বৃষ্টি নেই পাহাড়ে, আশানুরূপ হয়নি জুমের ফলন

fec-image

পাহাড়ে বসবাসরত জুমিয়াদের মায়াকান্না শুনতে কি পাও? খরা-রোদ্রে চোখের সামনে পানির সেচ ব্যবস্থাও নেই এমন পাহাড়ে উঁচু জমিতে ধান, তিল, ভূট্টা, মরিচ, শাক সবজি, ফল, কুমড়াসহ নানা জাতের ফলন ফলানো হয়েছে। প্রতি বছরের ন্যায় পাহাড়ে উঁচু-নিচু জমিতে জুম চাষ একটি ঐতিহ্যবাহী হিসেবে জনপ্রিয়। চলতি বছরের বৃষ্টি না হওয়া ও খরা রোদ্রে জুমের ফসল ভালো হয়নি। বান্দরবানের থানচি উপজেলা ১১টি পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জনগোষ্ঠীদের মরা উপর খাড়া ঘাঁ হয়ে অসহায়ত্ব মনে করছেন। দেশের একদিকে দ্রব্যমূল্য লাগামহীন বৃদ্ধি, যাতায়াতে ভাড়া অতিরিক্ত হওয়ায় পাহাড়ে জুম চাষীদের ছাইচাপা কান্না শুরু হয়েছে। সামনে বছরে তাদের পরিবারগুলি কীভাবে চলবে। ছেলে-মেয়েদের লেখা পড়া খরচ চালাবে কী করে সে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। পাহাড়ে প্রতিটি জুম চাষীদের দু:শ্চিন্তার শেষ নেই।

থানচি লিক্রে সড়কের পাশে ১০ থেকে ১২ জন জুম চাষীরা সাংবাদিকদের ছটপটে বলছিলেন, জুমের ধানসহ নানান জাতের চাষের ফলন মরে যাচ্ছে। জুমের আমাদের মায়া কান্না কেউ শুনতে পায়না। বলেছিলেন থানচি সদর ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডে কাইথং ম্রো পাড়া ও কুংহ্লা ম্রো পাড়া বাসিন্দা মেনলাও ম্রো ২৮, মেনথং ম্রো ২৫, চিংপ্রাত ম্রো ২৬, সিংক্লান ম্রো ৩০, এছাড়াও বাসিরান ত্রিপুরা স্মৃতি ত্রিপুরা ২৪, তার স্বামী সলেমান ত্রিপুরা ৩০।

সরেজমিনে জানা যায়, সিংক্লান ম্রো পরিবারের বৃদ্ধ বাবা-মা, ছেলে ও মেয়েসহ ৮ জন সদস্য রয়েছে। তিনি বলেন, গত বছরে পাহাড়ি উচুঁ-নিচু জমিতে মোট ১৩ হাঁড়ি বীজ ধান রোপণ করেন। আবাহওয়া অনুকূলে থাকায় ও বৃষ্টি হওয়ায় সে বছরে ফলন হয়। ৫০০ হাঁড়ি ধান, মিষ্টি কুমড়া, জুম কুমড়া, তিল, ভূট্টা, মরিচ, ফল (মার্ফা) বিক্রি করে ভালো লাভবান হয়েছেন তারা। পরিবারের ভরণ-পোষণের কোন অসুবিধা হয় নি। চলতি বছরে লিটক্রে সড়কে পাশে মোট ১২ হাঁড়ি ধান লাগানো হয়, তবে বৃষ্টি না হওয়া ও খরা-রোদ্রে ধান এবং অন্যান্য ফসলগুলি মারা যাচ্ছে। লাল লাল করে হয়েছে ধান ও নানান ফসল। বৃষ্টি নির্ভশীল জুম চাষের বৃষ্টি না হলে ১০০ হাঁড়ি ধান পাবে কি না সন্দেহ করছেন তিনি। তার মতে কুংহ্লা পাড়া ৫০ পরিবার, কাইথং পাড়া ৮০ পরিবার একই অবস্থার পরিণতি হবে।

একই সাথে সড়কে দুই পাশে রুমা ও থানচি উপজেলা সীমান্ত রেখা রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডে রাংদিয়া পাড়া বাসিন্দা বীর বাহাদুর ২৫, অরসেন ত্রিপুরা ৩৮, ও অনেকে একই দশা কথা জানান। তারা বলেন, গত ফেব্রুয়ারি ও মার্চ দুই মাস পাহাড়ের জড়াজির্ন জঙ্গল কাটা শুরু করেন। এপ্রিল মাসের আগুন লাগায় মে মাসের বীজ ধান ও অন্যান্য ফসল রোপণ এবং জুন-জুলাই দুইমাস পরিচর্যা করেন তারা। আগস্ট মাসের কিছু কিছু ধান পাকার কথা, সম্পূর্ণ ধান পাকতে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত সময় লাগবে। জুমের উৎপাদিত ফসল ঘরে তুলতে নভেম্বর-ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লেগে যাবে। এবার ঈশ্বর সহায় নাহলে পাহাড়ে মানুষের হাঁহাঁকার, খাদ্য সংকট বা অভাব দেখা দেয়ার আশঙ্কা বেশি বলে মনে করছেন তারা।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্যমতে থানচি উপজেলা ৪টি ইউনিয়নের ৩১৬৭ পরিবার সাধারণ কৃষক রয়েছে। এর মধ্যে উঁচু ভূমিতে জুম চাষ করেন ৯৫ শতাংশ পরিবার। বাকিরা বিভিন্ন ঝিড়ির মাঝ দিয়ে সমতল ভূমিতে চাষ করে থাকেন। তাদের মতে মোট ২৪৮৪ হেক্টর জমি রয়েছে। সেখানে ২৪৬২ হেক্টর উঁচু জমিতে জুম চাষ করেন। বাকি ২২ হেক্টর জমি কৃষি কাজে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া জুমের ধান ছাড়া ও অন্যান্য ফসল মধ্যে মরিচ, তিল, ভূট্টা, শাক সবজি, কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, মার্ফা ফল ইত্যাদি।

কৃষি বিভাগ জরিপের তথ্যমতে, উঁচু ভূমিতে আদা ৩৪২ হেক্টর, হলুদ ৩৫৭ হেক্টর, তিল ২৭১ হেক্টর, মরিচ ৮০ হেক্টর, শাক সবজি ২১২ হেক্টর জমিতে কৃষকরা ব্যবহার করে থাকেন। চলতি বছরে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬০২১.৮২ মে. টন। গতবছরে ৬৪৩৯.৩৯ মে. টন ফলন হয়েছিল ৬৬৮৯.৪৮ মে. টন লক্ষ্যমাত্রা চেয়ে ২০০ মে. টন বেশি উৎপাদন হয়েছে বলে দাবি কৃষি বিভাগের।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উদ্ভিদ সংরক্ষণ ও উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা বিশ্বজিত দাশ গুপ্ত বলেন, চলতি বছরে ১০০ জন কৃষক পরিবারকে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে প্রনোদনা হিসেবে ব্রি- বীজ ধান ৫ কেজি, ১০ কেজি এমওপি, ২০ কেজি ডিএফপি সার বিনামূল্যে বিতরণ করেছেন। এছাড়া কৃষি জমির জন্য ১০ পরিবারকে প্রদর্শনী প্লট হিসেবে সহযোগিতা করা হয়েছে। তাদের ফসলের ফলন গুণগতমান ভালো হয়েছে এবং তারা লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারবে।

প্রশ্ন করা হলে কুংহ্রা পাড়া বাসিন্দা সিংক্লাং ম্রো জানান, কৃষি অফিসারদের আমরা চিনিও না, জানিও না। যোগাযোগ ভালো হলেও তারা আমাদের পাড়ায় কোন দিন আসেন না। জুমের ধান ও সবজি চাষ, আদা, হলুদ, কাজু বাদাম, আম বাগান করার জন্য খুবই আগ্রহী। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে না দেয়ায় আমাদের ওয়ার্ডে প্রায় ৭ থেকে ৮ পাড়া কোন সুবিধা পাই না।

তিন্দু ইউনিয়নের বাসিন্দা থাংলং ম্রো জানান, জুম চাষের উপর বর্তমান ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেলে বা সার, কীটনাশক,কৃষি উপকরণ পেলে জুম চাষে পদ্ধতিগতভাবে এগিয়ে যেতে পারতাম।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মঞ্জুরুল আরিফিন সবুজ বলেন, সামনে বৃষ্টি হলে লক্ষ্যমাত্রা পৌছঁতে পারবো বলে দৃঢ় আশা করছেন। কিন্তু বৃষ্টি এমন অবস্থা থাকলে লক্ষ্যমাত্রা পৌঁছতে কষ্ট হবে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: জুম, পাহাড়, ফলন
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন