স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত ১১ নির্দেশনা প্রত্যাহার দাবী করলেন নির্বাচিত জুম্ম জনপ্রতিনিধিরা

নির্বাচিত জুম্ম জনপ্রতিনিধি সংসদের ২য় কেন্দ্রীয় সম্মেলনে ২৩ সদস্যের নতুন কমিটি ঘোষণা

jummasongsodphoto

স্টাফ রিপোর্টার:

তিন পার্বত্য জেলার ইউপিডিএফ সমর্থিত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ঐক্যবদ্ধ সংগঠন নির্বাচিত জুম্ম জনপ্রতিনিধি সংসদের ২য় কেন্দ্রীয় সম্মেলন আজ সকালে খাগড়াছড়ি টাউন হল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়েছে।

উক্ত সম্মেলন থেকে পানছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান সর্বোত্তম চাকমাকে সভাপতি, লক্ষীছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান সুপার জ্যোতি চাকমকে সাধারণ সম্পাদক ও দীঘিনালার কবাখালী ইউপি চেয়ারম্যান বিশ্বকল্যান চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক ঘোষনা করে ২৩ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয় । এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য শ্লোগান ছিলো: যিনি জনগণের কণ্ঠ ধারণ করে বৃহত্তর স্বার্থে নিয়োজিত থাকতে সক্ষম, তিনিই জনগণের উপযুক্ত প্রতিনিধি।

সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন সর্বোত্তম চাকমা। সভায় আরো বক্তব্য রাখেন খাগড়াছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান চঞ্চুমনি চাকমা, দীঘিনালা উপজেলা চেয়ারম্যান নবকমল চাকমা, মহালছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান বিমল কান্তি চাকমা, রাঙামাটির কাউখালী উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মং ইউ চৌধুরি,রাঙামাটির ঘিলাছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান অমরজীবন চাকমা, দীঘিনালা ইউপি চেয়ারম্যান বিশ্বকল্যান চাকমা। সভা পরিচালনা করেন গুইমারা হাফছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উশ্যেপ্রু মারমা। সম্মেলনে তিন পার্বত্য জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে জনপ্রতিনিধিসহ দুইশতাধিক সমর্থক শুভাকাংখী সাধারণ জনতা উপস্থিত ছিলেন।

সম্মেলনে বক্তাগণ জুম্ম জনপ্রতিনিধি সংসদের ঘোষিত ১৭ দফা দাবিনামা বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। নেতৃবৃন্দ পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্যগত স্বকীয়তা বজায় রেখে স্থানীয় জনপ্রনিধিত্বমূলক পরিষদসমূহকে আরো বেশি পরিমাণে স্বায়ত্তশাসন প্রদানের দাবি জানান। নেতৃবৃন্দ পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদসমূহ পার্বত্য মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করার দাবি জানান এবং পার্বত্য স্থানীয় নির্বাচিত পরিষদসমূহের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দিতে সরকারের কাছে দাবি জানান।

নেতৃবৃন্দ পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক-প্রশাসনিক-অর্থনৈতিক তথা সার্বিক অধিকার আদায়ের লড়াই জোরদার করার জন্য জুম্ম জনপ্রতিনিধি সংসদের কার্যক্রম আরো সক্রিয় করা প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেন। আলোচকগণ বলেন, বৃহত্তর জুম্ম জাতীয় স্বার্থে জুম্ম জনপ্রনিধিদের আরো সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে।

নেতৃবৃন্দ সম্মেলন থেকে গত ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ইং সরকারের আইনশৃংখলা সংক্রান্ত একটি বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে ১১ দফা নির্দেশনাকে জুম্ম জনগণের প্রতি নিপীড়নমূলক ও অন্যায্য উল্লেখ করে উক্ত নির্দেশনা অবিলম্বে বাতিল করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান।

সম্মেলনে নির্বাচিত জুম্ম জনপ্রতিনিধি সংসদের ঘোষিত বা উল্লেখিত ১৭ দফা দাবিনামা নিচে তুলে ধরা হলো:
১। পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদসমূহ পার্বত্য মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য বিশেষ আলাদা বরাদ্দ দিতে হবে।
২। উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের পদমর্যাদা নির্ধারণ করতে হবে এবং স্থানীয় সকল জনপ্রতিনিধির সম্মানি ভাতা বৃদ্ধি করতে হবে।
৩। প্রশাসনিক সুবিধার নামে পার্বত্য চট্টগ্রামকে খণ্ডবিখণ্ড করে স্থানীয়দের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের মাধ্যমে শাসন-শোষণ চালানোর উপনিবেশিক প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও বিভেদ পরিহারপূর্বক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত বিতর্কিত গণবিরোধী “১১ নির্দেশনা” প্রত্যাহার করতে হবে।
৪। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথাগত আইন ও রীতিকে (১৯০০ সালের শাসনবিধির যুক্তিসঙ্গত অংশসমূহ) স্বীকৃতি প্রদানপূর্বক পাহাড়িদের ভূমি অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের স্বার্থ ও মতামত উপেক্ষা করে সরকার বা অন্য কোন সংস্থার নামে জমি অধিগ্রহণ করা যাবে না।
৫। দুর্নীতিগ্রস্ত, নানা অপরাধে বিভাগীয় সাজাপ্রাপ্ত ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন সরকারি-আধা সরকারি কর্মকর্তাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বদলী বা নিয়োগ বন্ধ করতে হবে। ইতিমধ্যে নিয়োগপ্রাপ্ত এ ধরনের বিতর্কিত কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের প্রত্যাহার করতে হবে।
৬। খনিজ ও বনজ সম্পদের ব্যাপারে স্থানীয় চাহিদা প্রাধান্য দিতে হবে। সেমুতাঙ গ্যাসসহ কয়লা ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান এবং আহরণের ক্ষেত্রে পার্বত্যবাসীর ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে হবে।
৭। চাকুরি, শিক্ষা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে স্থানীয়দের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
৮। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িত দুর্নীতিগ্রস্ত জেলা পরিষদ সদস্যদের যথোপযুক্ত সাজা প্রদানসহ নিয়োগ বাতিল করতে হবে। অনির্বাচিত ব্যক্তিদের কর্তৃত্ব খাটানোর অব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে। অবিলম্বে দলীয়ভাবে মনোনীত বর্তমান পরিষদ বাতিলপূর্বক জেলা পরিষদ নির্বাচন দিতে হবে।
৯। ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী, পুর্নবাসন থেকে বঞ্চিত জুম্ম শরণার্থী এবং আভ্যন্তরীণ উদ্ভাস্তুদের পুর্নবাসন বিষয়ে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। পার্বত্য চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন এবং প্রত্যাগত জেএসএস সদস্যদের যথাযথ পুনর্বাসনসহ তাদের নিকট প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে।
১০। ভেজাল খাদ্য দ্রব্য বিক্রির ব্যাপারে কঠোর নজরদারি ও অপরাধীদের সাজা নিশ্চিত করতে আইনী ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় জনপ্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অনতি বিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান প্রধান হাট-বাজারে ফরমালিনের মত রাসানিক দ্রব্য পরীক্ষার যন্ত্রপাতি স্থাপন করতে হবে।
১১। মদ-জুয়া, হিরোইন, ফেনসিডিল সহ মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ সহ মাদকাসক্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
১২। এলাকায় বিশৃঙ্খলা ঘটিয়ে বিনোদনের নামে যাত্রা-হাউজি ইত্যাদি আয়োজনে বিধি নিষেধ আরোপ করতে হবে এবং এ ব্যাপারে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
১৩। পর্যটনের নামে অবৈধ কার্যকলাপ চলতে দেয়া যাবে না। সমাজ বিরোধী অবৈধ কার্যকলাপ ও ব্যবসা বন্ধ করতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
১৪। ধর্ষণের ডাক্তারি পরীক্ষার ক্ষেত্রে সঠিক/যথাযথ রিপোর্ট প্রদান করতে হবে।
১৫। সমাজের বয়োবৃদ্ধ, অক্ষম, পঙ্গু, মানসিক বৈকল্য সম্পন্ন লোকের জন্য ভাতা প্রদান, পুনর্বাসন ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসার্থে জনপ্রতিনিদিদেরকে বিশেষ তহবিল প্রদান করতে হবে।
১৬। নারী-শিশুদের নিরাপত্তা বিধানসহ সমাজের বেকার যুবকদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও মেধা অনুযায়ী প্রতিরক্ষাসহ বিভিন্ন সরকারি -আধা সরকরি সংস্থায় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
১৭। গরীব জুমিয়া চাষীদের বিকল্প জীবিকা নিশ্চিত করে জুম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পশু-পাখি শিকার, পাচার ও ব্যবসার বিরুদ্ধে গণসচেতনা বৃদ্ধির পাশাপাশি এ ব্যাপারে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে।

সম্মেলন উপলক্ষে র‌্যালী অনুষ্ঠান আয়োজনের উদ্যোগ নেয়া হলেও খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের লিখিত বিধিনিষেধের কারণে র‌্যালী অনুষ্ঠান আয়োজন বাতিল করা হয়।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন