‘সরকার পার্বত্য নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানে সম্পূর্ণ ব্যর্থ’

bonduk-judd

আলমগীর মানিক,রাঙামাটি:
পার্বত্য রাজনীতির চৌকোণা ছকে বাঁধা পড়েছে অপহৃত চার টেলিটক কর্মীর জীবন। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তাদের মুক্তি আর নিরাপদে স্বজনের কাছে ফিরে আসার সম্ভাবনা। অপহরণের ১২ দিন পার হয়ে গেলেও তাদের উদ্ধারে তেমন কোনো অগ্রগতি তো হয়ই নি বরং মাঝখানে দেখা দেওয়া আশার আলোগুলোও ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র।

অপহৃতদের পরিবারের পক্ষ থেকে গোপনে সাংবাদিকদের জানানো হয়েছে, এই চার প্রকৌশল শ্রমিকের দায়-দায়িত্ব কারা নেবে এমন অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় তারা স্বজনদের জীবন নিয়েই এখন বেশী শঙ্কিত। এদিকে যত দিন গড়াচ্ছে অপহরণকারীরাও তাদের মুক্তিপণের অংক বাড়িয়ে চলেছেন। ৪০ লাখ থেকে এখন মুক্তিপণ এসে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি টাকায়। কিন্তু অপহৃতদের মধ্যে একজন প্রকৌশলী বাদে বাকি তিন শ্রমিকের পরিবার তিন লাখ টাকা দেওয়ারও সামর্থ রাখেন না। পক্ষান্তরে টেলিটক কোম্পানী বলে চলেছে অপহৃতরা তাদের নিজস্ব জনশক্তি নয়।

এদিকে অপহরণের দায় নিয়েও চলছে ইঁদুর বিড়াল খেলা। পার্বত্য আঞ্চলিক দলগুলোর কেউই এখন পর্যন্ত এই অপহরণের দায় স্বীকারতো করেনইনি বরং তারা পাল্টাপাল্টি অভিযোগ উত্থাপন করে বিষয়টিতে একটি প্রচ্ছন্ন ধুম্রজাল তৈরি করে রেখেছেন। অপহরেণের সাথে সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে ইউপিডিএফ অভিযোগ করেছে, নিরাপত্তা বহিনীর লোকজন এই অপহরণ নিয়ে অযথা তাদের হয়রানী ও নির্যাতন করছে। বৃহস্পতিবার এক প্রেস বার্তায় তারা এমন অভিযোগ করেন। জেএসএস এই অপহরণের জন্য ইউপিডিএফই দায়ী বলে অভিযোগ করে আরেক পা বাড়িয়ে বলেছেন, এর সাথে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্র জড়িত রয়েছে।

সর্বশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর একটি সূত্র জানিয়েছে, এই অপহরণ নিয়ে প্রশাসন দৃশ্যত ‘অতিতৎপরতা’ দেখাতে পারছেনা; কারণ অপহরণকারীদের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ার করা হয়েছে যে, অবস্থা বেগতিক হলে তারা অপহৃতদের মেরে ফেলতে বাধ্য হবেন। নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট অপর একটি এও জানিয়েছে যে, প্রশাসন চাচ্ছে মোবাইল অপারেটর কোম্পানীর লোকজনকে জিম্মী করে মুক্তিপণ নেওয়ার সংস্কৃতি এখানেই বন্ধ করে দিতে। কারণ এই সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে এখানে আর কোনো কোম্পানী নির্বিঘ্নে টাওয়ার বসাতে পারবেনা। কিন্তু অপহৃতদের পরিবারের কাছে তাদের স্বজনদের জীবনই শেষ কথা, তারা সকল আকুতি দিয়ে এই নিরীহ শ্রমিকদের ফেরত পাওয়ার আবেদন জানিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, গত ৮ জুলাই সন্ধ্যায় বাঘাইছড়ি উপজেলার বারবিন্দুঘাট এলাকা থেকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মোবাইল অপারেটর টেলিটকের টাওয়ার স্থাপনের কাজ করতে গিয়ে অপহৃত হন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বি-টেকনোলজির সহকারি প্রকৌশলী আকতার হোসেন, কারিগরি প্রকৌশলী হেমায়েত হোসেন, ইমরুল ও কর্মী সুজা।
ঘটনার পর রাঙামাটিতে অনুষ্ঠিত এক বিশেষ আইন শৃঙ্খলা সভায় পুলিশ সুপার আমেনা বেগম জানান, অহৃতদের উদ্ধারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ভবিষ্যতে মোবাইল কোম্পানীগুলোর লোকজন যাতে নির্বিঘেœ কাজ করতে পারে সে লক্ষ্যে নিরাপত্তাও জোরদার করা হয়েছে বলে জানান তিনি। আর বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা জানিয়েছিলেন, অপহৃতদের উদ্ধারে সামাজিক প্রচেষ্টা চলছে। অপহরণকারীদের সাথে যোগাযোগের জন্য জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি কমিটিও কাজ করছে। এছাড়া বেশ কয়েকবার সমঝোতা বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার পরেও অপহৃতদের উদ্ধার করতে না পারায় ক্ষোভ জানিয়েছেন সচেতন মহল।

সাম্প্রতিককালে পার্বত্যাঞ্চলে যেসব অপহরণ, খুন, চাদাবাজিঁ ও ভাতৃঘাতি সংঘাত সংঘঠিত হচ্ছে এটা কখনো মেনে নেওয়া যায়না বলে জানালেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য ও রাঙামাটি সনাকের সভানেত্রী বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ নিরূপা দেওয়ান। তিনি বলেন, এসব ঘটনা পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে জটিল থেকে আরো জটিলতর করছে, যা আমরা কখনও চাইনা অথবা আমাদের কাম্য নয়। পার্বত্যাঞ্চলে এসব কর্মকা- যারা করছে তাদের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে একটি উপায় খুজেঁ বের করার পাশাপাশি আইন শৃংখলা বাহিনীকে আরো তৎপর হওয়া এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকেও আরো বেশি পরিমাণে সজাগ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের এখনই সময় বলে জানালেন এই মানবাধিকার কর্মী।

এদিকে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে সাদা চোখে পার্বত্যাঞ্চলের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিগুলোকে স্থানীয় কতিপয় রাজনৈতিক দলের বেশি বাড়াবাড়ি বলে মন্তব্য করেছেন রাঙামাটি সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হাজী মূছা মাতব্বর। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে অপহরণ, চাদাঁবাজি ও হত্যার ঘটনায় পার্বত্যাঞ্চলে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে। অন্যথায় পার্বত্যাঞ্চলের পরিস্থিতি আরো ভয়ানক হয়ে উঠবে বলেও মন্তব্য করেন ক্ষমতাসীন দলের এই নেতা।

এদিকে পার্বত্যাঞ্চলে অপহরণসহ যারা সন্ত্রাসী কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে তাদের আইনের আওতায় আনার চেয়ে বিভিন্নভাবে রক্ষার রাজনীতি চালু করেছে অত্রাঞ্চলের প্রশাসন নিজেই, এমনই মন্তব্য করেছেন রাঙামাটি পৌরসভার মেয়র ও সাবেক ছাত্রনেতা সাইফুল ইসলাম ভূট্টো। তিনি বলেন, আমি মনেকরি রাষ্ট্রের যে দায়িত্ব সেটা সঠিকভাবে পালন না করা, আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোকে বেপরোয়া চাদাঁবাজির অলিখিত অনুমোদনের কারণে পার্বত্যাঞ্চলে অহরহ অপহরণের ঘটনা ঘটে চলেছে। একেরপর এক অপহরণের ঘটনা ঘটে চলেছে আর প্রশাসন কিছুই করতে পারছে না অভিযোগ করে তিনি বলেন, শুধুমাত্র আল্লাহর উপর দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র টিকে থাকতে পারেনা। আর এথেকে পরিত্রাণের জন্য যারা ঘটনার শিকার হচ্ছেন তাদের পক্ষে অথবা যারা এসব অপকর্ম ঘটিয়ে চলেছে তাদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট বক্তব্য কেউ না দেওয়ার কারনে পার্বত্যাঞ্চলে আজ সাধারণ নাগরিক জীবন বিপন্নের পথে বলেও মন্তব্য করেন মেয়র।

এদিকে পার্বত্যাঞ্চলের বর্তমান আইনশৃংখলা পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে অবনতি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন রাঙামাটি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোঃ শাহ আলম। পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি বিচ্ছিন্নতাবাধী গ্র“প একেরপরএক অপহরণের ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে, এসবই আইন শৃংখলার আওতায় আনা এবং এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, দেশের ও নাগরিকদের রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অথচ বর্তমান সরকার পার্বত্য নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানে সম্পূর্ন ব্যর্থ হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন বিএনপির এই নেতা।

উল্লেখ্য গত ৮ জুলাই বাঘাইছড়ি থেকে টেলিটক কোম্পানীর ৪ জন  কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা বিদ্যমান চাঁদাবাজীর ঘটনাকে নতুন ভাবে জাগিয়ে তুলেছে। এই অপহরণ ঘটনার বিষয়ে একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এই অপহরণ ঘটনার পেছনে রয়েছে চাঁদার দাবী। চাহিদা মোতাবেক চাঁদা দিতে না পারায় তাদের অপহরণ করা হয়েছে এবং এখন চাঁদার পরিবর্তে মুক্তিপণ দাবী করা হচ্ছে। তাদের চাহিদা মোতাবেক মুক্তিপণ পরিশোধ না করলে অপহৃতদের ভাগ্যে কি ঘটে কিছু বলা যায় না বলে জানা গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানিয়েছে, অপহরণে ১২ দিন পরও অপহৃতদের উদ্ধার করতে না পারা পার্বত্যাঞ্চলের নিরাপত্তাবাহিনীগুলোর সক্ষমতা নিয়ে একটি বড় প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। একের পর এক অপহরণের ঘটনা ঘটলেও মুক্তিপণ ছাড়া উদ্ধারের রেকর্ড বিরল। কিছুদিন আগে খাগড়াছড়িতে এক আওয়ামী লগি নেতা অপহৃত হন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সবচেষ্টা ব্যর্থ হলে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান তিনি।
এখানে মোবাইল কোম্পানীগুলো থেকে চাঁদাবাজীর এই সব ঘটনা ওপেন সিক্রেট হলেও  আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে কেউ এ বিষয়ে অভিযোগ করতে সাহস পায়না। আর অভিযোগ না আসায় স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষেরও করার কিছু থাকেনা। ফলে দিনকে দিন মোবাইল কোম্পানীগুলোকে চাঁদা দিয়েই ব্যবসা করতে হচ্ছে। আর এর শেষ কোথায় তারা কেউ জানে না।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন