‘রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আরসার সম্পর্ক নেই’

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

কীভাবে তাঁর আশপাশের গ্রামের নিরীহ রোহিঙ্গাদের নৃশংসভাবে সেনাবাহিনী হত্যা করেছে, এর অনেক ঘটনা তিনি দেখেছেন। এমন অবস্থার মধ্যেও তিনি মাতৃভূমি ছেড়ে আসতে চাননি। ভেবেছিলেন হয়তো পরিস্থিতি শান্ত হবে। নিরাপদে বসবাস করতে পারবেন। কিন্তু ৯ সেপ্টেম্বর যখন তাঁর নিজের গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, তখন বাধ্য হয়েই গ্রামের অনেক লোককে সঙ্গে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তিনি দেশ ত্যাগ করেন।

কিন্তু তিনি নিজ দেশে ফিরে যেতে চান। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর আহ্বান, অতি সত্বর মিয়ানমার সরকারকে তারা যেন চাপ দেয়, যেন রোহিঙ্গারা তাদের অধিকার ফিরে পায়। নিজেদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারে।

রাজনৈতিকভাবে সচেতন শিক্ষিত এই ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ ইসমাইল। তিনি মিয়ানমারের রাখাইনের রাথেডংয়ের বাসিন্দা। স্থানীয় একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। গত শুক্রবার তিনি টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তে আসেন। গতকাল শনিবার তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তিনি ইংরেজিতে  এই সাক্ষাৎকার দেন।

ইসমাইল বলছিলেন, কোনোভাবে মাতৃভূমি ছেড়ে আসতে মন চাইছিল না। কিন্তু আর সেখানে থাকা সম্ভব নয়। একের পর এক রোহিঙ্গাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তাঁদের পাশের দুটো গ্রামে গণহত্যা চালিয়ে ৬০০ নিরীহ লোককে হত্যা করা হয়েছে। নারীদের গণধর্ষণ করা হচ্ছে।

ইসমাইলের তথ্যমতে, তিন মাস ধরে কোনো রোহিঙ্গা তাঁর নিজ গ্রামের বাইরে অন্য কোনো গ্রামে যেতে পারেনি। যারা গেছে, তাদের নির্যাতন করা হয়েছে। তার নিজের গ্রামের দুজনকে হত্যা করা হয়েছে। আর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর হামলার পর গত ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের ওপর চলছে ভয়াবহ নির্যাতন।

আরসা নামের জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে কোনো রোহিঙ্গার সম্পর্ক নেই দাবি করে ইসমাইল বললেন, ‘অং সান সু চির সরকার মিথ্যাভাবে রোহিঙ্গাদের দোষ দিচ্ছে। সরকার বলছে, আরসার সঙ্গে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী জড়িত। সত্যটা হলো, আমরা আরসাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করি। আমরা রোহিঙ্গারা মুসলিম, আমরা সন্ত্রাসী না। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আরসার সম্পর্ক নেই। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগসাজশের ধুয়ো তুলে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গা নিধন করছে। দয়া করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের সাহায্য করুন। আমাদের বাঁচান।’

গত ২৫ আগস্ট আরাকানের পুলিশ তল্লাশিচৌকিতে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা নামে একটি সংগঠন হামলা চালায়। এ হামলার পরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন শুরু করে।

রোহিঙ্গার সমস্যাকে জাতিগত সমস্যা আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ‘আমরা রাখাইন রাজ্যের আদিবাসী। অথচ মিয়ানমার সরকার তা স্বীকার করে না। উল্টো সরকার রাখাইন রাজ্যে দ্বৈত নীতি চালু করেছে। রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করেছে। রোহিঙ্গাদের ওপর দোষ চাপিয়ে অং সান সু চির সরকার বাস্তবে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করাচ্ছে। আমরা মুসলিম। তাই রাখাইন মুসলিমশূন্য করতে চাইছে সরকার।’

রোহিঙ্গা নিধনের নেপথ্যের কারণ জানতে চাইলে ইসমাইল বললেন, রাখাইনে আছে অফুরন্ত গ্যাস। সেখানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে সরকার। মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ভারতও মিয়ানমারকে সহযোগিতা করে। এ কারণে রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করছে সরকার।

এবার নিয়ে ইসমাইল তিনবার দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বললেন, রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতনের কারণে তিনি এর আগে ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে আসেন।

১৯৬২ সালে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের সব ধরনের অধিকার কেড়ে নিয়েছে জানিয়ে ইসমাইল বলেন, ‌‘আমাদের সব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আমাদের শিক্ষার কোনো অধিকার নেই, আমরা স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারি না। রাখাইন রাজ্য মুসলিমশূন্য করার জন্য এসব কর্মকাণ্ড।’

ইসমাইলের ছেলে সাদেক চলতি বছর স্থানীয় একটি বিদালয় থেকে এসএসসি পাস করেছে। কিন্তু সে কলেজে আর ভর্তি হতে পারেনি। ছেলের কথা বলে ইসমাইল বললেন, ‘রোহিঙ্গাদের কেউ মিয়ানমারে উচ্চশিক্ষা নিতে পারে না। আমরা কীভাবে বসবাস করছি বিশ্বসম্প্রদায় দেখুন।’

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সু চির সরকার করবেন না বলে মন্তব্য করেন ইসমাইল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ না দেয়, তাহলে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ চলতেই থাকবে।

রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ভারত-চীনা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ইসমাইল বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি রোহিঙ্গাদের পাশে না দাঁড়ায়, তাহলে মিয়ানমারের কোনো রোহিঙ্গা আর বাঁচতে পারবে না। আর যারা দেশ ত্যাগ করে বাংলাদেশে এসেছে, তারাও আর নিজেদের মাতৃভূমিতে ফিরতে পারবে না।

ইসমাইলের সঙ্গে প্রায় তিন ঘণ্টা আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। যখনই তিনি ‌মাদারল্যান্ড শব্দটি উচ্চারণ করছিলেন, তখনই আবেগতাড়িত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন।

ইসমাইল যখন টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের রাস্তা ধরে পরিবার নিয়ে হেঁটে আসছিলেন, তখন তিনি বারবারই দেখছিলেন নিজের দেশ। কেননা, শাহপরীর দ্বীপের খুব কাছেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সীমান্ত।

মিয়ানমারে জাতিসংঘে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর জোর দাবি জানিয়ে ইসমাইল বললেন, ‌‘আমরা বাংলাদেশকে ভালোবাসি। আমাদের বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমরা আমাদের মাতৃভূমি রাখাইনে ফিরে যেতে চাই। হে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ, রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা বন্ধের ব্যবস্থা করুন। আমাদের সমস্যার সমাধান করুন। আমরা আমাদের অধিকার চাই। আমরা স্বাধীনভাবে চলতে চাই।’

সূত্র: প্রথম আলো

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন