রোহিঙ্গাদের দোকানে শোভা পায় না বাংলাদেশের কোনো পণ্য
ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের একটি অংশ। মাত্র দুই বছরেই রোহিঙ্গাদের অনেকেই বনে গেছে কোটিপতি। স্থানীয় লোকজনের কোটি কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য নানা কৌশলে তারা হাতিয়ে নিয়েছে। ঘুরে পিলে চমকানো এসব তথ্য জানা গেছে। আরো উল্লেখযোগ্য যে তথ্যটি পাওয়া গেছে, তা হচ্ছে বাংলাদেশের মাটিতে গড়া ৩২টি শিবিরের রোহিঙ্গাদের দোকানগুলোতে এ দেশের কোনো পণ্য শোভা পায় না। এরা এমনই ‘দেশপ্রেমিক’ যে মিয়ানমার থেকে নিত্যব্যবহার্য পণ্য এনে দোকানে তোলে।
জানা গেছে, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে স্থানীয় লোকজনই শুধু দেশের চলমান আইনের আওতায় রয়েছে। স্থানীয় লোকজনের দোকানপাট ও প্রতিষ্ঠানে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে ভেজাল-অনিয়মের জন্য জরিমানাসহ শাস্তি দেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা যত অন্যায়ই করুক না কেন, শাস্তির আওতায় আসে না। এমন অভিযোগ আর ক্ষোভ ঝেড়েছে স্থানীয় লোকজন। তারা বলছে, দাপটের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করে শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি করে টাকার পাহাড় গড়ছে রোহিঙ্গারা। এ রকম অবস্থায় রোহিঙ্গারা দেশে ফিরে যেতে চাইবে কেন?’
কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে শুধু একটি রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরেই এক ডজনেরও বেশি কোটিপতি রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীর খোঁজ মিলেছে। উখিয়া উপজেলার বালুখালী রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরকেন্দ্রিক এ ব্যবসায়ীরা মিলে রাখাইনের একটি প্রসিদ্ধ বাজারের নামে এখানেও গড়ে তুলেছে ‘বলি বাজার’। রাখাইনের বলি বাজারটির আদলেই করা হয়েছে দোকানপাটও। প্রথম দর্শনে মনেই হবে না তেমন একটা কিছু। কিন্তু একটু খোঁজ নিলেই জানা যাবে বাজারটির দোকানিরা সবাই কোটি কোটি টাকার মালিক।
কক্সবাজার-টেকনাফ শহীদ এ টি এম জাফর আলম আরাকান সড়কের বালুখালী বাজার থেকে বালুখালী ১ নম্বর রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের প্রবেশপথেই বলি বাজারের অবস্থান। এ বাজারের ২০০ দোকানে অন্তত ১০০ থেকে ২০০ কোটি টাকার পণ্যসামগ্রী রয়েছে বলে জানা গেছে। এসবের বিক্রেতা ও ক্রেতাদের সবাই রোহিঙ্গা।
বালুখালীর স্থানীয় বাসিন্দা গফুর উল্লাহর মালিকানাধীন জমিতে তোলা ওই দুই শতাধিক দোকানে বিক্রির বেশির ভাগ পণ্যই মিয়ানমার, চীন ও থাইল্যান্ডে তৈরি। জমির মালিক গফুর উল্লাহ বাজারের দোকান থেকে প্রতি মাসে আয় করেন পাঁচ লক্ষাধিক টাকা। বলি বাজারটির পাশে রয়েছে আরো একটি বড় বাজার। সেই বাজারেও কোটিপতির সংখ্যা নেহাত কম নয়। বিসমিল্লাহ স্টোর নামের একটি দোকানের মালিক হচ্ছেন রোহিঙ্গা জাহাঙ্গীর। তিনি বালুখালীতে বসেই মিয়ানমার-টেকনাফ সীমান্ত বাণিজ্যের নামে পণ্য আমদানি করেন টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে। টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে এ দেশে গরু আনার ব্যবসাও এখন একচেটিয়া তাদের দখলে।
একই এলাকার ‘ছাদেক স্টোরে’ কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছেন রোহিঙ্গা ইদ্রিস। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী একজন ব্যক্তি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালাতে গেলে তাকে দেশের নাগরিকত্ব, জাতীয়তা সনদ, হোল্ডিং ট্যাক্স, জমির হালনাগাদ খাজনা আদায়ের প্রমাণপত্রসহ অনেক কিছুর প্রয়োজন হয়, কিন্তু রোহিঙ্গাদের এগুলোর কিছুই নেই। তবে ক্ষেত্রবিশেষে তারা একদম ফ্রি স্টাইলে কম্পিউটারের মাধ্যমে তৈরি করা ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করেই ব্যবসা করে যাচ্ছে। টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে এসব রোহিঙ্গা ব্যবসায়ী মিয়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুন, বিভাগীয় শহর আকিয়াব ও মহকুমা শহর মন্ডু থেকে পণ্যসামগ্রী সীমান্ত বাণিজ্যের আওতায় নিয়ে আসছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীরা টেকনাফের স্থানীয় সীমান্ত বাণিজ্য ব্যবসায়ীদের নামে ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্সির মাধ্যমেই মিয়ানমার থেকে পণ্য আমদানি করছে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের বাসিন্দা হওয়ায় তারা সে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ লাভ-লোকসানের হেরফের এখানকার ব্যবসায়ীদের চেয়ে বেশি জানে। এ কারণে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে আমদানি করা পণ্যসামগ্রী বিক্রি করতে আগ্রহী বেশি। বলি বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, দোকানগুলো চায়নিজ ও মিয়ানমারের শার্ট, লুঙ্গি, প্যান্ট, ছাতা থেকে শুরু করে মোবাইল ফোনসেটসহ ইলেকট্রনিক পণ্যে সাজানো। আছে মিয়ানমারের আচার, জুতা-স্যান্ডেল, সুপারি, ছাতা। দোকানগুলোতে বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি হওয়া কিছু বোরকা ও থান কাপড় দেখা গেছে।
বালুখালীর বলি বাজারে রোহিঙ্গা সিরাজ একজন বড় মাপের ব্যবসায়ী। তবে দোকানে তাঁকে কম দেখা যায়। তাঁর স্বজনরাই দোকান চালায়। বলি বাজারে রয়েছে ওসমান, আলী মিয়া, আনোয়ার শাহ, নাসেরসহ আরো কয়েকজন রোহিঙ্গা কোটিপতি। এসব দোকানির কারো কাছে কোনো ট্রেড লাইসেন্স নেই। তাদের দিতে হয় না কোনো রাজস্বও। এ জন্য দিন দিন তারা ব্যবসার লাভে ফুলে উঠছে; আর স্থানীয় ব্যবসায়ীরা হয়ে পড়ছে কোণঠাসা।
সূত্র: কালের কণ্ঠ