‘টার্গেট কিলিংয়ে’ রোহিঙ্গা নেতাদের হত্যা, বারবার উঠছে আরসার কথা

fec-image

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। এ নিয়ে বারবারই ‘আরসাকে’ দায়ী করছেন রোহিঙ্গা নেতারা। তবে বরাবরই পুলিশ বলছে, ক্যাম্পে আরসার অস্তিত্ব নেই। চাঁদাবাজি, অপহরণ, মাদক, চোরাচালান এবং মানবপাচারকে কেন্দ্র করে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কয়েকটি গ্রুপ। খবর বাংলা ট্রিবিউনের

রোহিঙ্গা নেতাদের অভিযোগ, ক্যাম্পগুলো নিয়ন্ত্রণে পুরনো কৌশল বদলে নতুনভাবে এগোচ্ছে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। টার্গেট করার ক্ষেত্রে আগের ছক বদল করেছে তারা। নতুন করে ‘সিঙ্গেল অ্যাটাক’ বা একক হামলার কৌশল নিয়েছে সশস্ত্র সংগঠনটি। ক্যাম্পে যেসব রোহিঙ্গা নেতা আরসাকে সহযোগিতা করছে না, কিংবা তাদের হয়ে কাজ করছে না, টার্গেট করে তাদের হত্যা করা হচ্ছে। এমনকি তারা আগে রোহিঙ্গা নেতাদের কাছে ক্যাম্পে চাদাঁবাজি, মাদক ও চোরাচালানে সহযোগিতা চেয়ে প্রস্তাব পাঠায়। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। এরপরও যদি সহযোগিতা না করে তখন হত্যা করা হয়।

ইতোমধ্যে কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কাজ না করার নির্দেশ দেয় আরসা। নির্দেশ না মানায় হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। এ অবস্থায় নিরাপত্তা চেয়েছেন তারা।

পুলিশ বলছে, হুমকিদাতারা আরসার সদস্য নয়। তারা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী। নিজেদের ভেঙে পড়া নেটওয়ার্ক জোড়াতালি দিতে নতুন কৌশলে আবারও সক্রিয় হচ্ছে। হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ভয়ভীতি তৈরি করে ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। পাশাপাশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শক্তিশালী হচ্ছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।’

সর্বশেষ শনিবার (১৫ অক্টোবার) সন্ধ্যায় উখিয়া তাজনিমার খোলা ক্যাম্পে মুখোশ পরে ক্যাম্প-১৩-এর এফ ব্লকের হেড মাঝি মোহাম্মদ আনোয়ার (৩৮) ও একই ক্যাম্পের এফ/২ ব্লকের সাব-মাঝি মৌলভী মোহাম্মদ ইউনুসকে (৩৭) কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, এসব হত্যাকাণ্ডে আরসার সন্ত্রাসীরা জড়িত। কারণ তারা এর আগে মাঝি মো. ইউনুছকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমেদ বলেন, ‘ক্যাম্পে আবারও সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। রোহিঙ্গা নেতাদের সহযোগিতা না পেয়ে ‘টার্গেট অ্যান্ড কিলিং’ মিশনে নেমেছে তারা। বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গা নেতারা হত্যার হুমকি পাচ্ছেন। হুমকি পাওয়া কয়েকজন আমাদের কাছে নিরাপত্তা চেয়েছেন। আমরা নিরাপত্তা দিচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘মূলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবীদের পাহারার ফলে ক্যাম্পে অপরাধীদের চাঁদাবাজি, মাদক চোরাচালানসহ অপরাধ কর্মকাণ্ড কমেছে। এজন্য নিরাপত্তাকর্মী ও রোহিঙ্গা নেতাদের টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে। ক্যাম্পে ভয়ভীতি সৃষ্টি করতে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা। যাতে মাদকসহ অপরাধ কর্মকাণ্ড চালাতে পারে। কিন্তু তাদের টার্গেট সফল হতে দেবো না। তাদের ধরতে অভিযান চলছে।’

রোহিঙ্গা নেতারা জানিয়েছেন, গত সপ্তাহে উখিয়ার ক্যাম্প-৯-এর নুর আমিন মাঝিকে প্রস্তাব পাঠায় আরসার সদস্যরা। ক্যাম্পের যেসব দোকান রয়েছে, সেখান থেকে মাসিক চাঁদা পেতে আরসার লোকজন তার কাছে সহযোগিতা চায়। পাশাপাশি তাদের সঙ্গে অপরাধ কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে বলা হয়। না হলে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। সম্প্রতি এমন হুমকি পেয়েছেন একাধিক রোহিঙ্গা নেতা। যারা আরসার প্রস্তাবে রাজি হয়নি তাদের এখন হত্যা করা হচ্ছে।

পুলিশ জানায়, গত বছরের অক্টোবর থেকে ক্যাম্পগুলোতে ব্লকভিত্তিক স্বেচ্ছায় পাহারা পদ্ধতি চালু হয়। ক্যাম্পে নিয়োজিত উখিয়া-টেকনাফে ৮-এপিবিএনের আওতাধীন ক্যাম্পগুলোতে প্রতি রাতে প্রায় চার হাজার স্বেচ্ছাসেবী রোহিঙ্গা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এছাড়া ১৪-এপিবিএনের অধীনে তিন হাজার ৫১৬ জন এবং ১৬-এপিবিএনের অধীনে তিন হাজার ৭০০ স্বেচ্ছাসেবক একই কাজ করছেন। এরপর থেকে ক্যাম্পে চাঁদাবাজি, অপহরণ, মাদক, চোরাচালান এবং মানবপাচার কমেছে। এতে তাদের অর্থ আয় কমেছে। ফলে ক্যাম্পে হত্যার মাধ্যমে সক্রিয় হতে চায় তারা। গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছয় মাঝিসহ অন্তত ১৭ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে সাত জন স্বেচ্ছাসেবক।

গত ২২ সেপ্টেম্বর ভোরে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে দুর্বৃত্তরা মো. এরশাদ নামে এক রোহিঙ্গাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। ২১ সেপ্টেম্বর খুন হন মোহাম্মদ জাফর (৩৫) নামের এক রোহিঙ্গা নেতা। ১৮ সেপ্টেম্বর খুন হন আরেক স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ ইলিয়াস (৩৫), ৯ আগস্ট দুই রোহিঙ্গা নেতা, ৮ আগস্ট টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক স্বেচ্ছাসেবক খুন হন, ১ আগস্ট একই ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এক রোহিঙ্গা নেতা।

গত ২২ জুন কথিত আরসা নেতা মোহাম্মদ শাহ এবং ১৫ জুন একই গ্রুপের সদস্য মো. সেলিম (৩০) সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। ১৬ জুন রাতে উখিয়া ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবক, ১০ জুন কুতুপালংয়ে চার নম্বর ক্যাম্পের আরেক স্বেচ্ছাসেবক, ৯ জুন এক রোহিঙ্গা নেতা, জুনের শুরুতে মে মাসে খুন হন রোহিঙ্গা নেতা সানা উল্লাহ (৪০) ও সোনা আলী (৪৬)। এসব ঘটনায় ১২টি মামলায় ২৩ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

এসব ঘটনায় আতঙ্কে রয়েছেন রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গা নেতাদের ভাষ্য, রাখাইনের সশস্ত্র সংগঠন আরসা এবং মাদক-মানবপাচারে জড়িত সন্ত্রাসীরা এসব হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে। একাধিক গ্রুপে সক্রিয় তারা।

আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) নেতা সৈয়দ মাহমুদ বলেন, ‘আমরা যারা প্রত্যাবাসনের পক্ষে এবং মাদক-মানবপাচারসহ রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন অপরাধ ঠেকাতে কাজ করছি, তারা প্রাণ হারানোর ভয়ে আছি। আরসা মিয়ানমারের সৃষ্টি। যাতে রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে না যায় সেজন্য আরসা হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে উখিয়ার এক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, ‘আরসা ক্যাম্পের সাধারণ রোহিঙ্গাদের হত্যা ও হুমকির মাধ্যমে নিজেদের দলে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা যদি তাদের বিরুদ্ধে যাই তাহলে হত্যা করা হচ্ছে। এখানে আসার একাধিক গ্রুপ সক্রিয়।’

এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমেদ বলেন, ‘সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো নতুন সদস্য সংগ্রহ করছে। তাদের দলে যোগ না দিলে হত্যার হুমকি দিচ্ছে। আমরা এসব নিয়ে কাজ করছি। ইতোমধ্যে হুমকিদাতা কয়েকজনকে শনাক্ত করেছি। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। পাশাপাশি ক্যাম্পের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে টহল জোরদার করা হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আরসা, টার্গেট কিলিং, রোহিঙ্গা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন