মিয়ানমারের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর বড় দুর্বলতা কোনটি?

fec-image

যুদ্ধ মানব সভ্যতার অভিশাপ। কিন্তু যুদ্ধকে কখনো এড়ানো যায়নি। ভবিষ্যতেও যাবেনা। তার মানে এই না যে যুদ্ধ নিয়ে ফ্যান্টাসিতে ভুগতে হবে। যুদ্ধে পরাজয়ের বড় কারণ হল ফ্যান্টাসিতে ভোগা। যুদ্ধের বাস্তবতা যখন বাস্তব জীবনে পড়ে তখন আমাদের বোধোদয় হয় যে কতটা নির্মম হতে পারে এর পরিনতি।

যাই হোক, যুদ্ধ জয়ে প্রধান ভূমিকা কোনটি সেটা নিয়ে নানা বিতর্ক হতে পারে। তবে যুদ্ধ কৌশল এবং প্রয়োজনীয়তা বিশ্লেষণ করতে গেলে ইতিহাসের আশ্রয় নিতে হয়।

ইতিহাস সম্পর্কে আমার ধারণা গভীর নয়, তবে যতটকু উপলব্ধি তার সারসংক্ষেপ:

১. যুদ্ধের জয় পরাজয় নির্ধারণের সৈন্য সংখ্যা, অস্ত্র, চেইন অব কমান্ড, সাপ্লাই চেইন (নিরবিচ্ছিন্ন রশদ সাপ্লাই ও অন্যান্য), ভৌগলিক অবস্থান, কৌশল, ভাগ্য, মোরাল বা যুদ্ধের যৌক্তিকতা এরকম অনেক গুলি উপাদানের ভূমিকা রয়েছে।

২. যুদ্ধে শিউর প্রুফ বা ফুল প্রুফ প্লান বলে কিছু নেই।

এবার আসা যাক ব্যাখায়। ধরুন যুদ্ধের পক্ষ বিপক্ষের কার শক্তি কেমন এমনটা কখনোই কার সৈন্য সংখ্যা কত, কার কাছে কত ভারী অস্ত্র আছে এগুলার উপর নির্ভর করেনা। সংখ্যাতাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় যুদ্ধ জেতা যায় না। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার এর র‍্যাংকিং এ এগিয়ে থাকা বা পিছিয়ে থাকা যুদ্ধের জয় পরাজয়ে ভূমিকা রাখেনা।

ইতিহাসে বহু প্রমাণ আছে লক্ষাধিক সৈন্যদল আনুপাতিক অনেক ছোট সৈন্যদলের কাছে পরাস্ত হয়েছে। উপমহাদেশের পানিপথের যুদ্ধ, সেলযুগের আলোপ আর্সালানের রোম সম্রাটকে পরাস্ত করা, ক্ষুদ্র উয়ে রাজ্যের দ্বারা শক্তিশালী য়ু রাজ্যের পরাজয় এরকম অনেক উদাহরণ আছে। সান জু এর আর্ট অব ওয়ার মুখস্থ করে ফেললেও যুদ্ধের জয় নিশ্চিত এমন বলা যায়না। সান জু নিজেও চেষ্টা করে য়ু রাজ্যকে বাঁচাতে পারেননি। তবে তার বই টিকে গেছে।

বার্মার প্রসঙ্গে আসি। বার্মা সামরিক শক্তিতে সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাবে আমাদের থেকে অনেক শক্তিশালী সেটা না মানার সুযোগ নেই। তবে বার্মার কিছু ভয়ানক দুর্বলতা রয়েছে যার জন্য যুদ্ধে নিশ্চির জয় তাদের জন্য কঠিন হতে পারে।

এর ভেতর প্রধানতম কারণ হল, জনসমর্থন না থাকা। বার্মায় এথনিক গ্রুপ অনেক। এক ডজনের বেশি বিচ্ছিন্নতাবাদী সক্রিয় সেদেশে। শুধু আরাকান আর্মি নয়, সেখানে কাচিন, শান, আরসাসহ অনেক গোষ্ঠীর সাথে সামরিক জান্তার যুদ্ধ যুগের পর যুগ চলছে।

কোন দেশের যুদ্ধ জয়ের নিয়ামক হতে পারে যদি জনসমর্থন থাকে। পুতিন রিজার্ভ সোলজার কল করার ঘোষণার পরে ওয়ান ওয়ে এয়ার ট্রাফিকের ফুটেজ দেখে মনে হয়েছে যে যেভাবে পারছে রাশিয়া ত্যাগ করার চেষ্টা করছে। পুতিন যেভাবে ন্যাটোর হুমকি অনুভব করছে সেভাবে যদি প্রতিটা রুশ নাগরিক অনুভব না করে তবে পরাশক্তি হলেও যুদ্ধে নিশ্চিত জয়ের সম্ভাবনা কমে যেতে পারে। আফগানিস্থান ভাল একটা উদাহরণ। তবে আমেরিকার ভিয়েতনাম অভিযান এর সব থেকে বড় উদাহরণ। আপনার অনেক শক্তি আছে, কিন্তু আপনার জনগন দ্বিধান্বিত তখন আপনার সফলতার সম্ভাবনার পারদ নিচের দিকে নামতে থাকবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অনেক জার্মান অনুশোচনা করেছিল। তারা ভাবতেই পারেনি নাৎসিরা কী কী কর্মকাণ্ড করেছে। হিটলারের সবথেকে বড় যোগ্যতা যদি থাকে সেটি হল জার্মানদের যুদ্ধের পক্ষে একত্রিত করা। পুরো জাতি যেন হিপনোটাইজ হয়ে গিয়েছিল। আর এই ধারায় আগুনে মদ ঢালছে প্রাথমিক সফলতা। মোমেন্টাম গুরুত্বপূর্ণ। জার্মানদের মোমেন্টামের থেকেও বড় উদাহরণ হল মঙ্গল এম্পায়ার। চেঙ্গিসকে অনুকরণ করার চেষ্টা করলেও কুবলাই খান কিন্তু চেঙ্গিস হতে পারেন নি।

নিজ দেশের জনসমর্থন এজন্যই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি নিজ দেশের মানুষকে যুদ্ধের পক্ষে শক্তভাবে সমর্থন আদায় করতে না পারেন তাহলে যুদ্ধ শুরু করাই উচিত হবে না। বার্মার জাতিগত বিভক্তি হল বার্মার সবথেকে দুর্বল পয়েন্ট। সেদেশের সামরিক সরকারের উপর সাধারণ মানুষের আস্থা নেই। আতঙ্কিত জান্তা নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে নিজ দেশের মানুষের বিরুদ্ধেই শক্তি প্রয়োগ করছে। এরকম ক্ষেত্রে প্রায় দেখা যায় বার্মিজ সৈন্যদের অনেকেই বিদ্রোহী দমন না করে উলটা বিদ্রোহীদের সাথে হাত মেলাচ্ছে। এটা সেদেশের সামরিক বাহিনীর দুর্বল চেইন অব কমান্ড ও দুর্বল ভীত্তির প্রকাশমাত্র।

যুদ্ধ ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা জরুরি। চেইন অব কমান্ড জরুরি। বার্মার চার লক্ষাধিক সেনা থাকলেও সেটি সংখ্যার হিসাবে বা পরিসংখ্যানে বার্মাকে এগিয়ে রাখবে কিন্তু এরকম সেনাদলকে খুব সহজেই পরাজিত করা যায়। জোর করে কিছু হয়না। যৌক্তিক কাজের ক্ষেত্রেও যদি কাউকে মাসেল পাওয়ার দেখিয়ে জোর করে কিছু করানোর চেষ্টা করা হয় তখন অনিচ্ছা জন্মায়। বার্মার ক্ষেত্রে যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে স্পষ্ট যে বার্মিজ সেনাদের ভেতরের লোকজন বিদ্রোহীদের কাছে অর্থের বিনিময়ে অস্ত্র, স্পর্শকাতর তথ্য সরবরাহ করছে। এরুপ সেনাবাহিনীর সাথে হয়ত বার্মিজ বিদ্রোহীরাই ঠিক আছে। বিদ্রোহীদের হাতেই তারা একে একে সেনা ক্যাম্প ছেড়ে পালাচ্ছে। এটা তাদের যুদ্ধের জন্য যেই নৈতিক শক্তি লাগে সেটার ঘাটতির বহিঃপ্রকাশ।

ব্রিটিশরা উপমহাদেশ ডিভাইড এন্ড রুল ভিত্তিতে সহজে জয় করে। হিন্দু মুসলমানকে একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করে অবিশ্বাস সৃষ্টি করে। একতার যে শক্তি সেটাকে সবার আগে দুর্বল করে। বার্মায় একতার ঘাটতি রয়েছে যথেষ্ট।

কিছুদিন আগেও বার্মিজ হেলি থাইল্যান্ডের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছিল। থাইল্যান্ডের স্কুলের বাচ্চারা ভয়ে পালিয়েছিল। থাইল্যান্ড কিন্তু মাথা গরম করেনি। তারা বৃহৎ প্রেক্ষিত কম বুঝেনা। আমাদের ক্ষেত্রে হুট করে যুদ্ধ নিয়ে ফ্যান্টাসি বন্ধ করা উচিত।

তবে অবশ্যই সম্ভাব্য শত্রুর সামরিক শক্তি বিবেচনায় নিয়ে নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। শান্তি ও স্থিতিশীলতা থাকে তখন যখন আমার হাতেও বন্দুক আছে আমার শত্রুর হাতেও আছে। যদি এমন হয় যে আমার হাতে বন্ধুক আছে কিন্তু আমার শত্রুর হাতে নেই তখন অশান্তি ও অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হতে পারে। অথবা যদি এমন হয় দুজনের কাছেই বন্ধুক আছে কিন্তু একজনের কাছে পর্যাপ্ত বুলেট নেই সেক্ষেত্রেও একি পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। আর এজন্যই ভারসাম্য নষ্ট যাতে না হয় সেই পরিমান বিনিয়োগ সামরিকখাতে করা জরুরি। তবে পাকিস্তানের মত খেয়ে না খেয়ে নয়। সম্পদের সঠিক ব্যাবহার জরুরি। ঝুকি কমানে যেমন আমরা ইন্সুরেন্স করি, সামরিক খাত হল অর্থনীতির জন্য তেমন ইন্সুরেন্স খরচ। প্রতিবছর বাজেটের পর বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশকে এখাতে বিনিয়োগের বিরুদ্ধে সোচ্চার দেখা যায় যেটি কাম্য নয়। শান্তির জন্য ভারসাম্য জরুরি। আমাদের সেটা ভুলে গেলে চলবে না। হোক সেটা অর্থনীতির সাথে সামরিক সক্ষমতার ভারসাম্য অথবা প্রতিবেশির সামরিক ক্ষমতার সাথে আমাদের ভারসাম্য।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: মিয়ানমার, সেনাবাহিনী
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন