পাহাড়ে সোনালী দিনের সোনালী ফসল জুমের ধান

fec-image

পার্বত্য জেলায় বান্দরবানে থানচি উপজেলা ১১টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বসবাস।তাদের জীবনাচারও ভিন্ন ,এমনকি চাষাবাদ পদ্ধতিও ভিন্ন। আমরা সচরাচর সমতলে দেখি হালের বলদ বা আধুনিককালে কৃষি যন্ত্রপাতি দিয়ে জমিতে চাষাবাদ করা হয়। ধানের জমিতে সেচ দিতে হয়, কিন্তু পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারী পাহাড়ি জনগোষ্ঠী পাহাড়ের ঢালু ও উচু নিচু জায়গায় সম্পূর্ণ প্রকৃতির উপর নির্ভর করে এক ধরনের চাষাবাদ করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।

এই চাষে কোন সেচ দেওয়া লাগে না, প্রাকৃতিকভাবে রোদ-বৃষ্টি যা হয় তাতেই ফসল ফলে। তবে এটাও ঠিক যে অতিরিক্ত বৃষ্টি বা অতিরিক্ত রোদ হলেও জুম চাষ হয়না। জুম চাষের জন্য ঠিক সময়ে পরিমাণ মতো রোদ-বৃষ্টি হলেই ভালো ফসল পাওয়া যায়। নির্দিষ্ট একটা সময়ে পাহাড়ের বন জঙ্গল কেটে রোদে শুকিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে, উচুঁ উচুঁ পাহাড়ের ঢালু ভুমিতে ধানসহ ৩০-৩৫ প্রকার সাথী ফসল উৎপাদনের পদ্ধতিকে জুম চাষ বলা হয়ে থাকে।

পাহাড়িদের ব্যস্ত সময় জুমের সোনালী ফসলের যত্ন নেয়ার সময় এখন। জুমের ধান কাটা ধুম পড়েছে, জুমিয়াদের মুখে হাসি ফুটেছে। সবুজ পাহাড় এখন সোনালী রঙে রঙিন। যেদিকে দুচোখ যায় সবুজ পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে জুমের পাকা সোনালী রঙের ধান। কেউ ধান কাটা শুরু করেছেন, কেউ পাকা হয়েছে এমন জুমের ধান পাহারা দিতে স্বপরিবারে জুম ক্ষেতে উঠেছেন। কেউ ধান কাটার আগে সাথী ফসল বিশেষ করে মিষ্টি কুমড়া, ভুট্টা, মারফা ও চিনাল সংগ্রহ করা শুরু করেছেন। আর কেউ জুমের পাকা ধান কাটার জন্য উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করছেন। তিন পার্বত্য জেলায় বিশেষ করে দুর্গম এলাকায় এখন জুমচাষীদের দম ফেলার ফুসরত নেই, জুম চাষ ঘিরে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে।

উপজেলা বলিপাড়া ইউনিয়নের দিংতে পাড়া এলাকার শনিবার (১৬ সেপ্টেম্বর)সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় দিনতে ম্রো পাড়ার বাসিন্দা জুমচাষী দৈ লাং ম্রো (৫৮) স্বপরিবারে দলবল নিয়ে জুমের পাকা ধান কাটছেন। ধান কাটতে কাটতে তিনি জানান, এবছর ১২ কানি জায়গায় (১কানি =৪০শতক) ১২ আড়ি ধানের জুম করতে পেরেছেন। (১আড়ি =১০কেজি) এবছর জুমের ধান তেমন ভালো হয়নি, কারন যখন বৃষ্টির দরকার ছিল তখন বৃষ্টি হয়নি, আর যখন রোদ দরকার তখন অতিবৃষ্টি । আগে সময়মতো রোদ-বৃষ্টি হলে জুমের ধান ভালো হতো, এখন সময় মতো কিছুই হয়না, প্রকৃতিও পাল্টে গেছে। এ বছর জুম থেকে ৪শ আড়ি ধান পাওয়ার আশা করছেন, যদি জুমের ধান ভালো হতো তাহলে ৬ শ আড়ি ধান পেতেন, তারপরও যা পাবেন এবছর জুমের ধানে কোনমতে বছর যাবে।

অনেক জুমচাষীর জুম এবছর ভালো হয়নি, তাই এবছর খাদ্য সংকট দেখা দেবে বলে জানান তিনি। গতবছরও জুমে ভালো ধান উৎপাদন না হওয়াতে সাথী ফসল (মরিচ, তিল, যব, কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, বেগুন, কাকন, চিনাল, মারফা, মশলা জাতীয় শাক, ভুট্টা) বিক্রি করে ধানের ক্ষতি পুষিয়ে নিয়েছিলেন। গতবছর জুম থেকে সাথীফসল শুধু মিষ্টি কুমড়া বিক্রি করেই ৯০ হাজার টাকা পেয়েছিলেন। এবছর একেবারেই নেই।

এ বছর মরিচের বীজ ৩০কেজি জুমে ছিটিয়েছিলেন কিন্তু অনাবৃষ্টির কারনে মরিচের বীজ জন্মাতে পারেনি, সব মরে গিয়েছিল। মরিচের বীজ জন্মালে জুম থেকে শুধু মরিচ”ই লাখ টাকার বিক্রি করতে পারতেন। এবছর জুমে কেউই লাভ করতে পারেন নি। অতি বৃষ্টির কারনে সাথী ফসলও পচে নষ্ট হয়ে যাওয়াতে সেই আশাও করতে পারছেন না বলে জানান তিনি।

প্রতি বছর জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাসে জুমের জায়গা নির্ধারণ করা হয়। মার্চ মাসে জুম চাষের জন্য নির্ধারিত জায়গায় জঙ্গল কাটা হয়। তারপর কাটা জঙ্গল রোদে শুকানোর পরে এপ্রিল মাসে কাটা জঙ্গল আগুনে পোড়ানো হয়। মে মাস জুড়েই জুমের জায়গা পরিস্কার করে ধান বপনের জন্য প্রস্তুত করে কাঙ্খিত বৃষ্টির জন্য অপেক্ষারত থেকে বৃষ্টি হলেই জুমের জায়গায় ধানসহ সাথীফসল বপন করা হয়।

যারা বৈশাখ মাসের প্রথম বৃষ্টির পর জুমে ধানসহ সাথীফসল বপন করতে পারেন তাদের ধান আগে পাকা শুরু করে আর যারা একটু দেরীতে বপন করেন তাদের ধান দেরীতেই পাকে। প্রতিবছর আগষ্ট মাসের শেষে অথবা সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে জুমের ধান কাটা শুরু হয় এবং সেপ্টেম্বর -অক্টোবর পযর্ন্ত জুমের ধান কাটা, মাড়াই ও শুকানো প্রক্রিয়া চলে। ধান শুকানো শেষে জুমঘর থেকে মূলঘরে ধান স্থানান্তর করার পর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত চলে ঘরে ঘরে জুম ধানের নবান্ন উৎসব । এক জায়গায় প্রতিবছর জুম চাষ করা যায় না। এক বছরে একবার এক জায়গায় জুম চাষ করার পর কমপক্ষে ৩ বছর থেকে ৫ বছর পর্যন্ত জায়গা ফেলে রাখতে হয় মাটি উর্বর হওয়ার জন্য।

আমরা সচরাচর সমতলে দেখি প্রথমে বীজতলা তৈরী করতে হয় কিন্তু জুম চাষে সরাসরি ধান বপন করা হয়, আবার ধানের সাথে মিশ্র করে তুলা, ঠান্ডা আলু ,যব ,মিষ্টি কুমড়া, ভূট্টার ,মারফা (শসা জাতীয় ফল) চিনাল (বাঙ্গী জাতীয় ফল), আমিলা গুলো বীজ ( রোজেলা) ধানের সাথে বপন করা হয়। ধান বপন করার আগে মরিচ, তিল, বেগুন, সাবারাং (মসলা জাতীয় শাক) ধনিয়া পাতার বীজ, কাকন বীজ জুমের জায়গায় ছিটিয়ে দেয়া হয়।

জুমে ৩৫-৪০ প্রকার সাথীফসল করা হয়। জুম একটা পুরো বাজারের মতো। শুধু বাজার থেকে লবণ আর চিদোল (শুটকি জাতীয়) কিনলে একজন জুমিয়ার বাজার থেকে আর কিছুই কিনতে হয়না। তাই জুম চাষী পাহাড়ীরা জুমকে একটি বাজার বলে থাকেন।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলা ৪ ইউনিয়নের চলতি অর্থবছরে ৯শত হেক্টর জায়গায় জুম চাষ করা হয়েছে। সম্ভাব্য উৎপাদন চাউল ৩ হাজার ১২মে. টন। ৩ হাজার ৩৫০ পরিবার জুম চাষী রয়েছে। চলতি বছরে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে বলে জানা গেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষন ও উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বিশ্বজিদ দাশ গুপ্ত জানান, থানচি উপজেলা এবছর শুরুতে বৃষ্টিপাত কম আবার শেষের দিকে অতিবৃষ্টি হওয়ার কারনে জুমের ঢালু জায়গায় জুমের আংশিক ক্ষতি হয়েছে। আবার আগষ্ট মাসে অতিবৃষ্টির কারনে সাথীফসলেরও একটু ক্ষতি হয়েছে । উপজেলায় জুমচাষীদের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০ লাখ টাকার মতো বলে জানান তিনি।

চলতি বছর জুমচাষীদের ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদকে অবহিত করা হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন জুমের ধান এখনো যেগুলো পাকেনি শেষের ধানের ভালো ফলন হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: জুম, দিন, ধান
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন