পার্বত্য ভূমি কমিশনের কার্যক্রম অচল!

copy-chittagong-hill-tracts_0_1
নিজস্ব প্রতিনিধি, রাঙামাটি:

পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিস্পত্তি কমিশন আইনের প্রস্তাবিত ধারাগুলো দীর্ঘ ৬ বছরেও সংশোধিত হয়নি। বর্তমানে কমিশন সম্পূর্ণ অচল। এর মধ্যে শেষ হয়ে গেছে গত সরকারে পুনর্গঠিত পার্বত্য ভূমি কমিশনটি। এখন কমিশনে অচলাবস্থা বিরাজ করছে।

এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ পর্যন্ত কমিশন পুনর্গঠনের কয়েক দফা উদ্যোগ নিলেও কার্যত: কোন সফলতা আসেনি। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সাধারণ জনগণ । কিন্তু থামছে না সরকারী খাস ভুমি বেদখল চক্রের দৌরাত্ব্য। পার্বত্য এলাকায় রাঙামাটি সার্কেলর প্রায় ৬ লক্ষাধিক সংরক্ষিত বনাঞ্চল রক্ষায় সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কোন মাথা ব্যথা নেই।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ঝুম নিয়ন্ত্রন বনবিভাগের ১৯৮২ সালে যেইসব বাগান করা হয়েছে তার অধিকাংশ ভুমি বনকর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বেদখল হয়ে গেছে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে প্রধান বনসংরক্ষক ,জেলা বনসংরক্ষক ও বিভাগীয় বনকর্মকর্তারা প্রতিযোগিতা নিয়ে পোষ্টিং বাণিজ্যর মাধ্যমে ফ্রি পারমিটের নামে সরকারী বাগান(রিজার্ভ ফরেষ্ট ) কাঠ পাচার করতে এসেছে। কেউ রিজার্ভ ও বনভুমি রক্ষায় কার্যত: কোন ভুমিকা রাখতে দেখা যায়নি।

এসব ইস্যুকে পুঁজি করে জেলা প্রশাসনের রাজস্ব শাখায় কিছু কর্মচারী সরকারী খাস জায়গা দখলে নিয়ে বিভিন্ন মহলে উৎসাহ করতে দেখা গেছে। পরবর্তীতে প্রশাসনের বিভিন্ন মহলে অভিযোগ করার পরামর্শ দিয়ে উভয় পক্ষ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে ভুমি সমস্যা জটিলতা সৃষ্টি করে আসছে।

জানা গেছে, পার্বত্য এলাকায় ১৯০০ সালের শাসন বিধি অনুসারে এবং ভুমি মন্ত্রনালয়ের নির্দেশমতে সরকারী খাস জায়গা দখলে নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করা,শুনানীসহ পরিমাপ ওপর নিষেধজ্ঞা রয়েছে। তবে আদালতের মামলার জনিত কারণে রেকর্ডীয় ভুমির পরিমাপ করার বিধান রয়েছে।

এদিকে পার্বত্য ভূমিবিরোধ নিস্পত্তি কমিশনকে কার্যকর করে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ব্যবস্থাপনা ও বিরোধ নিস্পত্তির লক্ষ্যের নামে কিছু কিছু এনজিও রাঙামাটিতে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ব্যবস্থাপনা ও বর্তমান প্রেক্ষিত’ ইস্যুতে বিভিন্ন সেমিনার আয়োজন করে আসছে। এসব সেমিনারে সরকারের উচ্ পদস্থ কর্মকর্তা,চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার রাজা দেবাশীষ রায়, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা, জেলা প্রশাসক মোঃ মোস্তফা কামাল ও পুলিশ সুপার আমেনা বেগমকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।

এদিকে কমিশন আইনের সংশোধনী তথা সরকারী ভুমির পরিমাপ করার নিয়ে এ সরকারেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বিরোধ নিস্পত্তির জন্য কমিশন গঠিত হলেও তা আজও কার্যকর হতে পারেনি। ২০০৯ সালের ১৯ জুলাই বচারপতি (অব:) খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে তিন বছরের জন্য গঠিত হয় আগের সরকারে বিদায়ী কমিশন। চতুর্থতম কমিশন সেটি। ওই বছর ২০জুলাই বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরী ওই কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। মেয়াদ শেষে সরকার এখনও নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়নি। ফলে কমিশন এখন কার্যত: অচল। বর্তমানে কমিশনের খাগড়াছড়ির প্রধান কার্যালয়ে স্থবিরতা বিরাজ করছে।

অন্যদিকে সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহতথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা পার্বত্য ভূমি কমিশন সম্পর্কিত এক বিজ্ঞপ্তিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আগের সরকারে ভূমি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ সংশোধনে আনা বিলে মতামতও দেয়নি। রহস্যজনকভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয় বিলটি। সে সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন ২০১৩ বিল জাতীয় সংসদে পাস করানো হয়নি।

জানা গেছে, গত বছর ২৭মে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন ২০১৩’ বিল মন্ত্রিসভায় উত্থাপিত হয়। পরে ৩জুন অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে বিলটি অনুমোদিত হয়। ১৬ জুন সংশোধনী বিল জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয়। বিধি অনুযায়ী মতামত চেয়ে বিলটি ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল।

জনসংহতি সমিতির এক বিবৃতিতে বলা হয়, বিলে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত করা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি অনুমোদিত ও ২০১২ সালের ৩০জুলাই আইনমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আন্ত:মন্ত্রণালয় সভায় গৃহীত ১৩ দফা সংশোধনী প্রস্তাবের মধ্যে ১০টি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাকি ৩ দফা গুরুত্বপূর্ণ সংধোশনী প্রস্তাব সম্পূর্ণভাবে বাদ দেয়া হয়। অপরদিকে উত্থাপিত ১০টি সংশোধনী প্রস্তাবের মধ্যে ২টি সংশোধনী প্রস্তাব বিলে যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন যথাযথভাবে সংশোধনে বিলের ওপর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে গত বছর ১৮জুন সরকারের নিকট পাঁচ দফা সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করা হয়।

চেয়ারম্যানকে নিয়ে ৯ সদস্যের পার্বত্য ভূমি কমিশন। কিন্তু চেয়ারম্যান না থাকলে কমিশন কার্যকর থাকে না। বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন গত কমিশনও ছিল অনেকটা অচল। ২০০৭ সালের ৩১ অক্টোবর তার আগের কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়। চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিস্পত্তিকল্পে সর্বশেষ ২০০৪ সালের ১ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএম মাহমুদুর রহমানকে চেয়ারম্যান করে তিন বছরের জন্য পার্বত্য ভূমি কমিশন গঠিত হয়। কিন্তু সেই সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে ওই কমিশন কোনো কাজই করতে পারেনি।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির (ঘ) খন্ডের ৪নং ধারা বলে ১৯৯৯ সালের ৩ জুন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আনোয়ারুল হক চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন গঠন করা হয়। ২০০১ সালের ১২ জুলাই জাতীয় সংসদে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি (ল্যান্ড কমিশন) কমিশন আইন-২০০১ পাস হয়। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সঙ্গে ল্যান্ড কমিশন আইনে অসংগতি থাকায় কোনো কমিশনই সঠিকভাবে কাজ করতে পারেনি।

১৯৯৯ সালের ৩জুন বিচারপতি আনোরুল হক চৌধুরীকে পার্বত্য ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হলেও তিনি দায়িত্ব গ্রহণের আগে ১৯৯৯ সালের ৬ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। ২০০০ সালের ৫এপ্রিল অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আবদুল করিমকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হলে তিনি শারিরীক অসুস্থতার কারণে পদত্যাগ করেন।

অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, আইনি জটিলতাসহ নানা সমস্যার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিস্পত্তি কমিশন গঠনের পর এ পর্যন্ত কোনো কাজই করতে পারেনি। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমিবিরোধ নিস্পত্তি নিয়ে এখনও অনিশ্চিত।

এদিকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন আইন শক্তিশালী ও যুগোপযোগী করতে সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পাঠানো ১৩ প্রস্তাবের মধ্যে ১০টি ধারা সংশোধন এবং ৩টি নতুন ধারা সংযোজনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্তও দিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি।

বিদ্যমান আইনে ৬(১)(ক) ধারায় বলা আছে, পুনর্বাসিত শরনার্থীদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও রীতি অনুযায়ী নিস্পত্তি করতে হবে। সংশোধন প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পুনর্বাসিত শরনার্থীদের জমিজমা বিষয়ক বিরোধ দ্রুত নিস্পত্তি করা ছাড়াও অবৈধভাবে বন্দোবস্তু ও বেদখল হওয়া জায়গা-জমি ও পাহাড়ের মালিকানাস্বত্ব বাতিল করাসহ সব ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী নিস্পত্তি করতে হবে।

আইনের ৬(১)(গ) ধারায় বলা আছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইন বহির্ভূতভাবে কোন বন্দোবস্তু প্রদান করা হয়ে থাকলে তা বাতিল করে বৈধ মালিককে ফেরত দিতে হবে। এর সংশোধন প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি বহির্ভূতভাবে ফ্রিঞ্জল্যান্ডসহ কোন ভূমি বন্দোবস্তু প্রদান বা বেদখল করা হয়ে থাকলে তা বাতিল করে আগের বৈধ মালিককে ফেরত দিতে হবে।

আইনের ৭(৫) ধারায় সংশোধন প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কমিশন তার এখতিয়ারভূক্ত কোন বিষয়ে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্তে উপণীত হতে না পারলে সংখ্যগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তই কমিশনের সিদ্ধান্ত বলে গণ্য হবে।

বিজ্ঞ মহলের ধারণা আগে পার্বত্য এলাকায় ভুমি জরিপ করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে কমিশনকে। এর পর কোন কোন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কত ভুমি রয়েছে জরিপের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। কিছু কিছু পাহাড়ী যেমন প্রতারণার মাধ্যমে বাঙ্গালীদের ভুমি দখল করেছে তেমনি সবচেয়ে বেশী ভুমি সমস্যা বাঙ্গালী এলাকায়। খোদ রাঙামাটি জেলায় ভুমির পরিমাপ ও সীমানা সংক্রান্ত সার্কেল চীফ,পৌরসভা,জেলাপ্রশাসক ও আদালতে প্রায় ৫ হাজারের অধিক মামলা রয়েছে।

এ সংক্রান্ত আরো দেখুন:

কি ঘটবে পার্বত্য ভূমি কমিশন আইন সংশোধন প্রস্তাব কার্যকর হলে?

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন