মানিকছড়িতে হালদার উজানে তামাক চাষ, বিষপ্রয়োগে হুমকির মুখে জলজপ্রাণি ও পরিবেশ

fec-image

এশিয়া মহাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র ও বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হালদা নদীর উজানে সম্প্রতি আবারও বিষবৃক্ষ তামাকের অবাধ চাষাবাদে হালদার পরিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়েছে। স্কুল-মাদরাসার ওয়াল ঘেঁষে গড়ে উঠা তামাকে নিয়মিত কীটনাশক প্রয়োগে প্রতিষ্ঠানে গড় অনুপস্থিত বেড়ে গেছে। অন্যদিকে সবুজ বৃক্ষ কেটে তামাকের চুল্লিতে পাতা পুড়ানোর মহোৎসবের চলছে ধুমধাম আয়োজন। অথচ ২০১৬ সালে হালদা নদীর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি হালদা উৎসের পোনার বাজার সম্প্রসারণ শীর্ষক ভ্যালু চেইন উন্নয়ন প্রকল্প চালু করেছে সরকার। এতে সরকারি উন্নয়ন সংস্থা পল্লী-কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) অর্থায়নে তামাক বিকল্প চাষাবাদে কাজ করছে ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ)। এর পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন কৃষকদের কৃষি প্রণোদনা দিয়ে তামাক বিকল্প চাষাবাদে এগিয়ে আসে। এর ফলে ২০২১ সাল নাগাদ খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলায় তামাক চাষ শুন্যের কোটায় নেমে আসলেও সম্প্রতি আবারও সেকালে ফিরে গেছে এখানাকার অধিকাংশ কৃষক। ৩৭ হেক্টর জমিতে তামাক আবাদ হলেও কৃষি অফিসের রেকর্ডে তথ্য শুন্য।

সরেজমিন ও পিকেএসএফ সূত্রে জানা গেছে, এশিয়া মহাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র ও বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হালদা নদীর উজানে সম্প্রতি আবারও বিষবৃক্ষ তামাকের অবাধ চাষা হয়েছে। মানিকছড়ি উপজেলার যোগ্যছোলা, আসাদতলী, গোরখানা, ছদুরখীল, তুলাবিল, কালাপানি এলাকায় অন্তত ৩৭ হেক্টর জমিতে অবাধে তামাক লাগিয়ে হালদার পরিবেশ বিষাক্ত ও সবুজ বৃক্ষ নিধনে নেমেছে স্বার্থান্বেষী একটি চক্র। গোরখানার ঝন্টু মিয়া, আবুল কালাম, আবদুল মালেক, আসাদতলীর আবদুল মন্নান, আবদুল মতিন ও কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৪ জন কৃষক চলতি মৌসুমে হালদার দুকূলে ৩৭ হেক্টর কৃষি ও ফসলি জমিতে তামাক লাগিয়েছে। শুধু তাই নয় যোগ্যাছোলা উচ্চ বিদ্যালয়, যোগ্যাছোলা সুন্নিয়া দাখিল মাদরাসা ও শাহানশাহ হক মাইজভান্ডারি সুন্নিয়া দাখিল মাদরাসার মাঠ ঘেঁষা জমিতেও তামাক চাষ করতে পিচপা হয়নি ওই চক্রের সদস্যা। সম্প্রতি তামাক খেতে বিষ প্রয়োগ শুরু হওয়ায় ঔষধের গন্ধে শ্রেণিতে উপস্থিতির হার কমে গেছে।

বৃহস্পতিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) সকালে যোগ্যাছোলা উচ্চ বিদ্যালয় ও সুন্নিয়া দাখিল মাদরাসা গিয়ে দেখা গেছে, দুই প্রতিষ্ঠানের ভবন ঘেঁষে সৃজন করা হয়েছে তামাক। ৩/৪ দিন আগে ঔষধ ছিটানো হয়েছে তামাক খেতে। ঔষধের গন্ধে স্কুল, মাদরাসার শিক্ষার্থীরা জানালা ও দরজা বন্ধ করে পাঠ করছেন। এ সময় ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী সীমা আক্তার জানান, ঔষধের গন্ধে ক্লাস করা দায়। গত ৩/৪ দিনে অনেকে বমি করে অসুস্থ হয়ে স্কুলেও আসতে পারছেনা। মাদরাসার শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ জানান, তামাক খেতে ছিটানো ঔষধের গন্ধে আমরা টিউবওয়েল পানি খেতে যেতেও কষ্ট হয়। সিনিয়র শিক্ষক মাওলানা মো. আবদুল গফুর তামাকের বিষাক্ততায় শিক্ষার্থী অসুস্থের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, গত কয়েক দিনে স্কুলে উপস্থিত কমে গেছে!

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গোরখানার ঝন্টু মিয়া বলেন, আমি এবার নিজে তামাক করিনি। জমি বর্গা দিয়েছি। তিনি জানান, প্রতি ৪০ শতক জমিতে তামাক চাষে খরচ হয় ৩০-৩৫ হাজার টাকা। পরিচর্যা ভালো হলে এতে প্রায় দেড় লাখ টাকা বিক্রি। ১ নম্বর শুকনো পাতার কেজি ২০০ টাকা হারে ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো নিবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

আসাদতলীর আবদুল মন্নান জানান, তিনি ২ একর জমিতে তামাক চাষ করেছেন। পাতা পরিপক্ক হওয়া পর্যন্ত ব্যয় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। চুল্লি তৈরিতে ব্যয় ১ লাখ টাকা। প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ৪৫ মণ কাঠ জ্বালিয়ে ২৫০ কেজি পাতা শুকানো সম্ভব। এভাবে মাসে ৪/৫ বার চুলায় আগুন জ্বালিয়ে তামাক পাতা শুকানোর জোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। তামাক পাতা ভালো হলে ব্যয়ের অর্ধেকেরও বেশি লাভ হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৩৭ হেক্টরে চাষ হওয়া তামাক পাতা পুড়ানোর জন্য ইতোমধ্যে ১৫টি চুল্লি তৈরি হয়েছে। এসব চুল্লিতে ২৪ ঘণ্টায় ৬৭৫ মণ কাঠ পুড়ানো হবে! আগামী দুই মাসে অন্তত ৪০ থেকে ৪৫ হাজার মণ কাঠ পুড়ানো হবে। এভাবে পাহাড়ের সবুজ বনাঞ্চল ধ্বংস, হালদার বিপন্নে নেমেছে সংঘবদ্ধ চক্র। এ বিষয়ে খাগড়াছড়ি বনবিভাগের গাড়িটানা রেঞ্জের বন কর্মকর্তা উহ্লামং চৌধুরী বলেন, কাঠ পুড়িয়ে তামাক পাতা শুকানোর আইনগত সুযোগ নেই। অচিরেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাসিনুর রহমান বলেন, অফিসিয়ালি উপজেলায় তামাক চাষের কোন তথ্য নেই। এ বিষয়ে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা ছাড়া কৃষিবিদদের করণীয় কিছু নেই। আমরা কৃষকদের পরিবেশবান্ধন চাষাবাদে উৎসাহ, প্রণোদনা দিয়ে থাকি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো বাংলাদেশ খাগড়াছড়ি দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা নউরজ বিন রেজা মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। আইডিএফের হালদা প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, তামাক চাষে যে পরিমাণ রাসায়নিক, কীটনাশক ব্যবহার হয়। তাতে হালদার পানি দূষিত, মাটির উর্বরা শক্তি হ্রাস ও ক্ষয় বৃদ্ধি পায়। ফলে জনস্বাস্থ্য, জলজপ্রাণি হুমকিতে পড়ে এবং পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিচার্স ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক অধ্যাপক মো. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, হালদা আমাদের জাতীয় সম্পদ ও ঐতিহ্য। এই হালদা বছরে কমপক্ষে ৮০০ কোটি টাকা জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। অথচ একশ্রেণির মানুষ অর্থলোভে পরিবেশ ও জীবন ধ্বংসকারী তামাক চাষ করে জনস্বাস্থ্য ও জলজপ্রাণির বিষম ক্ষতি করছে। তামাক বিকল্প চাষাবাদে জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধিসহ হালদা রক্ষায় দ্রুত আইন প্রণয়নে জরুরি পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন