বান্দরবানের মিজোরাম সীমান্তে জঙ্গি সংগঠনের ৪০ নেতা

fec-image

অধিকাংশ ‘জঙ্গি সংগঠন’ নিষিদ্ধ হওয়ায় ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে এ সংগঠনের শুরু ২০১৭ সালে। যাদের মোটিভেশনসহ সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণের নেতৃত্ব দিচ্ছে পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এবং নানাভাবে সহায়তা করছে। কয়েকটি অভিযানে তারা আটক ও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার চেষ্টায় ৪০ জন সদস্য এখন দেশের পার্বত্য জেলার মিজোরাম সীমান্ত এলাকায় পাহাড়ে অবস্থান করছে। এদের মধ্যে দলটির আমির মোহাম্মদ আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ, অর্থ শাখার প্রধান এবং দাওয়াতি শাখার প্রধানও রয়েছে। আছে শুরা সদস্য আব্দুল্লাহ মাইমুন, মোশারফ হোসেন, শামীম মাহফুজ এবং ভোলার শায়েখও। সম্প্রতি তারা পার্শ্ববর্তী দেশে পালানোর চেষ্টা করেছিল। ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর ধাওয়া খেয়ে তারা ফের বান্দরবানের পাহাড়ি অঞ্চলে প্রবেশ করে। আদিবাসীদের সঙ্গে মিশে যেতে তাদের কেউ কেউ নামের সঙ্গে বিভিন্ন আদিবাসী গোত্রের নাম জুড়ে দিয়েছে। । আর পালিয়ে থেকেই শারক্বীয়া ও কেএনএফ সদস্যরা জঙ্গি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের ধরতে পাহাড়ে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানিয়েছে যুগান্তর।

গত বছরের আগস্টে কুমিল্লা থেকে আট যুবক নিখোঁজের খবর আসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। পরে জানা যায়, দেশের ১৯ জেলা থেকে নিখোঁজ হয়েছেন ৫৫ জন। এই নিখোঁজ তরুণদের রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার নাম জানতে পারে। আরও জানতে পারে, এ সংগঠনের সদস্যরা ‘সামরিক বাহিনীর’ পোশাক পরিধান করে পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এ প্রশিক্ষণের ভিডিও ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। পরে পাহাড়ে অভিযান শুরু হয়। সেখান থেকে গ্রেফতার জঙ্গিদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সমতলেও অভিযান চালানো হয়। এসব অভিযানে এ পর্যন্ত শারক্বীয়ার অর্ধশতাধিক সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে নিখোঁজ তালিকার ৫৫ জনের মধ্যে ২৫ জন রয়েছে। এই ২৫ জনের মধ্যে পুলিশ দুইজন এবং র‌্যাব ২৩ জনকে গ্রেফতার করে। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে দুজন (সৈয়দ মারুফ আহমদ ও মাসুকর রহমান) শুরা সদস্যও আছে। এছাড়া অভিযানে দুজন নিহত হয়। গত চার মাসের অভিযানে এ পর্যন্ত কেএনএফ-এর ১৭ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলেও সূত্র নিশ্চিত করেছে।

সূত্রমতে, গত বছরের অক্টোবর থেকে র‌্যাব এ পর্যন্ত আটটি বড় ধরনের জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালিয়েছে। এসব অভিযানের একটি ছিল রাঙামাটির বিলাইছড়ির সাইজামপাড়া ও বান্দরবানের রোয়াংছড়ি বাজার এলাকায়। ২০ অক্টোবর চালানো ওই অভিযানে কেএনএফ-এর তিনজন এবং শারক্বীয়ার সাতজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তারা হলো সৈয়দ মারুফ আহমদ ওরফে মানিক (শুরা সদস্য এবং সহকারী সামরিক প্রধান), কাওসার ওরফে শিশির, জাহাঙ্গীর আহম্মেদ ওরফে জনু, ইব্রাহিম ওরফে আলী, আবু বক্কর সিদ্দিক ওরফে বাপ্পি রফু মিয়া এবং কেএনএফ সদস্য জৌথান স্যাং বম, স্ফিফেন বম ও মালসম বম। এই অভিযানের পর জঙ্গিরা দুটি ভাগ হয়ে যায়। দুটি অংশের নেতৃত্ব দেন দুইজন। তারা হলেন মো. দিদার ওরফে চাংপায় এবং শিব্বির ওরফে কারছ। চাংপায়ের নেতৃত্বে ছিল ৩২ জঙ্গি এবং কারছের নেতৃত্বে ছিল ২১ জন। তারা দুজনই শারক্বীয়ার সামরিক শাখার নেতৃস্থানীয়।

র‌্যাবের গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জঙ্গিদের প্রশিক্ষণে বান্দারবান ও রাঙামাটির দুর্গম অঞ্চলে ১২ থেকে ১৩টি ক্যাম্প রয়েছে। কেএনএফ সদস্যরাই এসব ক্যাম্পে শারক্বীয়া সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ২০ অক্টোবর অভিযানের পর জঙ্গি সংগঠনটির দুটি দল বান্দরবানের সিপ্পি পাহাড়ের কাছে (রামজুদান ক্যাম্পে) প্রশিক্ষণ নেয়। পরে ওই পাহাড় থেকে দক্ষিণে অপর একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প কেটিসির দিকে রওয়ানা হয়। শারক্বীয়া নেতা কারছের নেতৃত্বে থাকা ২১ জনের দলটি মিজোরাম সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। এই টিমের সদস্যরাই ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ধাওয়ায় বান্দরবানে প্রবেশ করে। এখনো এদের কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। অপরদিকে চাংপায়ের নেতৃত্বে থাকা ৩২ জনের মধ্যে বিভিন্ন অভিযানে ১৭ জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।

জানতে চাইলে অ্যান্টি টোরোরিজম ইউনিট (এটিইউ) প্রধান ও বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত আইজি এসএম রুহুল আমিন গণমাধ্যমকে বলেন, জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার বিষয়ে র‌্যাব শুরু থেকেই কাজ করছে। তাই আমরা এ বিষয়ে খুব একটা অগ্রসর হইনি। তারপর পাহাড়, সমতল-সব জায়গায় আমরা ফোর্স মোতায়েন করেছি।

র‌্যাবের আইন গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গণমাধ্যমকে বলেন, নতুন জঙ্গি সংগঠনটির সদস্যরা অভিযানের মুখে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তবে তারা পাহাড়ি অঞ্চলেই রয়েছে। তাদের সবশেষ অবস্থান মিজোরাম সীমান্ত এলাকায় বলে চিহ্নিত করেছি। এদের গ্রেফতারে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। তবে পাহাড়ি এবং দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় অভিযান শুরুর আগে আমাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ২০১৯ সালে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া তাদের কার্যক্রম শুরু করে। গত বছরের সেপ্টেম্বরের দিকে আমরা তাদের বিষয়ে তথ্য পাই।

গ্রেফতার শারক্বীয়া সদস্যদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে র‌্যাব পরিচালক আল মঈন বলেন, সংগঠনটি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছিল। তবে র‌্যাবের অভিযানের মুখে তাদের সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। বর্তমানে তাদের কোনো হামলা চালানোর সামর্থ্য নেই। এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার আল মঈন বলেন, জঙ্গি সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা বাইরে থাকলেও তাদের মূল প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দিয়েছি। বড় বড় কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করেছি। এখন তাদের হামলা চালানোর মতো সক্ষমতা নেই।

আরও যারা গ্রেফতার : ২০ অক্টোবরের অভিযান ছাড়াও ৫ অক্টোবর থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাহাড়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও সাতটি বড় অভিযান চালিয়েছে র‌্যাব। এসব অভিযানে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে আছে হোসাইন আহম্মদ (সদস্য সংগ্রহ ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত), নেছার উদ্দিন ওরফে উমায়ের (প্রশিক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক) বণি আমিন (আশ্রয়দাতা তত্ত্বাবধায়ক), ইমতিয়াজ আহমেদে রিফাত, হাসিবুল ইসলাম, রোমান শিকদার ও মো. সাবিত। এদের সবাইকে গত বছরের ৫ অক্টোবর মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহ থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। র‌্যাবের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৯ অক্টোবর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও কেরানীগঞ্জে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় শাহ মো. হাবিবুল্লাহ ওরফে হাবিব (অন্যতম অর্থ সরবরাহকারী), নেয়ামত উল্লাহ (দাওয়াতি কার্যক্রমে যুক্ত), মো. হোসাইন (দাওয়াতি কাজে যুক্ত), রাকিব হাসনাত ওরফে নিলয় ও সাইফুল ইসলাম ওরফে রণি ওরফে জায়দ চৌধুরীকে। গত বছরের ৩ নভেম্বর কুমিল্লার লাকসামে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় আব্দুল কাদের ওরফে সুজন ওরফে ফয়েজ ওরফে সোহেল (হিজরতকারীদের সমন্বয়ক), ইসমাইল হোসেন ওরফে হানজালা ওরফে মানসুর (হিজরতকারীদের সমন্বয়ক), মুনতাছির আহম্মেদ ওরফে বাচ্চু (অর্থবিষয়ক প্রধান সমন্বয়ক) ও হেলাল আহমেদ জাকারিয়া (সামরিক শাখায় তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি)।

র‌্যাব জানায়, ৮ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় আব্দুল হাদি ওরফে সুমন ওরফে জন (অর্থদাতা), আবু সাঈদ ওরফে শের মোহাম্মদ (অর্থদাতা) এবং দাওয়াতি কাজে যুক্ত রনি মিয়াকে। ৪ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও ও রাজধানীর গুলিস্তান থেকে গ্রেফতার করা হয় গোলাম সারোয়ার (শারীরিক ও তাত্ত্বিক প্রশিক্ষক), সাকির মাহমুদ, ফরহাদ হোসেন, মুরাদ হোসেন ও ওয়াসিকুর রহমান ওরফে নাঈমকে। ১১ জানুয়ারি বান্দরবানের থানচি ও বেয়াংছড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে র‌্যাব গ্রেফতার করে নিজাম উদ্দিন হিরণ ওরফে ইউসুফ, সালেহ আহমেদ ওরফে সাইহা, সাদিকুর রহমান সুমন ওরফে ফারকুন, বাইজিদ ইসলাম ওরফে মুয়াজ ওরফে বাইরু এবং ইমরান বিন রহমান শিথিল ওরফে বিল্লালকে। ২৩ জানুয়ারি ইয়াহিয়া গার্ডনের গহিন বনে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় মাসুদুর রহমান ওরফে রণবীর ওরফে মাসুদ (শুরা সদস্য ও সমারিক শাখার প্রধান) এবং বোমা বিশেষজ্ঞ আবুল বাশার মৃধা ওরফে আলম ওরফে কয়কে।

র‌্যাব আরও জানায়, ৮ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানের থানচির রেমাক্রি ব্রিজ এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে শারক্বীয়ার ১৭ এবং কেএনএফ-এর সদস্য তিনজন। গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলো-আস সামি রহমান ওরফে সাদ, সোহেল মোল্লাহ ওরফে সাইফুল্লাহ, আল আমির ফরিক ওরফে মোস্তাক, জহিরুল ইসরাম ওরফে ওমর ফারুক ওরফে সাংওয়াই, মিরাজ শিকদার ওরফে আশরাফ হোসেন ওরফে দোলন, রিয়াজ শেখ ওরফে জায়েদ, ওবায়দুল্লাহ ওরফে ওবায়দুল ওরফে সাকিব ওরফে শান্ত, জুয়েল মাহমুদ ওরফে মাহমুদ, ইলিয়াস রহমান ওরফে তানজিল ওরফে সোহেল ওরফে থানবোয়াং, হাবিবুর রহমান ওরফে মোড়া, সাখাওয়াত হোসেইন ওরফে মাবরুর ওরফে রিসিং, আব্দুস সালাম রাকিব ওরফে দুমচুক ওরফে রাসেল, যোবায়ের আহম্মেদ ওরফে আইমান ওরফে রেনাল ওরফে ওমর, শামীম হোসেন ওরফে আবু হুরাইরা ওরফে রাফি ওরফে চামদুর, তাওয়াবুর রহমান সোহান ওরফে মিন্ট, মাওবক ওরফে জাকির ওরফে আলম, মোহাম্মদ মাহমুদ ডাকুয়া ওরফে হাকা, মেহাম্মদ আবু হুরাইরা ওরফে মিরাজ ওরফে সাইসো এবং কেএনএফ সদস্য লাল মোল সিয়াম বম, ফ্লাগ ক্রস ও মালসম পাংকুয়া।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: জঙ্গি, বান্দরবান, মিজোরাম
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন