পাহাড়ে শান্তিচুক্তির প্রভাব বাড়ছে

fec-image

তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার পাহাড়ে অস্ত্রের ঝনাঝনানি বন্ধ করে শান্তি আনায়ের লক্ষ্যে পাহাড়ি সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর একটি চুক্তি করে, যা পাহাড়ের ইতিহাসে ‘শান্তিচুক্তি বা পার্বত্য চুক্তি’ নামে পরিচতি।

চুক্তি বাতিল বা চুক্তি না মানা নিয়ে পাহাড়ে তৎকালীন সময়ে পাহাড়ি এবং বাঙালিদের গুটিকয়েক সংগঠন আন্দোলনে নামে। এ চুক্তিকে কালো চুক্তি দাবি করে তৎকালীন জেএসএস সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতা প্রসীত খীসার নেতৃত্বে পাহাড়ি সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। পরে সংগঠনটি তাদের সশস্ত্র শাখা তৈরি করে চাঁদাবাজি-রাহাজানি, খুন-অপহরণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। সংগঠনটি এতটাই শক্তিশালী রূপ ধারণ করে যে, তাদের দমাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চরম বেগ হতে হয়। এদিকে পাহাড়ে বসবাসকারী বাঙালিদের কিছু সংগঠন রাজপথে মিছিল-মিটিং এবং স্মারকলিপির মাধ্যমে চুক্তির ধারা পরিবর্তন অথবা বাতিলের দাবিতে দীর্ঘবছর ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।

চুক্তির পরও সশস্ত্র কার্যক্রম চলমান
চুক্তির ২২ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও পাহাড়ে অস্ত্রের ঝনঝনানি বন্ধ করা যায়নি। প্রতিনিয়ত পাহাড়ের কোনো না কোনো প্রান্তে গুলির আঘাতে লাশ পড়ছে। বুলেটের আওয়াজে প্রকম্পিত হচ্ছে জনপদ। আতংকিত থাকছে স্থানীয় জনগণ। তৎকালীন সরকার পাহাড়ের শান্তির সুবাতাস ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে যাদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে তারা কতটুকু শান্তির জন্য কাজ করছে এ নিয়েও জনমনে প্রশ্ন আছে। সন্তু গ্রুপের পিসিজেএসএস’র অধীন তৎকালীন সময়ে ‘শান্তিবাহিনী’ নামে একটি সশ¯্র শাখা ছিলো। পাহাড়ে তারা চাঁদাবাজি, খুন, গুমসহ নানা অরাজকতা কাজের সাথে জড়িত ছিলো। শান্তিচুক্তির পর শান্তিবাহিনী বিলুপ্তি ঘোষণা করে পিসিজেএসএস। কিন্তু বাস্তবতা চরম নিষ্ঠুর। তারা শান্তিবাহিনী বিলুপ্তি ঘোষণা করলেও মুখোশের আড়ালে তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ হয়নি। তাদের কয়েক হাজার সদস্যের বাহিনী পাহাড়ে এখনো সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। চাঁদা আদায়, খুন, গুম এবং নিজেদের শক্তি জানান দিতে ভ্রাতৃঘাত সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। দখলে নিচ্ছে নতুন নতুন এলাকা।

বর্তমানে পাহাড়ে চারটি সশস্ত্র সংগঠন রয়েছে। এক সময় সন্তু গ্রুপের পিসিজেএসএস থাকলেও চুক্তি পরবর্তী ইউপিডিএফ-এর জন্ম হয়। পরবর্তী সময়ে জেএসএস সংস্কার এবং ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামে আরও দু’টি সশস্ত্র সংগঠনের জন্ম হয়। পাহাড়ের বাসিন্দারা এই চারটি সংগঠনের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে দিনদিন। তাদের চাঁদাবাজির যন্ত্রণায় স্থানীয় জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। সরকারের উন্নয়নের প্রতিটি কাজ থেকেই তারা চাঁদা আদায় করছে। কলার গাড়ি, বাঁশ, কাঠ কোনকিছু বাকী নেই যা থেকে তারা চাঁদা আদায় করছে না। এমনকি কারো বিয়ে হলেও তাদের চাঁদা দিতে হয়। তারা পাহাড়ে অঘোষিত রাজত্ব কায়েম করেছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রাখলেও দুর্গম পাহাড়ে তাদের অবস্থান এতটুকু বিনষ্ট করা যায়নি। তারা প্রতিমুহূর্তে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কখনো বা তারা একে অপরের বিরুদ্ধে সংঘাতে জড়াচ্ছে, কখনো আবার তারা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ্রকে হত্যা করে তাদের শক্তির জানান দিচ্ছে। এইসব সন্ত্রাসী সংগঠনের পাশাপাশি রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলা এবং বান্দরবান নিয়ে আরাকার আর্মি সমর্থিত মগ লিবারেশন আর্মির জন্ম হয়েছে। তারাও পাহাড়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
থেমে নেই হত্যাকান্ড

শান্তিচুক্তি পরবর্তী পাহাড়ে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর দ্বন্দ্ব ও সংঘাত থেমে নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হিসেব মতে, গত ২০ বছরে ছয় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে সন্ত্রাসীদের গুলিতে। আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি এবং নিজেদের শক্তি জানান দিতেই মূলত এ ধরনের হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটছে পাহাড়ে।

১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে পিসিজেএসএস। দলটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এমএন লারমা)। দলটির আভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার হয়ে মানবেন্দ্র নারারয়ণ লারমা নিহত হলে দলটির নেতৃত্বে আসে তারই ছোট ভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা। বর্তমানে তিনিই পিসিজেএসএস’র নেতৃত্বে দিচ্ছেন। পাহাড়ে শান্তি আনয়নের লক্ষ্যে পিসিজেএস’র সাথে তৎকালীন আ’লীগ সরকার একটি চুক্তি করে। ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তি অস্বীকার করে পিসিজেএসএস’র কেন্দ্রীয় ছাত্র নেতা প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। দল দু’টির সংঘাতে পিসিজেএসএস (সন্তু লারমা) এর দুই শতাধিক এবং ইউপিডিএফ’র (প্রসিত গ্রুপ) তিন শতাধিক নেতাকর্মী প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হয়েছে বলে সংগঠনগুলোর নেতারা দাবি করেন।

অন্যদিকে, ২০১০ সালে আত্মপ্রকাশ করা পিসিজেএসএস এমএন লারমা (সংস্কার) গ্রুপের দাবি, তাদের ৬৬ জন এবং ২০১৮ সালে আত্মপ্রকাশ করা ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক এর সাত নেতাকর্মী সংঘাতে মারা গেছে। এছাড়া আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর পারস্পরিক দ্বন্দ্বে প্রায় ৩০ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে।

পাহাড়ি সংগঠনগুলোর নেতারা যা বলছেন
২০১০ সালের ১০ নভেম্বর আত্মপ্রকাশ করা পিসিজেএসএস (এমএন লারমা) অংশের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক সুধাকর ত্রিপুরা বলেন, ‘পিসিজেএসএস-এর মূল দলসহ অন্যান্য আঞ্চলিক দলের সঙ্গে নানা মতপার্থক্য থাকায় এবং প্রয়াত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তারা পিসিজেএসএস (এমএন লারমা) নামে আত্মপ্রকাশ করেন। তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারসহ সব ধরনের অধিকার আদায়ে কাজ করা। কিন্তু আমরা যত সহজে চেয়েছি, তা তো হয়নি। পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর পক্ষে ন্যায্য কথা বলায় এখন পর্যন্ত ৬৬ জন নেতাকর্মীকে হারিয়েছি।’ এজন্য তিনি আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের ন্যায়-নীতি-আদর্শ অনুসরণ না করাকে দায়ী করেন।

আধিপত্য বিস্তার প্রসঙ্গে তিনি জানান, তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়, জনগণের আত্মঅধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করছেন। আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজির কথা অস্বীকার করলেও সংগঠন চালানোর জন্য আর্থিক সহযোগিতা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন তিনি। আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর চলমান খুনোখুনি চলতে থাকলে ভবিষ্যতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীতে নেতৃত্ব দেওয়ার কেউ থাকবে না বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

ইউপিডিএফ (প্রসিত) গ্রুপের খাগড়াছড়ি জেলা সংগঠক অংগ্য মারমা বলেন, ১৯৯৭ সাল থেকে আমরা জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত তিনশতাধিক নেতাকর্মীকে হারিয়েছি। এসব হত্যার জন্য শাসকগোষ্ঠীর লালিত-পালিত সন্ত্রাসী ও বিপথগামীরা দায়ী।

তিনি বলেন, ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সংঘাত বন্ধ ছিল, কিন্তু ২০১৮ সাল থেকে আবার শুরু হয়েছে। এর জন্য তিনি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক জুম্ম জনগোষ্ঠীকে দ্বিধা, বিভক্তিকরণের পাশাপাশি পাহাড়ি নেতাদের লোভ-লালসা, সংগঠনের পদ-পদবি, চাঁদাবাজি করার সুযোগ এবং বিলাসী জীবনযাপনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার লোভনীয় প্রস্তাবকে দায়ী করেন। সংগঠনগুলোর নীতি-আদর্শ নেই বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

তাদের দলের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একটি রাজনৈতিক দল পরিচালনা করতে গিয়ে বিভিন্ন লোক হতে নেওয়া আর্থিক সহযোগিতাকে চাঁদা বলা যাবে না। যদি তাই হয়, তবে বর্তমান সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা বিভিন্ন মেগা প্রজেক্ট হতে যে চাঁদা নেয়, তাকে আপনারা কী বলবেন?

আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর নেতাদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা নিয়ে অংগ্য মারমা বলেন, ‘যোগ্যতা-অযোগ্যতা লাগে না, শাসকগোষ্ঠী চাইলে যাকে তাকে নেতা বানাতে পারে। বর্তমান সময়ে বান্দরবানে মগ বাহিনী দিয়ে বিরোধী মত দমন-পীড়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি সব সংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রতি সংঘাত বন্ধ করার দাবি জানান।

ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সভাপতি শ্যামল চাকমা ওরফে জলাইয়া বলেন, ইউপিডিএফ (প্রসিত) গ্রুপ এখন জুম্ম জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম হতে দূরে সরে গিয়ে চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার, ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে টাকা আদায় এবং নিজের পকেট ভারীকরণে ব্যস্ত। তাদের লোভী উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, জুম্ম জাতির অধিকার আদায়ের জন্য ২০১৭ সালে আত্মপ্রকাশ করার পর, ইউপিডিএফ (প্রসিত) গ্রুপের হামলায় আমাদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিসহ ৮ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আমার দল সঠিক ও আইনানুগ পথে থেকে আন্দোলন করছে এবং করবে। সংগঠনের জন্য সবার সহযোগিতা কামনা করি।

সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দরা যা বলছেন
রাঙামাটি শহরের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং সাবেক ছাত্রনেতা জাহাঙ্গীর আলম মুন্না বলেন, বর্তমান সরকার জনবন্ধব সরকার। এই সরকারের আমলে সারাদেশে উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে। এই সরকার ১৯৯৭ সালে ক্ষমতায় থাকাকালে পাহাড়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাত বন্ধের জন্য জনসংহতি সমিতির সাথে শান্তিচুক্তি করে। কিন্তু চুক্তির দীর্ঘ ২৩ বছর অতিক্রম করলেও পাহাড়ে এখনো রক্তক্ষয়ী সংঘাত বন্ধ হয়নি। বরং পূর্বের চেয়ে সন্ত্রাসীরা আরও ভয়কর রূপ ধারণ করেছে। আগে একটি গ্রুপ সক্রিয় থাকলেও বর্তমানে পাহাড়ে চারটি সশস্ত্র গ্রুপ সক্রিয়। চারটি দলই পাহাড়ের সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে চাঁদা আদায় করছে। তাদের অত্যাচারে পাহাড়ের বসবাসরত ব্যবসায়ী, চাকরিজীবীসহ সকলে অতিষ্ঠ।
তিনি আরও বলেন, সরকার সারাদেশে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে। যারা অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে তারা সন্ত্রাসী। পাহাড়ের উন্নয়নকে গতিশীল করতে হলে এইসব সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে এবং সন্ত্রাসীদের সমূলে ধ্বংস করতে হবে। তাহলে পাহাড়ের উন্নয়ন বৃদ্ধি করা সম্ভব। কেননা পাহাড়ের উন্নয়নে বড় বাধা এইসব অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী।

রাঙামাটি প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সম্পাদক আনোয়ার আর হক বলেন, আমরা আর কত লাশ দেখবো। লাশ দেখতে দেখতে আমরা নিজেরা হতাশ হয়ে যাই। একুশ শতকের এ যুগে বসবাস করেও যদি বর্বর অত্যাচার দেখতে হয় তাহলে এর দায়ভার কার? আমরা আর লাশের মিছিল দেখতে চাই। পাহাড়ে আর কোনো বুলেটের আওয়াজ শুনতে চাই না। সবুজ পাহাড় তার আপন মহিমায় পাহাড়ের বাসিন্দাদের ছায়া বিলিয়ে দিক, শান্তিচুক্তির ২৩ বছর পূর্তিতে এটাই প্রত্যাশা করি।

পাহাড়ের ক্ষমতায় থাকা দায়িত্বশীলদের মতামত
রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা বলেন, শান্তি চুক্তির আগে পাহাড়ে তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার শান্তি চুক্তির মাধ্যমে অন্ধকার পাহাড়ে আলোর প্রদীপ জ্বালিয়েছে। খুন, গুমের ইতিহাসে শান্তির সুবাতাস বয়ে এনেছে এই চুক্তি।
তিনি আরও বলেন, পাহাড়ের শান্তিচুক্তির আগে প্রতিদিন বুলেটের আঘাতে অসংখ্য মায়ের বুক খালি হতো। চুক্তির পরে এর সংখ্যা কমে এসেছে। আ’লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে পাহাড়ে উন্নয়নের জোয়ার অব্যাহত রেখেছে। রাঙামাটিতে মেডিক্যাল কলেজ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছে। রাস্তা-ঘাটের উন্নয়ন করেছে। সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করছে। দুর্গম পাহাড়ে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে যাচ্ছে পাহাড়ের মানুষের দোরগড়ায়।

চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা জানান, এক সময়কার স্থানীয় সরকার পরিষদ এখন জেলা পরিষদে পরিণত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে সরকার। পাহাড়ের সকল সম্প্রদায়ের লোকজন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাচ্ছে। এটাই আওয়ামী লীগ সরকারের বড় চমক। তিনি আরও জানান, সরকার জেলা পরিষদের মাধ্যমে পাহাড়ের আনাচে-কানাচে উন্নয়নের জোয়ার অব্যাহত রেখেছে। প্রতিষ্ঠা করছে স্কুল-কলেজসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান।

চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা আক্ষেপের সাথে বলেন, চুক্তি অনুযায়ী সরকার যেসব বিভাগ জেলা পরিষদের অধীনে হস্তান্তর করার কথা সেইসব বিভাগ এখনো হস্তান্তরিত হয়নি। যে কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ সহজে করা যাচ্ছে না। যদি সরকার চুক্তির নিয়ম মেনে সেইসব বিভাগ হস্তান্তর করে তাহলে পাহাড়ের মানুষ আরও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবে।

রাঙামাটির সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দীপংকর তালুকদার বলেন, আমি চুক্তির কোনো নেগেটিভ কিছু দেখি না। জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি করে পৃথিবীর বুকে নতুন ইতিহাস রচনা করেছেন। চুক্তির পর পাহাড়ে উন্নয়ন হয়েছে। পাহাড় আর সমতলের মধ্যে আর তেমন কোনো পার্থক্য দেখি না। সরকার সমতল-পাহাড় এক সঙ্গে উন্নয়ন করছে, যা চুক্তির আগে কখনো হয়নি। তিনি আরও বলেন, চুক্তির আগে পাহাড়ে পাদদেশে বারুদের গন্ধ লেগে থাকতো। অসংখ্য মা তার সন্তান হারিয়েছে। স্ত্রী হারিয়েছে তার স্বামী। সন্তান হারিয়েছে তারা পিতাকে।

এমপি দীপংকর তালুকদার জানান, চুক্তি পরবর্তী রাঙামাটিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মেডিক্যাল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। স্থাপন করা হয়েছে অসংখ্য স্কুল-কলেজ। নিমার্ণ করা হয়েছে সড়ক। যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে।

এমপি আরও জানান, ব্যবসার পরিধি বেড়েছে। মানুষের কর্মসংস্থানের পথ সুগম হয়েছে। অর্থনেতিকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে পাহাড়ের মানুষ। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সেবা পৌঁছে গেছে। ইন্টারনেট সেবা নিচ্ছে বাসিন্দারা। এরচেয়ে বড় সারপ্রাইজ আর কী থাকতে পারে।

পাহাড়ে আ’লীগের এ বর্ষীয়ান নেতা বলেন, চুক্তি নিয়ে পাহাড়ের কিছু গোষ্ঠি পাহাড়ি জনগণকে ভুল বোঝাতে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তারা যেমন নিজের ভালো কিছু বুঝে না, তেমনি পাহাড়ের মানুষদের জন্যও কিছুই করতে পারে না। তারা দুষ্কৃতিকারী ছাড়া আর কিছ্ইু নয়। তারা চুক্তির ধারা সম্পর্কে কিছুই জানে না, বুঝেও না। পাহাড়ে কীভাবে হত্যা, গুমের রাজনীতি করে নিজেদের স্বার্থ আদায় করবে তা নিয়েই তারা ব্যস্ত।

তিনি আরও বলেন, সরকার চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে পারেনি, তবে চুক্তির বেশিরভাগ ধারা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে বাকী ধারাগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। এর জন্য সময় দরকার।

এমপি দীপংকর তালুকদার জানান, আন্তর্জাতিক অনেক দেশে চুক্তি হয়েছে। তারা দীর্ঘ বছর পার হলেও তাদের আভ্যন্তরীণ অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। আর জননেত্রী শেখ হাসিনা কত দ্রুত কঠিন কাজকে সহজ করে পাহাড়ের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে।

এমপি আরও জানান, আমাদের ভালো কিছুতেই অ্যালার্জি। ভালো কিছুকেই আমরা সহজে মেনে নিতে পারি না। শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হলে পাহাড়ি-বাঙালিসহ পাহাড়ে বসবাসরত সকল জনগোষ্ঠি সমানভাবে সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। এতে ভুল বুঝার কোনো অবকাশ নেই।

চুক্তির সুফল
পার্বত্য চুক্তি বা শান্তিচুক্তির পর পাহাড়ে উন্নয়নের ছোঁয়াও কম লাগেনি। রাঙামাটিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০১৪ সালে রাঙামাটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ এবং ২০১৫ সালে রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। গহীন পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে অসংখ্য স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। যোগাযোগের পথ অনেকাংশে সহজ হয়েছে। বর্তমান সরকার নানিয়ারচর উপজেলায় চেঙ্গী সেতু করে দিয়েছে। সেতুটি লংগদু এবং বাঘাইছড়ি উপজেলার সাথে জেলা সদরের সড়ক যোগযোগ স্থাপন করবে। এই সেতুটি তিনটি উপজেলাকে এক করেছে।

শুধু তাই নয়, সরকার মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, রাজস্থলী, বরকল উপজেলা হয়ে সীমান্তবর্তী থেগামুখ স্থল বন্দর পর্যন্ত সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু করে দিয়েছে। সড়কটি নির্মিত হলে ভারতের মিজোরামের সাথে বাংলাদেশের স্থলবন্দরের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য শুরু হবে খুব দ্রুত। এছাড়া খাগড়াছড়ির রামগড় স্থলবন্দর এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির চাকঢাইল স্থলবন্দর নির্মাণের কাজ চলছে। বর্তমানে বিদ্যুতের আলোয় পাহাড় আলোকিত হয়েছে। ইন্টারনেট পৌঁছেছে পাহাড়ে। শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেট ব্যবহার করে সমতলের শিক্ষার্থীদের ন্যায় ডিজিটাল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে।

আগে পাহাড়ে ট্যুরিস্ট আসতে ভয়ে থাকলেও বর্তমানে পাহাড়ে ট্যুরিস্ট আসার সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। অসংখ্য ট্যুরিস্ট স্পট স্থাপিত হয়েছে পাহাড়ে। বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেকের মতো দুর্গম এলাকাও এখন দেশের অন্যতম ট্যুরিস্ট স্পট। দেশি-বিদেশি পর্যটক এখন পাহাড়ে আসছে বিনা বাধায়। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে এ ক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তা দিয়ে। দিনদিন হোটেল-মোটেলের সংখ্যা বাড়ছে। কর্মসংস্থান হচ্ছে।

পাহাড়িরা এক সময় জুম চাষের উপর নির্ভরশীল থাকলেও বর্তমানে তাদের আর জুমের উপর নির্ভরশীর হতে হচ্ছে না। সরকাারের কৃষি বিভাগ থেকে সাহায্য নিয়ে তারা জুমের পাশাপাশি মাল্টা, আম, পিয়ারা, ড্রাগন, আপেল কূলের চাষ করছে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে। ফলে তাদের ভাগ্যর চাকা ঘুরছে সহজেই।

তাদের সন্তানরা এখন চাকরি করছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। পাহাড়ে কর্মসংস্থানের পরিধি বেড়েছে বহুগুণে। এছাড়াও পাহাড়ি অনেক তরুণ-তরুণী সরকারি সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে উদ্যোক্তাও বনে যাচ্ছেন।

পাহাড়ে ইন্টারনেটের পরিধি যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা। ইন্টারনেটের সুবিধা ভোগ করে তার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে পাহাড়ের তরুণ-তরুণীরা অর্থনৈতিক নতুন খাত তৈরি করছে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি, পার্বত্য চুক্তি, শান্তিচুক্তি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন