বিআইডিএস ও ইফ্রি’র গবেষণা

রোহিঙ্গা চাপে স্থানীয়রা কোনঠাসা

fec-image

কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ৯৯ শতাংশই খাদ্য সহায়তা পাচ্ছে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে জীবন ধারনের প্রয়োজনীয় ক্যালরি তারা পাচ্ছে সরকারের ত্রাণ থেকেই। অনুদানের খাবার অনেকেই বিক্রিও করছে। অনুদান ছাড়াও প্রায় ৭৬ শতাংশ রোহিঙ্গার আয়ের অন্য উৎস আছে। খাদ্য, স্বাস্থ্য ও পোশাক খাতে রোহিঙ্গাদের অর্থ ব্যয়ের পরিমাণ স্থানীয়দের কাছাকাছি। ক্যাম্পের মধ্যে বিচরণ সীমাবদ্ধ থাকার কথা থাকলেও শ্রমবাজারে তারা স্থানীয় অধিবাসীদের চেয়ে এগিয়ে আছে। অনুদান ও বিকল্প আয় থাকায় তারা কম মজুরিতে কাজ নিচ্ছে।

এ অবস্থায় স্থানীয় অধিবাসীদের কাজ পাওয়া অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। আর্থসাজিক বিভিন্ন সূচকে স্থানীয়দের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এবং ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (ইফ্রি) গবেষণায় এ সব বিষয় উঠে এসেছে।

গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে রোহিঙ্গাদের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে সেমিনারটির আয়োজন করা হয়। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সেমিনারের উদ্বোধন করেন। বিআইডিএস’র মহাপরিচালক ড. কে এ এস মুর্শিদের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর ঢাকা অফিসের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ সিচার্ড রাগান বক্তব্য রাখেন।

দিনব্যাপী সেমিনারে রোহিঙ্গাদের খাদ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্য, স্থানীয়দের উপর রোহিঙ্গার চাপের প্রভাব, আয়, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য, ঝুঁকি ও বাংলাদেশের সম্ভাব্য করনীয় নিয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ সব প্রবন্ধের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন বিআইডিএস এর গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়ক সেন, গবেষক ড. মোহাম্মদ ইউনুস ও ইফ্রির গবেষক ড. পাওয়েল দোরোস।

উদ্বোধনীতে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এটি একটি অতি মানবিক বিষয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদারতা ও মানবতাবোধে তাদেরকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। সরকার সব সময় আন্তর্জাতিক ইস্যুতে আলোচনার পথ বেছে নেয়। সরকার বিবাদ পছন্দ করে না। অন্যায়ের শিকার হয়ে কেউ কষ্ট পাক এমনটা সরকার চায় না।

তিনি বলেন, প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয় ও খাদ্য যোগাতে বাজেটের উপর বড় ধরনের চাপ পড়ছে। তবে সরকার সেটা মেনে নিয়েছে। তারা এখানে যে কয়েকদিন আছে, সরকার চাইবে যেন তারা ভালো থাকে। রোহিঙ্গাদের জন্য যে সহায়তা আসছে সেগুলো চুরি-চামারি হচ্ছে না। বরং সুন্দর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বন্টন করা হচ্ছে। তবে শিশুদের পুষ্টির অবস্থা খুব বেশি ভাল নয়। এটা কারও কাম্যও নয়।

ড. কে এ এস মুরশিদ বলেন, সম্পদের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য সার্বোচ্চ সহায়তা দিচ্ছে সরকার। সার্বিকভাবে রোহিঙ্গাদের পুষ্টির অবস্থা একটু খারাপ। তাদেরকে নিদিষ্ট কিছু খাবার সরবরাহ করা হয়। তাদের হাতে নগদ অর্থ নেই। ফলে তারা নিজেরাই কিছু কিনে খেতে পারেন না। শিশু পুষ্টির অবস্থা অতটা খারাপ বলা যায় না। স্থানীয় বাসিন্দাদের তুলনায় কিছুটা খারাপ হলেও রংপুর বা কুড়িগ্রামের তুলনায় পুষ্টি অবস্থা ভাল বলা যায়।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ক্যালরি গ্রহণের অবস্থা অতটা খারাপ নয়। দারিদ্র্যের অবস্থাও অতটা খারাপ নয়। তবে তাদের ব্যাপকভাবে কাজ করার সুযোগ দিলে কক্সবাজারের স্থানীয় শ্রমবাজারে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।

একটি অধিবেশনে সভাপতির বক্তব্যে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, অর্থনীতির পাশাপাশি বাংলাদেশের সামাজিক খাতেও রোহিঙ্গারা নেতিবাচক প্রভাব রাখছে। অন্য দেশের নাগরিককে আশ্রয় দেয়ার সামর্থ্য বাংলাদেশের যে কোন দেশের চাইতে কম। এমনিতেই ঘনবসতি, নগরায়ন ও কলকারখানা স্থাপনের কারণে ফাঁকা জমির পরিমাণ খুব কম। রোহিঙ্গাদের এদেশে অর্থনৈতিক কাজে যুক্ত করা খুব কঠিন।

এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, মাথাপিছু আয়ের তুলনায় বাংলাদেশে সামজিক অর্জনগুলো অনেক ভাল। নারীরা অনেক বেশি শিক্ষা গ্রহণ করছে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার অনেক বেশি। শিশু মৃত্যুর হার কম। কিন্তু রোহিঙ্গাদের মধ্যে নারী শিক্ষা, জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার শূণ্যের কোঠায়। শিশু মৃত্যুর হারও বেশি। রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশের সামাজিক অর্জনগুলো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

ড. মোহাম্মদ ইউনুসের গবেষণায় বলা হয়েছে, শ্রমবাজারে অন্তর্ভূক্তির হারে স্থানীয়দের চাইতে রোহিঙ্গারা এগিয়ে আছে। রোহিঙ্গাদের ৫৭ দশমিক ৮৬ শতাংশই শ্রমবাজারে যুক্ত আছেন। স্থানীয়দের মধ্যে শ্রমবাজারে অন্তর্ভূক্তির হার ৫১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। রোহিঙ্গাদের ৩০ দশমিক ৮০ শতাংশ শ্রমে নিয়োজিত। স্থানীয়দের মধ্যে কর্মজীবীর হার ৫৩ দশমিক ৭০ শতাংশ। গত এক বছরে রোহিঙ্গারা গড়ে ৫৮ দিন অর্থের বিনিময়ে কাজ করেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বছরে কাজ করেন ১৩৮ দিন।

ড. মোহাম্মদ মঈনুল হকের উপস্থাপন করা অপর এক গবেষণার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় স্থানীয়দের ৯০ শতাংশের কোন না কোন আয়ের উৎস আছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে আয়ের উৎস আছে ৭৫ দশমিক ৭০ শতাংশের। কাজ করে অর্থ আয় করছেন ৪২ দশমিক ৩০ শতাংশ রোহিঙ্গা। প্রতিষ্ঠান পরিচালণা করে আর্থ আয় করছেন প্রায় ৫ শতাংশ রোহিঙ্গা, প্রবাসী আয় বাবদ অর্থ পাচ্ছে ১২ শতাংশ রোহিঙ্গা।

অন্যান্য খাতে অর্থ পাচ্ছে ৪৭ শতাংশ রোহিঙ্গা। দারিদ্রসীমার নিচে রয়েছে আশ্রয় নেয়া ২২ শতাংশ পরিবার। স্থানীয়দের ক্ষেত্রে এর হার ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গারা প্রতিমাসে মাথাপিছুু ১ হাজার ৫৮৯ টাকা থেকে ১ হাজার ৮১৮ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে পারে। স্থানীয়দের মাথাপিছু মাসিক ব্যয় ২ হাজার ৪৫৫ টাকা। রেহিঙ্গাদের ব্যয়ের ৬৯ শতাংশই যাচ্ছে খাদ্য খাতে। আশ্রয় নেয়া ৯৯ শতাংশ রোহিঙ্গা খাদ্য সহায়তা পাচ্ছে। ১৫ শতাংশ রোহিঙ্গা সহায়তার এ খাবার বিক্রি করে দেয়ে। অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে খাদ্য বিনিময় করে ১২ শতাংশ রোহিঙ্গা।

অনুদানের খাদ্য বিক্রির পরও রোহিঙ্গারা জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালরি পাচ্ছেন বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের ক্যালরির অর্ধেক আসছে ভাত, অন্যান্য শস্য ও ডাল থেকে। ভাত, ডাল ও তেল থাকে আসছে তাদের মোট ক্যালরীর ৮৫ শতাংশ। প্রাণীজ উৎস থেকে ৫ শতাংশ এবং ফল থেকে পাচ্ছে মাত্র ৩ শতাংশ ক্যালরি।

এছাড়া জ্বালানি ও আলোর যোগান দিতে রোহিঙ্গাদের ৩২ শতাংশ অর্থ ব্যয় হচ্ছে। প্রতি মাসে মাথাপিছু ৮০ টাকা করে পোশাক ও একই পরিমাণের অর্থ তারা স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করে থাকে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের ১২ শতাংশ অপুষ্টির শিকার। গর্ভবতীদের মধ্যে অপুষ্টির হার ২৩ শতাংশ। তারা কম ওজনের শিশু জন্মদানের ঝুঁকিতে রয়েছেন।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন