বৃষ্টি নামলেই তলিয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম, পোড়া মাতামুহুরীর কান্না

fec-image

কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বিএমচর ও পূর্ব বড় ভেওলা ইউনিয়নস্থ একটি শাখা খালের নাম ‘পোড়া মাতামুহুরী’। একসময়ে খরস্রোতা এই খালই ছিল এখানকার মানুষের যাতায়াতের একমাত্র পথ।

মাতামুহুরীর এই শাখা খালটি বিভিন্ন উপ-খাল হয়ে সরাসরি গিয়ে মিশেছে চকরিয়া উপকূলের সাগর মোহনায়। এ খালটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ কোথাও ১০০ ফুট আবার কোথাও এরচেয়ে বেশি।

অবৈধ দখল ও ভূমি দস্যুদের কারণে সময়ের পরিক্রমায় ও কালের বিবর্তনে দিন দিন হারিয়ে যেতে চলছে পুরাতন ঐতিহ্য ঘেরা পোড়া মাতামুহুরী এই শাখা খাল।

সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, একসময়ের খরস্রোতা এই শাখা খালটি এখন পুরোটাই বেদখল হয়ে গেছে। ফলে ১০০ মিটার প্রস্থের এই খালটি এখন কোথাও ১০ ফুট আবার কোথাও ৫ ফুটে গিয়ে ঠেকেছে। কোথাও কোথাও নিচে পানি চলাচলের জায়গা রেখে উপরে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।

এরকম রয়েছে প্রায় দুই শতাধিক অবৈধ স্থাপনা। ফলে দিনদিন খালটি বিলীন হওয়ার পথে। ভুক্তভোগী ও পরিবেশ সচেতন অনেকের প্রশ্ন, ‘পোড়া মাতামুুহরী’র এই কান্না শুনবে কে?

এলাকাবাসী জানান, এবার বর্ষা মৌসুমের শুরুতে টানা কয়েকদিন ভারী বর্ষণ হয়। কিন্তু পোড়া মাতামুহুরী শাখা খাল দখল হয়ে যাওয়ায় পানি নামতে না পেরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।

কয়েকদিনের এই জলাবদ্ধতায় আটকা পড়ে বিএমচর, পূর্ব বড় ভেওলাসহ আশপাশের একাধিক ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগী লোকজন খালটি দখলমুক্ত করার দাবিতে মাঠে নামেন। খালটিকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে এলাকায় গণস্বাক্ষর অভিযান চালান।

এরপর স্থানীয় সাংসদ জাফর আলম, জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী, ইউএনও সৈয়দ শামসুল তাবরীজ, পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামীকে বিষয়টি লিখিতভাবে জানান।

কিন্তু এখনো পর্যন্ত প্রশাসন এই বিষয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় ক্ষোভে ফুঁসছেন এলাকাবাসী।

ভূমি অফিসের তথ্যমতে দেখা গেছে, ভেওলা মানিকচর মৌজার বিএস ৬ নম্বর সিটের ও বিএস ৫৭৫৯ দাগের অন্তর্ভুক্ত এই খালটি পানি উন্নয়ন বোর্ড কঙবাজারের নিয়ন্ত্রণাধীন। বিগত সময়ে মৎস্য চাষ ও অস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণের শর্তে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে কেউ কেউ লিজ নেন। এরপর তারা সেখানে স্থায়ী ইমারত গড়ে তোলেন।

এক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা মোটা অংকের উৎকোচের এসব অনিয়ম নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেননি বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

কালাগাজী সিকদারপাড়ার বাসিন্দা আজিজুল হক, মোস্তফা কামাল, সাজ্জাদ হোছাইন, শাহদাত হোছাইন‘সহ অসংখ্য ভুক্তভোগী জানান, একসময় এই শাখা খালে জোয়ার-ভাটা ছিল। এখানে ইঞ্জিন চালিত নৌকা ও সাম্পান চলত। এটি ছিল আমাদের যোগাযোগের একমাত্র পথ।

কিন্তু বর্তমানে সেই জৌলুস আর নেই। নেই আগের পানি চলাচলের সেই স্রোতধারাও। প্রবহমান এই খালের ওপর এখন দেখা মিলে বহুতল ভবনের।

খাল দখলকারী স্কুল শিক্ষক জয়নাল আবেদীন দাবি করেন, এটি খাল নয়; ছড়ার মতো ছিল। তাও ১০ থেকে ১২ ফুট প্রস্থের। আমার বাবা সেখানে দোকান করতেন। ২০১৩ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে লিজ নিয়েছিলাম জায়গাটি। তবে ভবনের নিচে বেশ কয়েক ফুট উন্মুক্ত রেখেছি, যাতে পানি চলাচল করতে পারে। আমার লিজের মেয়াদ ২০২৫ সাল পর্যন্ত রয়েছে।

বিএস জরিপ অনুযায়ী প্রবহমান এই খালের দৈর্ঘ্য পাঁচ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১০০ ফুটের বেশি জানিয়ে বিএমচর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এস এম জাহাঙ্গীর আলম ও পূর্ব বড় ভেওলার চেয়ারম্যান আনোয়ারুল আরিফ দুলাল বলেন, ২০ বছর ধরে পর্যায়ক্রমে পোড়া মাতামুহুরী জবর-দখল হয়েছে। এরপর সুযোগ বুঝে সেখানে বহুতল ভবন পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছে। এতে খালটি সংকুচিত হতে হতে বর্তমানে কয়েকফুটে গিয়ে ঠেকেছে।

এই অবস্থায় খালটির পুনরুদ্ধারে প্রশাসনিক উদ্যোগ প্রয়োজন।
তারা আরও জানান, বর্তমানে সামান্য বৃষ্টি হলে গ্রামের পর গ্রাম তলিয়ে যাচ্ছে। তাই আপাতত ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে খালটির যেসব স্থান উন্মুক্ত রয়েছে সেখানে খননের ব্যবস্থা করা হবে। যাতে পানি দ্রুত নামতে পারে।

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ শামসুল তাবরীজ বলেন, ইতোমধ্যে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে এই খালের দুরবস্থা এবং দখল নিয়ে লিখিতভাবে আবেদন করা হয়েছে। সরেজমিন খালটির চিত্র পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য উপজেলা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী বলেন, আমি এখানে যোগদান করেছি বেশি দিন হচ্ছে না। খালটি দখলমুক্ত করতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে, কোনো প্রবহমান খাল লিজ বা বন্দোবস্ত দেয়া যাবে না। এরপরও কিভাবে এই খালের অংশ লিজ দেয়া হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হবে এবং প্রয়োজনে লিজ বাতিল করা হবে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: চকরিয়া, নির্বাহী প্রকৌশলী, পোড়া মাতামুহুরী
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন