পাহাড়ে প্রাণহীন বৈসাবি উৎসব
পাহাড়ে শুরু হলো প্রাণের উৎসব বৈসাবী। পাহাড়-হ্রদ আর অরণ্যের শহর রাঙামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ে বর্ষবিদায় এবং বর্ষবরণের মহান উৎসব, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের প্রাণের উৎসব ‘বৈসাবি’। চাকমাদের ভাষায় এ উৎসবকে বিঝু, ত্রিপুরাদের ভাষায় বৈসুক এবং মারমাদের ভাষায় সাংগ্রাই এবং তংচঙ্গ্যাদের ভাষায় বিসু এবং অহমিয়াদের ভাষায় বিহু নামে আখ্যায়িত করা হয়। তিন সম্প্রদায়ের প্রাণের এই উৎসবের নামের আদ্যক্ষর নিয়েই তাই এই মহান উৎসবকে বলা হয় ‘বৈসাবি’ উৎসব।
কিন্তু আজ থেকে পাহাড়ে শুরু হওয়া তিনদিনের বৈসাবী উৎসবে এবার যেন প্রাণ নেই। পাহাড় জুড়ে সর্বত্র যেন আতংক বিরাজ করছে। সারা বিশ্বব্যাপী মরণঘাতী করোনাভাইরাসের কারনে পাহাড়ের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষের মাঝে এবার বৈসাবি উৎসবের পালনের তেমন কোন প্রস্তুতি নেই বললেই চলে।
বিগত বছরগুলোতে পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাধারণ মানুষেরা এ উৎসব শুরু হওয়ার প্রায় দশ থেকে পনের দিন আগে থেকে যেই উৎসাহ -উদ্দীপনা নিয়ে বৈসাবী পালনের জন্য প্রস্তুত হতো এবার কিন্তু সেই আমেজটা করোনার কারনে ম্লান হয়ে গেছে।
বিভিন্ন উপজেলায় যোগাযোগ করেও জানা গেছে, সেখানেও বৈসাবির লেশমাত্র নেই। জেলার লংগদু, নানিয়ারচর, জুড়াছড়ি, বরকল,
তবুও মন খারাপ করা সকালে ধর্মীয় ও সামাজিক রীতির অংশ হিসেবে কেউ কেউ পানিতে ভাসিয়েছেন বিজুর ফুল। সামাজিক বা এলাকাবাসির উদ্যোগে নয়, ব্যক্তিগতভাবেই কেউ কেউ পালন করছেন সামাজিক নানা রীতি।
তিন দিন ব্যাপী এই উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমা ভাষায় ফুল বিঝু, দ্বিতীয় দিনকে ‘মূল বিঝু’ এবং তৃতীয় দিনকে ‘নুয়াবঝর’ বা ‘গোজ্যা পোজ্যা দিন’বলা হয়। এভাবেই ত্রিপুরারা প্রথম দিনকে ‘হারিকুইসুক’ দ্বিতীয় দিনকে ‘বুইসুকমা’ এবং তৃতীয় দিনকে ‘বিসিকাতাল’ নামে অভিহিত করে থাকে।
এ প্রসঙ্গে সংস্কৃতি কর্মী প্রণব ত্রিপুরা বলেন, এবারের বৈসাবি উৎসবে পাহাড়ের মানুষের মাঝে কোন আনন্দ নেই, নেই কোন সামাজিক আচার অনুষ্ঠান। এবছর শুধু আমরা নিজেদের পরিবার পরিজন নিয়ে ঘরে থেকেই কোনভাবে এ উৎসব পালন করবো।
এদিকে, রাঙামাটির সাংবাদিক সুপ্রিয় চাকমা শুভ বলেন, আমরা প্রতিবছর নিজের একটি প্রতিষ্ঠান, হিলর প্রোডাকশনের আয়োজনে বিশাল আকারে ফুল বিজু উৎসবের মধ্যে বিজুকে আমন্ত্রণ জানাতাম। নিজ সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে ফুল ভাসিয়ে পরের দিনে অর্থাৎ মুলবিজু দিনে ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়াতাম। এমনকি চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী খেলা-ধুলা আয়োজন করতাম।
কিন্তু প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসের কারনে এবছরে তা করা হচ্ছে না সাংগঠনিকভাবে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে সীমিত পরিসরে নিজ নিজ বাড়িতে খানাপিনার আয়োজন করা হয়েছে। কয়েকজন ছোট ছেলে-মেয়েদের নিয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে নদীতে ফুল ভাসানো হয়েছে।
এদিকে, রাঙামাটি শহরের ত্রিপুরাপল্লী খ্যাত গর্জনতলীতেও এবার করোনাভাইরাসের কারনে নদীতে ফুল ভাসানোর কোন অনুষ্ঠান হয়নি। রাঙামাটি ত্রিপুরা কল্যাণ ফাউন্ডেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ঝিনুক ত্রিপুরা বলেন, আমরা এবার প্রাণহীন বৈসুক পালন করছি। সবাই ব্যাক্তিগতভাবে সকালে সীমিত পরিসরে ফুল ভাসিয়েছে মা গঙ্গার উদ্দেশ্যে।
তিনি আরো বলেন, আমরা প্রতিবছর ঘরেঘরে যে পাঁজন রান্না করি করোনাভাইরাসের কারনে ঐ পাঁজনের সব তরকারীও বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না।
অপরদিকে, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম পার্বত্যাঞ্চল শাখার সদস্য সচিব ইন্টু মণি তালুকদার বলেন, এবারও আমরা পাহাড়ের বৈসাবি উৎসব পালনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলাম কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারনে এবং সরকারিভাবে সকল ধরনের অনুষ্ঠান বাতিলের প্রজ্ঞাপনের পর আমরা আমাদের বৈসাবি উৎসবের অনুষ্ঠান বাতিল করেছি।