বান্দরবানে জুমিয়ারা জুম চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছে
নিজস্ব প্রতিবেদক:
বান্দরবানের জুমিয়ারা পাহাড়ে আগুন দেওয়ার মাধ্যমে জুম চাষের পস্তুুতি নিচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে যুগ যুগ ধরে সনাতন পদ্ধতিতে পাহাড়ীরা জীবিকা নির্বাহে জুম চাষ করে আসছে। জুমিয়া পরিবারগুলো জুম চাষের মাধ্যমেই সারা বছরের খাদ্যের সংস্থান করে থাকেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাহাড়ী এলাকায় উপজেলা জুড়ে প্রতি বছরের ন্যায় জুমিয়ারা এবারো বনজঙ্গল কেটে পাহাড়ী ভূমি জুম চাষের উপযোগী করে নিয়েছে। জেলার হাজার হাজার একর পাহাড়ী ভূমিতে বর্তমানে অগ্নিসংযোগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অনেকে আবার আগুন দেয়া ভূমি অবশিষ্ট গাছপালা কেটে পরিষ্কার করে নিয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হবে জুমে বীজ বুননের কার্যক্রম।
জুম চাষিরা জানান, প্রতিবছর মার্চ-এপ্রিল মাসে জুমিয়ারা জুমের জন্য বাছাই করা পাহাড়ের বন-জঙ্গল কাটেন। এপ্রিল-মের দিকে জুমিয়া পরিবারগুলো পাহাড়ী ভূমিতে বীজ বুননের উপযোগী করতে পাহাড়ে আগুন দেয়। আগুনে পোড়ানো পাহাড়ে মে-জুন মাসের শুরুতে বীজ বুনন শুরু করেন। জুমে ধানের পাশাপাশি মরিচ, মিষ্টি কুমড়া, ভুট্টা, যব, মারফা (পাহাড়ী শশা), ছিনারগুলা (পাহাড়ী মিষ্টিফল), তুলা, টকপাতাসহ রকমারী কৃষিপণ্যের চাষ করে থাকেন।
উল্লেখ্য, জুমিয়া পরিবারগুলো ঐতিহ্যগতভাবে পাহাড়ের একই জায়গায় বার বার জুম চাষ করে না। অন্তত দুই/তিন বছর বিরতি দিয়ে পুনরায় ওইসব জায়গায় জুম চাষ করেন। প্রতিবছর নতুন নতুন পাহাড় খুঁজে জুম চাষের জন্য পাহাড় কাটা হয়। তাদের ঐতিহ্যের ধারায় জুম চাষের ফলে পাহাড়ের বনজঙ্গল ক্ষতি হলেও জুমিয়া পরিবারগুলোকে বিকল্প পেশা তৈরিতে সরকারী-বেসরকারী কোন উদ্যোগ আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি।
পাহাড়ী নেতার জানান, জুম চাষ ঐতিহ্যগত ভাবে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বেশিরভাগ পাহাড়িরা জুমচাষের ওপর নির্ভর করে। প্রতি বছর এ জুম চাষ হয়ে থাকে। প্রকৃত যারা জুমচাষী তারা কখনো বড় গাছপালা কাটে না। শুধুমাত্র যে গাছগুলো কাটার প্রয়োজন সেগুলোই কেটে থাকে ।
এদিকে, আদি পদ্ধতিতে জুম চাষের ফলে পাহাড়ের গাছপালা ও জঙ্গল কেটে ধ্বংস করা হচ্ছে। জুম চাষের মাধ্যমে পাহাড়িরা সারা বছরের খাদ্যশস্য গড়ে তুলতে পারলেও দেখা গেছে জুমিয়া পরিবার গুলো ৫ একর পাহাড়ি ঢালু জমিতে জঙ্গল পরিষ্কারের পর আগুন দিলেও পার্শ্ববর্তী আরও ১০/১৫ একর অনাবাদী পাহাড়ের গাছপালা পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
পার্বত্য অঞ্চলের জুমচাষ গবেষক জুমলিয়ান আমলাই বলেন, পাহাড়ে চাষের জন্য জুমের বিকল্প নেই। ঐতিহ্যবাহী জুমচাষকে কেন্দ্র করে এ এলাকার সংস্কৃতি বা পরিবেশগত ভারসাম্য গড়ে উঠেছে।এখানে সংরক্ষিত বনাঞ্চল সৃষ্টির ফলে জুমচাষের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাছাড়া, জুম চাষের ক্ষেত্র এবং জুমের ফসলগুলো উৎপাদন শক্তি হ্রাস পাওয়ায় জুমচাষীরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। অতি সম্প্রতি পরিবেশগত দিক থেকেও জুমচাষীরা নানা ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে,জুম চাষের ফলে প্রতি বছর পার্বত্যাঞ্চলের হাজার হাজার একর বনভূমি ধ্বংস হতে চলেছে। এতে বিপন্ন হয়ে পড়ছে পার্বত্যাঞ্চলের প্রাণী বৈচিত্র জুমের চাষের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য মারাত্মক বিপর্যয় ঘটলেও পরিবেশবাদীদের মতামত কিংবা কার্যকরী কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। মানবিক কারণে সরকারও পাহাড়িদের জুম চাষে আইন প্রয়োগে উৎসাহী নয়।
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ সূত্রে জানাযায়, জুম চাষের উপকারের চেয়ে ক্ষতিই হচ্ছে বেশি। জুমচাষে পাহাড় পোড়ানোর ফলে মাটির উর্বরতা কমে যায়। ভবিষ্যতে জুম চাষের ফলে মাটি ক্ষয়ের কারণে পাহাড় আর থাকবে না। পাহাড়ের জুমচাষী কৃষকদের উদ্দেশ্যে বলেন,জুম চাষ না করে যদি বিভিন্ন ফলের বাগান করা যায় তাহলে পাহাড়ের কোন ক্ষতি হবে না।
সচেতন মহলের মতে, বিশাল পাহাড়ী জনগোষ্ঠীকে জুম চাষের বিকল্প আয়ের সংস্থান করে দিলে প্রতি বছর হাজার হাজার একর বনভূমি রক্ষা পাবে। সেই সাথে পার্বত্যাঞ্চলের বিপন্ন প্রাণীকুল ও প্রাকৃতিক পরিবেশ জনবসতির অনুকূলে আসতে পারে। অন্যতায়, প্রতিবছর এ পদ্ধতিতে জুম চাষের ধারা বজায় থাকলে সবুজের ঢাকা পাহাড় রূপ নেবে মরুময়তায়।