূমি নিয়ে বলব। এ প্রসঙ্গে পঞ্চম ও শেষ কলামে লিখব দুই বা তিন সপ্তাহ পর উপজাতি গোষ্ঠীকে আদিবাসী বলা বা না বলা প্রসঙ্গে।

জাতীয়ভাবে ব্যবস্থাপনার কাঠামো
১৯৮৭ সালের ১৭-১৮ ডিসেম্বর শান্তিবাহিনীর সাথে সরকারি প্রতিনিধিদলের বৈঠক হয়েছিল। তার পর ১৯৮৮-এর জানুয়ারিতে একবার হয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে একবার হয়েছে, আবার জুন মাসে হয়েছে। মাঝখানে এপ্রিল-মে মাসের গল্প গত ১৮ মার্চের কলামে বলেছি। কলামগুলো ওয়েবসাইটের আর্কাইভসে পাবেন অথবা আমার ওয়েবসাইটে পাবেন। ওয়েবসাইটের পরিচয় এই কলামের শেষে দেয়া আছে। শান্তিবাহিনীর প থেকে উপস্থাপিত দাবিনামার ভেতরে দাবিগুলো এত মারাত্মক ছিল যে আমরা সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করিনি। গ্রহণ না করলেও আমরা জানি শান্তিবাহিনী কী চাচ্ছিল।

সরকারপ্রধান জেনারেল এরশাদের বক্তব্য ছিল, কিছু না কিছু দেবো, শান্তি চাই। কতটুকু দিলে হবে, এটা একটা উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত। ১৯৮৮ সালে আমি খাগড়াছড়ি ব্রিগেড কমান্ডার ছিলাম। রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হলেও রাজনৈতিকভাবে আলাপ-আলোচনা পরিচালনা করার জন্য স্থানীয় রাজনৈতিক অবকাঠামো ছিল না। তাই সরকার একটি পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি করেছিল; এর প্রধান ছিলেন তৎকালীন রাজনৈতিক সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার। সদস্য ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক পরে রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির, চট্টগ্রামের জিওসি, চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার, চট্টগ্রামের বিভাগীয় অতিরিক্ত কমিশনার প্রমুখ। মাঠে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য এককভাবে পরিশ্রম ও সংগ্রাম করতে হয়েছিল আমাকে। আমার পৃষ্ঠপোষকতায়, আমার সহকর্মীরাও অকান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল- সশস্ত্র বিদ্রোহকে সমাপ্তির পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য আপাতত নিয়ন্ত্রণে আনা। উদ্দেশ্য ছিল- রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান হিসেবে, গ্রহণযোগ্য মাত্রায় গণতান্ত্রিক চর্চার ব্যবস্থা করা ও প্রতিনিধিত্বশীল শাসনব্যবস্থার বন্দোবস্ত করা।

সেনাবাহিনী ও শান্তিবাহিনীর টানাটানি
১৯৮৮ সালের এপ্রিল-মে মাসের ঘটনার আগে থেকেই আমি পুরো খাগড়াছড়ি জেলায় প্রচার করেছিলাম যে, শান্তিবাহিনী যদি সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারি প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনায় না বসে, এবং শান্তিবাহিনী যদি বাঙালি গ্রামের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে, তাহলে নিশ্চিতভাবেই সরকার সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে বাধ্য হবে। অপরপে শান্তিবাহিনীর কৌশল ছিল এই যে, বাঙালিদের ওপর আক্রমণ বৃদ্ধি করলে, সরকার চাপে পড়বে এবং তখন সরকার আমাদের (শান্তিবাহিনীর) পাঁচ দফা দাবিনামা আলোচনা করবে ও মেনে নেবে। এটা ছিল অ্যাথলেটিকস বা বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিন মাঠে যেমন রশি টানাটানি বা ‘টাগ অব ওয়্যার’-এর মতো। আগে আলোচনা করেছি, বাংলাদেশ টেলিভিশনের সৌজন্যে দেশবাসী খাগড়াছড়ি জেলার মর্মান্তিক ঘটনাগুলো জানতে পারছিল। অতএব সরকারের ওপরে মনস্তাত্ত্বিক চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তাই ৮ মে ১৯৮৮ তারিখে বঙ্গভবনে ব্রিফিংয়ের পর, সরকারের প থেকে কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ওই সিদ্ধান্তগুলো সামরিক বাহিনী, বেসামরিক প্রশাসন এবং গণ্যমান্য নাগরিকগণের সহযোগিতায় বাস্তবায়ন করা হয়েছিল।

গুচ্ছগ্রাম স্থাপনের সিদ্ধান্ত
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল দু’টি। প্রথমটি হলো খাগড়াছড়িতে বেশি, রাঙ্গামাটিতে কম; কিন্তু উভয় পার্বত্য জেলায় সামরিক বাহিনীর সংখ্যা বা শক্তি এপ্রিল ১৯৮৮ সালে যা ছিল তার ওপর প্রায় ৩৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। যার ফলে শান্তিবাহিনীর বিদ্রোহমূলক কর্মকাণ্ড দমন করা সহজ হয়েছিল এবং বাঙালি ও পাহাড়ি গ্রামগুলোতে নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছিল। ৮ মে ১৯৮৮ তারিখের ব্রিফিংয়ের পরের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল, যেসব সেটেলার বাঙালির বসতি তাদের কৃষিজমি থেকে দূরে এবং যারা শান্তিবাহিনী কর্তৃক সহজেই আক্রান্ত হয়, সেসব বাঙালিকে নিজ নিজ বসতি-স্থান বা গ্রাম থেকে উঠিয়ে নিয়ে এসে এক জায়গায় একত্রিত বা গুচ্ছ করতে হবে। একত্রিত করার জন্য যুগপৎ দু’টি ব্যবস্থা ছিল। প্রথম ব্যবস্থা হলো, কোনো একটি ক্ষুদ্র বাঙালি গ্রামকে কেন্দ্র বা নিউকিয়াস বানিয়ে দূরবর্তী অন্য গ্রামের বাঙালিদের সেই নিউক্লিয়াস গ্রামে এনে জড়ো করা। তাহলে ওই গ্রামটি আকারে বড় হবে। দ্বিতীয় ব্যবস্থা হলো, একদম শূন্যস্থানে তথা শূন্য দু-চারটি পাহাড় ও উপত্যকা বেছে নিয়ে সেখানে বাঙালিদের এনে একত্রিত করা বা গুচ্ছ করা। উভয় ব্যবস্থায় অনেক বাঙালি এক জায়গায় হলে তাদেরকে নিরাপত্তা দেয়া সহজ হবে এবং ন্যূনতম কিছু না কিছু নাগরিক সুবিধা দেয়া যেতেও পারে। এরূপ গ্রামগুলোকে নাম দেয়া হলো গুচ্ছগ্রামগুচ্ছগ্রামের মানুষেরা যেহেতু তাদের কৃষিজমি থেকে বিচ্যুত হয়ে গেল, সেহেতু তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, সাপ্তাহিক ভিত্তিতে ন্যূনতম রেশন দেয়ার বন্দোবস্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো।

গুচ্ছগ্রাম স্থাপনের উদ্দেশ্য
গুচ্ছগ্রামে আনার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল শান্তিবাহিনী এবং নিরস্ত্র কৃষক বাঙালিদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করা, যেন শান্তিবাহিনী বাঙালি মারতে না পারে। গুচ্ছগ্রামে আনার আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারি উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে পরিচালনা করে সমস্ত বা সর্বপ্রকার জমির আকৃতি-আয়তন ইত্যাদি নির্ধারণ করা এবং অতঃপর এর মধ্য থেকে যেগুলো কৃষিযোগ্য জমি সেগুলো পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে প্রয়োজন অনুপাতে বণ্টন করা মালিকানাসহ পাহাড়িদেরকে অগ্রাধিকার দিয়ে। কাজটি সম্পন্ন করার জন্য তিনটি পার্বত্য জেলার মধ্যে অগ্রাধিকার পাবে খাগড়াছড়ি জেলা। রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং তার সরকার গুচ্ছগ্রাম পদ্ধতি অনুমোদন করার সময় প্রাক্কলন করেছিলেন, আগামী তিন বছরের মধ্যে এই জরিপের কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। অতএব, আনুমানিক সাড়ে তিন-চার বছরের মাথায় গুচ্ছগ্রাম ভেঙে ফেলা সম্ভব হবে। খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের বেসামরিক কর্মকর্তারা ও সামরিক বাহিনীর সদস্যরা অকান্ত পরিশ্রম করে এই গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন। ওই আমলে শান্তিবাহিনী প্রচারণা করেছিল যে, বাঙালিদেরকে এক জায়গায় করা হয়েছে যেন বাঙালি তরুণদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব হয় এবং সেই সশস্ত্র প্রশিক্ষিত তরুণেরা কিছু দিনের মধ্যেই পাহাড়িদের আক্রমণ করবে। আজ বোঝা সম্ভব, শান্তিবাহিনীর প্রচারণা কতটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ভ্রান্ত ছিল।

যা হোক, ১৯৮৮ সালের মে-জুনে নেয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে করতে অক্টোবর শেষ হয়ে যায়। ওই গুচ্ছগ্রামগুলো এখনো আছে। কারণ, শান্তিবাহিনী ওই আমলে জরিপকাজে প্রচণ্ড বাধার সৃষ্টি করেছিল। বস্তুত, সাত-আট বছর আগে গ্যাস ও তেল অনুসন্ধান কাজেও শান্তিবাহিনী বাধার সৃষ্টি করেছিল। এখনো শান্তিবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কাজে বাধার সৃষ্টি করছে। আমার মূল্যায়ন নিম্নরূপ : হয় শান্তিবাহিনী ভুলপথে আছে, অথবা উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ ভুলপথে আছেন অথবা বাঙালিরা ভুলপথে আছেন অথবা বাংলাদেশ সরকার ভুলপথে আছে অথবা সবাই কম-বেশি কিছু না কিছু ভুলপথে আছেন। ভুলগুলো আবিষ্কার করা প্রয়োজন। ভুলগুলো সংশোধন করা প্রয়োজন। ভুল নিয়ে দীর্ঘ দিন বসবাস করলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হুমকিতে থাকবে।

গুচ্ছগ্রামগুলোর মূল্যায়ন
যেহেতু গুচ্ছগ্রামগুলো এখনো (২০১৫) আছে, সেহেতু সরকারকে এখনো সেখানে ভর্তুকি মূল্যে রেশন দিতে হয়। কিন্তু ১৯৮৮ সালে যে পরিবারগুলো গুচ্ছগ্রামে গিয়েছিল, সে পরিবারগুলো এখন বর্ধিত হয়ে প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যা হয়েছে। ১৯৮৮ সালের পাঁচ বছরের শিশু এখন (২৭ বছর পর) ৩২ বছরের যুবক এবং ওই যুবকেরই পাঁচ বছরের শিশু আছে। গত ২৭ বছরে গুচ্ছগ্রামে কত লোক মারা গিয়েছে, যাদেরকে আশপাশে দাফন করা হয়েছে তার হিসাব তাৎক্ষণিক দিতে পারছি না। গুচ্ছগ্রামগুলোতে জীবনযাপনের মান অত্যন্ত দুর্বল। আজ থেকে ৩৫ বা ৪০ বছর আগে উপজাতীয় জনগণের যেরূপ দুরবস্থা দেখে তখনকার আমলের সরকার উপজাতীয় জনগণকে বিভিন্ন সুবিধা দিয়েছিল, আজ বাঙালি জনগণ ওই রকম দুরবস্থায় আছে এবং ওই রকমই সুবিধা তাদের প্রয়োজন। গুচ্ছগ্রামে বাঙালি জনগণ স্বেচ্ছায় যায়নি। তারা সরকারি হুকুমে সরকারি বন্দোবস্তে সরকারের কাজে সুযোগ সৃষ্টি করতে বা সহযোগিতা করতে গুচ্ছগ্রামে গিয়েছিল।

যদি বাঙালি জনগোষ্ঠীকে গুচ্ছগ্রামে নেয়া না হতো, তাহলে বাঙালিরা শান্তিবাহিনীর আক্রমণে মরত আবার নিজেরাও নিকটস্থ উপজাতীয় জনগোষ্ঠীকে মারত। মরে এবং মেরে তারা নিজেদের অধিকার আদায় করে ওখানে থাকত। কারণ, তারা এমনিতেই দুস্থ ও ভূমিহীন ছিল। তারা ঠিকানাবিহীন ছিল। সরকারি উদ্যোগে তাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে নেয়া হয়েছিল একান্তভাবেই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে। ওই আমলের বাংলাদেশ সরকার তার অনুকূলে ভোটার সংখ্যা বাড়াতে ওই দুস্থ ভূমিহীন বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে নেয়নি। সরকার নিয়েছিল রাষ্ট্রীয় স্বার্থে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে। আজ অন্তত বাংলাদেশের পতাকা প্রচুর জায়গায় ওড়ে। কিন্তু ১৯৭৯ বা ’৮৩ বা ’৮৭ সালেও চার ভাগের তিন ভাগ অঞ্চলে বাংলাদেশের পতাকা উড়ত না। যে মর্যাদারই হোক না কেন, বাঙালি জনগণ পার্বত্য চট্টগ্রামে থাকার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম এখনো বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ আছে; তা না হলে এখানে ব্যতিক্রম হতো।

ইউএনডিপির অদ্ভুত প্রস্তাব
যা বলছিলাম, ১৭ মার্চ ২০১৫ তারিখটি ছিল সরকারি ছুটির দিন; বঙ্গবন্ধুর জন্মদিবস। ওইদিন দিনের প্রথমার্ধে ঢাকা মহানগরীতে অবস্থিত ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম বা ইউএনডিপি অফিসের উদ্যোগে রাঙ্গামাটি শহরে অবস্থিত ইউএনডিপি অফিসে শহরের বাঙালি নেতাদের ডেকে এনে বসানো হয়। অতঃপর ঢাকার সাথে রাঙ্গামাটির টেলিকনফারেন্স হয়। ঢাকা থেকে ইউএনডিপির অফিসের কর্মকর্তারা বাঙালি নেতাদের যা বলেন তা অনেকটা এ রকম : ‘আপনারা বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক কষ্টে আছেন। আপনাদেরকে পাহাড়িরা কেউ গ্রহণ করছে না। আপনারা এখানে অযাচিত। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনারাও বাংলাদেশের সন্তান। আপনাদেরও শুভাকাক্সী আছে। বাংলাদেশের শুভাকাক্সী এবং আপনাদের শুভাকাক্সী হিসেবে আমরা আপনাদের নিরাপত্তা ও মঙ্গল নিয়ে চিন্তিত। সে জন্য আমরা আপনাদের একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। প্রস্তাবটি হলো আমরা আপনাদেরকে আর্থিকভাবে সাহায্য করব, আপনাদের পুনর্বাসনের জন্য যা লাগে তাই করব, কিন্তু আপনারা পার্বত্য চট্টগ্রাম ছেড়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে অন্যত্র যাবেন কি না। আপনারা সবাই বিজ্ঞ লোক, তাই আপনারা চিন্তা করে দেখুন।’ ১৭ মার্চের ওই টেলিকনফারেন্সে উপস্থিত বাঙালিরা কড়া কড়া যুক্তি দিয়ে অত্যন্ত প্রতিবাদী ভাষায় ইউএনডিপির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আমি আমার ফেসবুকে এ রকম লিখেছি : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকার বিরোধী দল দমনে ব্যস্ত; ইউএনডিপি বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে ও জনগোষ্ঠীকে পুনর্বিন্যাস করায় ব্যস্ত, আফসোস!

বাঙালি বিরোধী সম্প্রদায়
বস্তুত ইউএনডিপি ন্যাংটাভাবে যে কথাটি বলে ফেলেছে, এটা অতি পুরনো কথা। চিটাগং হিলট্রাক্টস কমিশন নামক একটি সংস্থা আছে। এটা মূলত উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের দু-একটি দেশের কয়েকজন ব্যক্তির উদ্যোগে করা। এই কমিশনের সাথে নিবিড় সহযোগিতা করেন বাংলাদেশের কয়েকজন বাঙালি ও উপজাতীয় ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোক। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি জনগোষ্ঠী থাকুক, এটা এই সিএইচটি কমিশন চায় না, এবং তাদের অনুসারী বাংলাদেশের কিছু বামপন্থী ও ধর্মনিরপেপন্থী বুদ্ধিজীবীরাও চান না। বাঙালি জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে না থাকলে পাশ্চাত্য বিশ্বের আগামী দিনের কিছু কিছু কাজ (এখন গোপনীয়) অতি সহজে ভবিষ্যতে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিরা না থাকলে বাংলাদেশ সরকারের কী হবে, সেটা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকারগুলো বা বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদেরা কদাচিৎ চিন্তা করেন বলে আমার মনে হয়। অতীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী চিন্তা করত। বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে চিন্তা করে কি না আমার জানা নেই; কারণ কোনো লক্ষণ নেই। সেনাবাহিনী চিন্তা করলেও বিপদ; কারণ তখন গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী, সেনাবাহিনী-বিরোধী কিছুসংখ্যক সম্মানিত বুদ্ধিজীবী হৈ হৈ রৈ রৈ করে ওঠেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামে যেকোনো বিরোধ হলেই বাংলাদেশের বেশির ভাগ বামপন্থী ও ধর্মনিরপেপন্থী বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক মহল বাঙালিদের দোষ খুঁজে বেড়ান। সম্মানিত সাংবাদিক ম. হামিদের অভিজ্ঞতার কথা আমি ইতঃপূর্বে কলামে লিখেছি। বাঙালিরা যেন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে চলে যায়, তার জন্য হেন অপচেষ্টা, হেন কু-চেষ্টা, হেন ষড়যন্ত্র বাকি নেই যেটা ধর্মনিরপেপন্থী ও বামপন্থী প্রশাসন করছে না। সম্মানিত পাঠক প্রশ্ন করতেই পারেন, ১৯৮৮ সালের অক্টোবর মাসের চুক্তিগুলোতে এবং ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরের চুক্তিটিতে বাঙালিদের সম্বন্ধে কী ছিল?

১৯৮৮ ও ’৯৭-এর চুক্তি এবং বাঙালি প্রসঙ্গ
১৯৮৮ সালে তিনটি জেলার জন্য তিনটি আলাদা চুক্তি হয়েছিল। চুক্তিগুলো, আইনগুলো এবং নির্বাচনের অন্যতম একটি বড় উদ্দেশ্য ছিল কাঠামোগতভাবে পাহাড়ি ও বাঙালি সব জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক মঞ্চে একাত্ম করা। তার জন্য পার্বত্য জেলা পরিষদ সৃষ্টি করা হয়েছিল। বাঙালিদের জনসংখ্যা আনুপাতিকভাবে যত ছিল, তার থেকে কম অনুপাতে জেলা পরিষদের বাঙালি সদস্য সংখ্যা করা হয়েছিল। প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। শান্তিবাহিনী সুবিধাগুলো নিয়েছে, সুফল ভোগ করেছে; কিন্তু ১৯৮৮-৮৯ সালের শাসনব্যবস্থার সংস্কার আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে না নিলেও কিন্তু ১৯৯৭-এর পর থেকে মেনে নিয়েছে এবং সুবিধা ভোগ করে যাচ্ছে।

পুনরায় উল্লেখ্য, বাঙালিদের জনসংখ্যা বেশি ছিল, অনুপাতে অনেক বেশি প্রতিনিধি পেত; কিন্তু সরকারের অনুরোধে তারা প্রতিনিধি সংখ্যা কম নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে। উদ্দেশ্য- গিভ অ্যান্ড টেক; মানে কিছু দাও, কিছু নাও। বাঙালিরা কিছু স্বার্থ ত্যাগ করবে, পাহাড়িরা কিছু স্বার্থ ত্যাগ করবে, সবাই মিলে শান্তিতে বসবাসের চেষ্টা করবে। প্রথম নির্বাচন হয়েছিল ১৯৮৯ সালের জুন মাসের ২৫ তারিখে। দেড় বছর পর এরশাদ সরকার পদত্যাগ করে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ তারিখে। পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ১৯৯২ জুন-জুলাই মাসে। তৎকালীন বিএনপি সরকার নির্বাচনটি করায়নি। আমার মতে, না করিয়ে বিএনপি সরকার ভুল করেছিল। নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন হলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার শিকড় গভীরে যেত এবং শান্তিবাহিনীর প্রভাব-প্রতিপত্তি ক্রমেই কমত। ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তিতে এ কথা স্পষ্ট করে লেখা নেই যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিরা থাকতে পারবে না। আবার এ কথাও স্পষ্ট করে লেখা নেই যে, বাঙালিরা থাকতে পারবে। তৎকালীন সরকার শান্তিবাহিনীকে এবং বাঙালিদেরকে শুভঙ্করের ফাঁকি দিয়েছিল। এখানে বলে রাখা ভালো, ১৯৮৯ সালের ২৫ জুনের পর দু’টি বিএনপি সরকার এবং দু’টি আওয়ামী লীগ সরকার গত হয়েছে, কিন্তু কোনো সরকারই জেলা পরিষদের নির্বাচনটি করায়নি। করালে বাঙালিরা ওই প্রক্রিয়ায় শক্তিশালী হতো।

শুভঙ্করের ফাঁকির কথা
১৯৯৭ সালের চুক্তির আগে শান্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে শক্তিশালী দাবি ছিল যে, বাঙালিদের এখান থেকে সরিয়ে নিতে হবে এবং এটা চুক্তিতে লিখতে হবে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বিবেচনা করল যে, এটা যদি চুক্তিতে লেখা হয় তাহলে সমগ্র দেশের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য রাজনৈতিক বিপর্যয় হবে। অতএব একটা বিকল্প বন্দোবস্ত চুক্তি ও চুক্তি-পরবর্তী আইনের মাধ্যমে করা হয়েছিল। বন্দোবস্তটি হলো এ রকম- পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের জন্য দুই প্রকারের ভোটার তালিকা থাকবে। এক প্রকার ভোটার তালিকায় পাহাড়ি ও বাঙালি সবাই থাকবেন এবং এই ভোটার তালিকা মোতাবেকই পার্লামেন্ট নির্বাচনে তারা ভোট দেবেন। দ্বিতীয় প্রকারের ভোটার তালিকা মোতাবেক সব স্থানীয় সরকার নির্বাচন যথা ইউনিয়ন পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং রাঙ্গামাটিতে অবস্থিত আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচনে ভোট দিতে হবে। দ্বিতীয় তালিকায় পাহাড়িরা তো থাকবেন অবশ্যই, কিন্তু শুধু ওই বাঙালিরা থাকবেন, যেই বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা।

স্থায়ী বাসিন্দার সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়, সার্কেল-প্রধান তথা রাজা সার্টিফিকেট দিতে হবে যে, ওই বাঙালি স্থায়ী বাসিন্দা। সার্কেল-প্রধান সার্টিফিকেট দেয়ার আগে শর্ত পূরণ করতে হবে, ওই বাঙালি আইনানুগভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে জায়গাজমির মালিক। সম্মানিত পাঠক, এখানে শুভঙ্করের ফাঁকিটা কোথায়? মেহেরবানি করে আপনি ১৯৮৮ সালে ফেরত যান। হাজার হাজার বাঙালি পরিবার গুচ্ছগ্রামে এসেছে এবং তাদের জায়গাজমি থেকে অনেক দূরে আছে। দু-এক বছরের মধ্যেই পাহাড়িরা ওই জমিগুলো দখল করে ফেললেন। সারা বাংলাদেশ এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ব্যস্ত ছিল এবং এরশাদ সাহেবও পার্বত্য চট্টগ্রামে মনোযোগ দিতে পারছিলেন না। জরিপকাজ শুরুই হয়নি, শেষ করা তো দূরের কথা। এ রকম করতে করতে ১৯৯৭ সাল এলো। মানে ৯-১০ বছর সময়। বাঙালিরা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অসঙ্ঘবদ্ধ। শান্তিবাহিনী এবং ওই আমলের আওয়ামী লীগ সরকার মনে করল, যেহেতু হাজার হাজার বাঙালি পরিবার তাদের জায়গাজমির মালিকানার সঁপে শক্তভাবে দাঁড়াতে পারবেন না, সেহেতু তারা অর্থাৎ ওই বাঙালিরা স্থায়ী বাসিন্দার সার্টিফিকেট পাবেন না। যদি স্থায়ী বাসিন্দার সার্টিফিকেট না পান, তাহলে ওই বাঙালিরা স্থানীয় পর্যায়ের কোনো কিছুতে ভোট দিতে পারবেন না। অনেক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। তাহলে ওই বাঙালিরা অধৈর্য এবং ত্যক্তবিরক্ত হয়ে একসময় বলবেন, আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে থাকব না, আমরা বাংলাদেশের অন্য কোথাও চলে যাই। তাহলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হলো। আওয়ামী লীগ সরকারকে এই দায়িত্ব নিতে হলো না যে, তাদের সিদ্ধান্তেই বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে চলে গেল। অপরপক্ষে শান্তিবাহিনীকেও সন্তুষ্ট করা গেল, তোমরা শান্তিবাহিনী ধৈর্য ধরো, বাঙালিরা ক্রমে ক্রমে চলে যাবে। বাঙালিরা আসলে যাননি। তাই নতুন কৌশলে শান্তি বাহিনী ও ইউপিডিএফ আগাচ্ছে। ওই কৌশলের নাম আদিবাসী কৌশল। আগামী দু-তিন সপ্তাহ কলাম লেখা সম্ভব নাও হতে পারে; সেজন্য বিনয়ের সাথে অগ্রিম দুঃখ প্রকাশ করে রাখছি। তারপর যে কলাম বের হবে, সেই কলামে আদিবাসী সম্পর্কে ইনশাআল্লাহ লিখব।

লেখক : মেজর জেনারেল (অব:) চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন