বান্দরবানে আর কত আ:লীগ নেতা খুন হবে?

fec-image

জাতীয় সংসদের ৩০০নং আসন বান্দরবান আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। এই আসন থেকে পর পর ছয় বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি। তিনি এখন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক পূর্ণ মন্ত্রী। ১৯৯১সন থেকে তিনি টানা ৩০বছর নেতৃত্ব দিয়ে বান্দরবানকে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে তৈরী করেছেন। যেটি নিঃসন্দেহে ক্ষমতাসীন দলের জন্য শুভ সংবাদ।

কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা এই অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে। গত এক বছর যাবত সম্প্রীতির এই শহরে বেড়েছে খুন আর অপহরণের মত ঘটনা। এই সময়ের মধ্যে সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছে আওয়ামী লীগ ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের ১০নেতা-কর্মী।

হত্যাকান্ডের এসব ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রধান রাজনৈতিক কোন বিরোধী পক্ষ বা দলীয় কোন্দল নয়; উপজাতীয় আঞ্চলিক সংগঠনের সামরিক শাখার সন্ত্রাসীদের হাতেই তারা খুন হয়েছে। তবে দৌর্দণ্ড প্রতাপে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলেও এখন পর্যন্ত একটি ঘটনারও বিচার করতে সক্ষম হয়নি বা সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে পারেনি।

হত্যাকাণ্ডগুলোর ধরণ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, উপজাতীয় আঞ্চলিক সংগঠনের যেসব নেতা সরকারের উন্নয়নের আহবানে সাড়া দিয়ে সন্ত্রাসের জীবন পরিত্যাগ করে বা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুরের গতিশীল নেতৃত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যেসব নেতা সন্ত্রাসের পদ ছেড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে, বেছে বেছে তাদের হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন, আওয়ামী লীগ বা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী কেউই এই নিজ দলের নেতাদের ধারাবাহিক হত্যা ও অপহরণের ঘটনা থামাতের পরেননি।

উল্লেখ্য, বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া হিসেব মতে, গেল বছর থেকে সম্প্রীতির বান্দরবানে খুন ও অপহরণের শিকার হয়ে মারা গেছে অন্তত ১০নেতাকর্মী। যদিওবা এই খুনের যাত্রা শুরু হয় ২০১৬ সালের ১৪ জুন। সেইদিন বান্দরবান সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা মং প্রু মার্মাকে অপহরণ করা হয় রোয়াংছড়ি থেকে। এখনো তার সন্ধান মেলেনি। এরপর ২০১৯সালে ১৯ মে বান্দরবান-রাঙ্গামাটি সীমান্তের বাঙ্গালহালিয়া এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতা ক্যহ্লা চিং মার্মাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

২০ মে রাজবিলা আওয়ামী লীগ নেতা ক্যচিং থোয়াই মার্মা, তিনদিন পর ২৩ মে পৌর আওয়ামী লীগ নেতা চথোয়াই মং মার্মাকে অপহরণের পর গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি সাবেক পৌর কাউন্সিলর ও পৌর আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি ছিলেন। ২৫ জুন অং সিং চিং মার্মাকে রোয়াংছড়ি উপজেলার থোয়াইংগ্য পাড়ায় গুলি করে হত্যা করা হয়। গত ২৩ জুলাই রোয়াংছড়ি উপজেলার তারাছা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মং মং থোয়াই মার্মাকে রোয়াংছড়ি থেকে বান্দরবান ফেরার পথে শামুকঝিরি এলাকায় ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়।

২৪ জুলাই বান্দরবানের লামায় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আলমগীর সিকদারকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। চলতি বছর ২২ ফেব্রুয়ারী ৭নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগ সভাপতি বাচুনু মারমা, ১৬জুন কুহালং ইউপি সদস্য ও আওয়ামীলীগ নেতা চাইন চাহ্লা মারমা, ২জুলাই সদর উপজেলার বালাঘাটা এলাকার রুয়াল লুল থাং বম, সর্বশেষ ১সেপ্টেম্বর বাঘমারা এলাকায় সন্ত্রাসীদের ব্রাশ ফায়ারে নিহত হন ইউনিয়ন যুবলীগ সাংগঠনিক সম্পাদক মংচিং উ মারমা।

এ ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও জেলা পরিষদ সদস্য লক্ষী পদ দাশ এক প্রতিক্রিয়ায় পার্বত্যনিউজকে জানান- ইতিহাস বলে, জন সমর্থন বিবর্জিত রাজনৈতিক দলগুলো কখনো কখনো সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে। হত্যা, গুম, অপহরণ, চাঁদাবাজি তাদের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। পরিণতিতে তারা কালের অতল গহ্বরে বিলিন হয়ে যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ বাংলার কৃষক-শ্রমিকের ঘামের নির্যাস, আবেগ অনুভূতির সম্মিলিত বহ্নিশিখা। অধিকার আদায়ের একক সংগঠন। অর্ধ শতাব্দী প্রাচীন দলটি জনগণকে সাথে নিয়েই সকল প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে বিজয়ী হয়েছে বারবার-ইতিহাস স্বাক্ষী। পাহাড়ের সন্ত্রাস মোকাবেলাও জনগণকে সাথে নিয়েই করা হবে বীর বাহাদুরের নেতৃত্বে।

জানা গেছে, বান্দরবান সদর উপজেলার রাজবিলা ও কুহালং ইউনিয়নের মানুষ সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠায় রয়েছে। রাজবিলা ইউনিয়নের বাঘমারা, জামছড়ি মুখ, জামছড়ি ভিতর পাড়া, খামাদং পাড়া, আনতা পাড়া এবং কুহালং ইউনিয়নের তাইংখালী পাড়া, উজি হেডম্যান পাড়া, চড়–ই পাড়া, হেব্রণ পাড়া, রাবার বাগান পাড়াসহ আশপাশের এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বিরাজ করছে ভীতিময় পরিবেশ। দিনের বেলায়ও এ এলাকার মানুষকে ভীতি তাড়া করে।

জানা গেছে, শান্তি চুক্তির পর আওয়ামী লীগ এর সাথে জনসংহতি সমিতির সুসম্পর্ক তৈরী হয়। পরবর্তীতে জাতীয় নির্বাচনে আ:লীগ প্রার্থীকে সমর্থন দেয় জেএসএস। কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়নের দাবীতে আন্দোলন সংগ্রামের কারণে ধীরে ধীরে সরকারী দল আওয়ামী লীগের সাথে জেএসএস এর সম্পর্কে দুরত্ব বাড়ে। ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে বান্দরবান আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কৃত নেতা প্রসন্ন কান্তি তঞ্চগ্যা নির্বাচনে প্রার্থী হলে জেএসএস তাকে সমর্থন দেয়। যার কারণে আ:লীগের সাথে জেএসএস’র দুরত্ব সৃষ্টি হয়।

এরপর ২০১৬ সালে প্রথম স্থানীয় আ:লীগ নেতা মংপ্রু মারমা অপহরণের ঘটনা ঘটে।  এখনো তার সন্ধান মেলেনি। তখন এই অপহরণ ঘটনার জন্য জেএসএসকে দায়ী করে শীর্ষ নেতাদের আসামী করে মামলা দায়ের করায় দুরত্ব থেকে দ্বন্দ্বে রূপ নেয় আ:লীগ জেএসএস এর সম্পর্ক। এর পর থেকে ধীরে ধীরে অশান্ত হয়ে উঠে সম্প্রীতির বান্দরবান।

একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতার একটি হিট লিস্ট তৈরী করেছে। সে অনুযায়ী হত্যাকাণ্ড চলছে।

জেলা যুবলীগ আহ্বায়ক কে লু অং মারমা বলেন, বান্দরবানে আওয়ামী লীগের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থনকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তোলার জন্য এই অপরাজনীতি করছে সন্ত্রাসীরা। এই সন্ত্রাস বন্ধে কঠোর অভিযান চাই। সম্প্রতি জামছড়ি এলাকার যুবলীগ কর্মী মংচউ মারমাসহ সকল হত্যার বিচার চান তিনি।

হত্যাকাণ্ডের এসব ঘটনার জন্য জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সরাসরি পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জেএসএসকে দায়ী করেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত একেকটা প্রাণ হারাচ্ছি। আমরা এর অবসান চাই। আর কোন আওয়ামীলীগ নেতা-কর্মী খুন আমরা দেখতে চাইনা। তিনি এসব হত্যাকান্ডের জন্য জেএসএসকে দায়ী করে আরো বলেন, সন্তু লারমা চোর। তাই পাহাড়ে লুকিয়ে লুকিয়ে তাদের সন্ত্রাসী দ্বারা আমাদের নেতা-কর্মীদের খুন করছে।

জেলা আওয়ামী লীগের আরেক র্শীষ নেতা আবদুর রহিম চৌধুরী বলেন- সন্তু লারমার সন্ত্রাসীদের লাগাম একনই টেনে ধরতে হবে আইন শৃংখলা বাহিনীকে। অন্যথায় আওয়ামী লীগ বৈঠকের মাধ্যমে সন্ত্রাস প্রতিরোধে মাঠে নামতে বাধ্য হবে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন