অনিশ্চিত প্রত্যাবাসন, নতুন করে প্রবেশ করছে আরো রোহিঙ্গা

fec-image

বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নানা উদ্যোগ নিলেও এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গারা নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারেননি। কূটনৈতিক ও আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি মিয়ানমারের সঙ্গে বিভিন্ন সময় আলোচনার পরও সংকট সমাধানে কোনো অগ্রগতি নেই। এই সমস্যায় আবার যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। আবারও সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকেছেন রোহিঙ্গারা। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘর্ষ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা বেড়েছে। ফলে নতুন করে আরও ১২ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং ৫০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্তে অবস্থান করছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। নাফ নদের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে এসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে।

প্রত্যাবাসন বিলম্ব হওয়ায় দিন দিন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাস ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়ে চলেছে। রোহিঙ্গারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে এবং তাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা না গেলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে বলে মত বিশ্লেষকদের।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা ঢলের শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। এরপর কয়েক মাসের মধ্যে সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে ওই এলাকার ক্যাম্পে বসবাস করছিল আরও ৪ লাখ রোহিঙ্গা।

কূটনৈতিক সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৭ সালের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় মিয়ানমারের অং সান সু চি সরকার। ওই বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতেও সই করে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চলার এক পর্যায়ে ২০১৯ সালে দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের প্রতিশ্রুতিতে রোহিঙ্গারা আস্থা রাখতে না পারায় সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শাসনক্ষমতা দখল করার পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত আলোচনা কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।

জানা গেছে, ২০২৩ সালের এপ্রিলে চীনের তরফ থেকে তৃতীয় দফা উদ্যোগ নেওয়া হয়। চীনের কুনমিংয়ে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয় এবং মে মাসে চীনের উদ্যোগে মিয়ানমার প্রত্যাবাসনের সম্ভাব্যতা যাচাই ও পাইলট প্রকল্প হাতে নেয়। এ উদ্যোগের পর কয়েক দফায় রোহিঙ্গাসহ উভয় দেশের প্রতিনিধিরা প্রত্যাবাসনের সম্ভাব্যতা যাচাই করেন। মিয়ানমারে ফেরার জন্য নির্বাচিত রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পগুলোয় একত্র করা হয়। কিন্তু আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার জান্তা সরকারের সঙ্গে চলমান যুদ্ধে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া থেমে যায়। মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য উপযুক্ত নয় বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। এ কারণে রোহিঙ্গা ইস্যুটি এখন দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পরিণত হয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের যে তালিকা দেওয়া হয়েছিল, মিয়ানমারের তা যাচাই করে দেখার কথা। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এখনো ওই পর্যন্তই।

নতুন করে রোহিঙ্গা প্রবেশের বিষয়ে সরকারের অবস্থান জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেন গতকাল রোববার বলেন, আমরা স্পষ্ট করেই বলেছি, আর একজন রোহিঙ্গাকেও আশ্রয় দিতে রাজি নই। কিন্তু কিছু ঢুকে যাচ্ছে, এটা আমরা জানি। সেটা ঠেকানোর চেষ্টা করছি। বিজিবি প্রতিদিনই ফেরত পাঠাচ্ছে যাদের আমরা ধরতে পারছি। কিন্তু একটা বড় এলাকা নিয়ে তারা ঢুকছে। সবাইকে যে আমরা ধরতে পারছি তা নয়, সামর্থ্যেরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা যেখানে পারছি ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করছি।

তিনি বলেন, ইউএনএইচসিআর চায় আমরা তাদের আশ্রয় দিই, কিন্তু আমরা তাদের কাছে স্পষ্ট করেছি আমরা যে ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছি। আমাদের যেটুকু ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন তারচেয়ে বেশি পালন করেছি। যারা আমাদের উপদেশ দিতে চায় তারা বরং তাদের নিয়ে যাক।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বহুমুখী কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জরুরি। নানা কূটনৈতিক জটিলতায় আটকে আছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করা নতুন সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ বলেও মনে করেন তারা।

এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত ড. হুমায়ূন কবির গণমাধ্যমকে বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ অবস্থা বিবর্তনের ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবং নতুন করে আরও ঢোকার ফলে যে জটিলতা তৈরি হচ্ছে, দুই ক্ষেত্রেই সফল হওয়া এখন আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জের। তাই এ ব্যাপারে এখন বাড়তি মনোযোগ দিয়ে আমাদের কাজ শুরু করতে হবে। মিয়ানমার ও রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধ বন্ধে এবং স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক দেশগুলোকে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতা দেশগুলোর সহায়তায় রোহিঙ্গাদের রাখাইনে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে আরাকান আর্মি, সেখানকার রাজনৈতিক দল ও স্থানীয় রাখাইনদের নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

তিনি বলেন, যেহেতু রাখাইন রাজ্য এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। তাই তাদের সঙ্গেও আমাদের যোগাযোগ রাখা উচিত। তাদের যদি রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করার মতো প্রস্তুতি না থাকে তাহলে তো মিয়ানমার সরকার রাজি হলেও এখানে কোনো লাভ নাই। আর এটাই বাস্তবতা। এখন আমরা সেটা কীভাবে করব, তা আমাদের চিন্তার মধ্যে আনতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের কূটনীতিতে সৃজনশীলতার প্রয়োজন। তাদের সরকারের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ তো রাখতে হবেই। কিন্তু এটার পাশাপাশি এর বাইরে কী করা যায়, সেটা আমাদের ভাবনার মধ্যে আনতে হবে। তা ছাড়া এই সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সাত বছর ধরে চেষ্টা করেও কোনো কাজ হয়নি।

ড. হুমায়ূন বলেন, প্রত্যাবাসন নিয়ে চীনের সঙ্গে মিলে ত্রিপক্ষীয়ভাবে আমাদের একটা উদ্যোগ আছে। কিন্তু মিয়ানমারে এখন যে যুদ্ধাবস্থা, তাতে করে কোনো ধরনের কূটনৈতিক উদ্যোগই সফল হবে বলে মনে করা যায় না। তাই এটা আরেকটু দীর্ঘ সময়ের প্রেক্ষাপটে সমাধানের চিন্তা আমাদের মাথায় রাখতে হবে।

তিনি বলেন, আরাকান আর্মি যদি এখন স্বাধিকার চায়, তারা যদি মিয়ানমার রাষ্ট্রের বাইরে যেতে চায়, তার অর্থ দাঁড়াবে এই, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য আগে আমরা মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে কথা বলতে পারতাম, এখন সেখানে নতুন শক্তি বা স্তর যোগ হয়েছে। যেটাকে একটা নতুন জটিলতাও বলা যায়। আরাকান আর্মি এখানে কী অবস্থান নেয়, সেটার মূল্যায়নের ভিত্তিতে কীভাবে আমরা তাদের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারি, সেই ব্যাপারে নতুন করে চিন্তার প্রয়োজন।

 

সূত্র: কালবেলা

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: প্রত্যাবাসন, মিয়ানমার, রোহিঙ্গা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন