বান্দরবানের চলমান সংঘর্ষ এবং ‘জো’ বনাম ‘জুম্ম’ জাতীয়তাবাদের দ্বন্দ্ব
ধর্মীয় বিভাজন জাতিগত সংঘাতে সবসময়ই এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এই অঞ্চলে। খৃষ্টান অধ্যুষিত নাগাল্যান্ড, চিন, মিজোরাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের কুকি জনগোষ্ঠী নতুন এক মাত্রা যোগ করেছে। এই অঞ্চলে একটা 'লর্ডস কিংডম' অনেকেরই কাম্য। কিন্তু সন্তু লারমা কি তার নিয়ন্ত্রণ ভাগাভাগি করবেন নাথান বমের সাথে? কিংবা সরকারের হাতে কি আরেকটা সুযোগ আছে কেএনএফ'র সাথে আলাদা কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থায় যাওয়ার?
পার্বত্য চট্টগ্রামের উওর-পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্বে ছয়টি উপজেলায় খুবই কম জনসংখ্যার কুকি জনগোষ্ঠীর বসবাস (পাংখুয়া, লুসাই, বম, খুমী, খিয়াং, ম্রো, বনযোগী)। এরা খুব উঁচু পাহাড়ে থাকে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সংলগ্ন মানুষের কাছে তারা ‘কুকি’ নামেই পরিচিত; এরাই ‘জো’ জাতির অন্তর্গত। কুকিরা ‘দুর্ধর্ষ, আগ্রাসী ও হিংস্র’ জাতি বলে বৃটিশদের কাছে তো বটেই সমগ্র ভারতবর্ষে পরিচিত ছিলো ‘পূর্বাঞ্চলের মারাঠা’ নামে।
১৮৯২ সালের জানুয়ারি মাসে তদানীন্তন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার রাজধানী কোলকাতায় বাংলার তখনকার ছোটলাটের সভাপতিত্বে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনের আয়োজন করা হয় হয়েছিলো। আগামী দিনে বাংলা, আসাম আর বার্মার সীমান্ত ঘেঁষা চিন-লুসাই হিলসের প্রশাসনিক রূপরেখা কী হবে, সেটা স্হির করাই ছিলো ওই বৈঠকের প্রধান উদ্দেশ্য। ওই অঞ্চলে বসবাসকারী কুকি-চিন-লুসাই (বা কুকি-চিন মিজো বলেও যাদের অনেকে চেনেন) নৃগোষ্ঠীর সংগে ততদিনে অন্তত পাঁচটি যুদ্ধ হয়ে গেছে, আরও তিনটি হওয়ার অপেক্ষায়।
উনিশ শতকের শেষ দিকে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব, পূর্ব দিক থেকে নানামুখী চাপে কুকিরা ধীরে ধীরে লুসাই পাহাড়ের দিকে চলে যায়। তাদের ছেড়ে যাওয়া অঞ্চলগুলোই হলো বর্তমানে কুকিদের দাবি করা বরকল, রোয়াংছড়ি, কাপ্তাই, থানচি, রুমা উপজেলাগুলো, যা পরবর্তীতে চাকমা ত্রিপুরা ও মারমা জনগোষ্ঠীর লোকদের দখলে চলে যায়।
যাইহোক, কলকাতার সেই চিন- লুসাই কনফারেন্সের পরই স্হির হয়েছিল, এই জনগোষ্ঠীর বাস যে বিস্তৃতীর্ণ এলাকাজুড়ে তা তিনটি ভাগে ভাগ করে দেওয়া হবে। চিন হিলস বার্মার, লুসাই হিলসের দক্ষিণভাগ বাংলার আর উওর ভাগ আসামের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
বাংলাদেশে দু’দশকব্যাপী বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রামে চাকমা নেতৃত্ব পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৩টি নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে বলে দাবি করতো। কিন্তু শান্তি বাহিনীর ১২টি সেক্টর কমান্ডারের মধ্যে (১৯৭৫-১৯৮৩) সবগুলো পদই চাকমা নেতৃত্বাধীন ছিলো। ভারতবর্ষের অন্যান্য স্হানের মতই নৃগোষ্ঠিগুলের নিজেদের মধ্যে অন্তঃদ্বন্দ্ব বা আন্তঃনৃগোষ্ঠীর কলহ এবং সংঘাত নতুন কিছু নয়।
আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বা সামগ্রিকভাবে আমাদের নৃগোষ্ঠীকে খুব কম জানি বলে সবাইকে গড়ে চাকমা বলে সম্বোধন করি। এই ভ্রান্তি আমাদের সংবিধানের রচয়িতা থেকে শুরু করে তাবৎ সব বিদ্বান বুদ্ধিজীবী কেউ বাদ যায় না।
১৯৭১ সালে দেশে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হলে চাকমা রাজার পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনে চাকমারা মুক্তি বাহিনীর কারো কারো হাতে নির্যাতিত হয়। ১৯৭২ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মিজোদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা কালে চাকমাদের সহায়তা পেয়েছে বলে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট অভিযোগ করতো। মিজোরা তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের আশ্রয়ে রুমা, বরকল এসব এলাকায় নিরাপদে ঘাঁটি করে থাকতো। মিজোদের দ্বারাও চাকমারা বিভিন্ন সময়ে আক্রমণ ও লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবেই মিজোদের সাথে চাকমাদের একটা টানাপোড়নের সম্পর্ক ছিলো। প্রথম দিকে মিজোরামে শান্তিবাহিনীর হেডকোয়ার্টার ছিলো। বোয়ালখালি, বিলাইছড়ি, বরকল এলাকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপর পরিচালিত অ্যাম্বুশগুলো মিজোরামে অবস্হিত শান্তিবাহিনীর ঘাঁটি থেকে হয়েছে। সে সময় এখানে শান্তিবাহিনীকেও দুর্ধর্ষ মিজোদের আক্রমণের মধ্যে পড়তে হয়েছে। মিজোদের সাথে দ্বন্দ্বের কারণে পরবর্তীতে শান্তিবাহিনী তাদের হেডকোয়ার্টার ত্রিপুরাতে সরিয়ে নেয়।
বাংলাদেশের সরকারের সাথে দীর্ঘ দুই যুগের আন্দোলনের সময় বান্দরবান তুলনামূলকভাবে শান্তিবাহিনীর কম তৎপরতা দেখেছে মূলত কুকিদের বিশেষ করে একরোখা মুরংদের মারমুখী আচরণের কারণে। এ সময় মুরংরা স্বাধীনভাবে তাদের জীবনযাপন করেছে। শান্তিবাহিনীর সহযোগী না হওয়ায় তারা সেনাবাহিনীর প্রিয়পাত্র ছিলো। তার মূল্য অবশ্য তারা দিয়েছে। শান্তিবাহিনীর কোনো পর্যায়েই তারা উল্লেখযোগ্যভাবে ছিলো না। নেতৃত্বের পর্যায়ে তো নয়ই।
জেএসএস নেতৃবৃন্দ খুব সফলভাবে তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে অপরাপর আরো ১২টি জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম বলে প্রতিষ্ঠিত করে। যদিও কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ বাঁধের কারণে মূলত চাকমাদের প্রভাবশালী অংশটিই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যান্য জনগোষ্ঠিগুলোর প্রভাবহনীতার সুযোগে ১৯৯৭ সালে সরকারের সাথে চুক্তির পর জেএসএস নেতৃবৃন্দ ১১টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অভিভাবক হিসাবে আবির্ভূত হয়। উপজাতি হিসাবে চুক্তি করলেও, একুশ শতকের গোড়া থেকে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের পরিচয় উপজাতি থেকে ‘আদিবাসী’তে উন্নীত করতে সচেষ্ট হন।
কিন্তু কুকিরা বান্দরবান ও রাঙামাটির ৯টি উপজেলায় নিজেদের ‘আদিবাসী’ দাবি করে কেএনএফ নামে নতুন সংগঠনের আবির্ভাব ঘটিয়েছে বছর দুই আগে। যদিও তারা ২০০৮ সালে থেকেই কেএনডিও (কুকি ন্যাশনাল ডেভোলপমেন্ট অর্গানাইজেশন) নামে একটি সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে কাজ করে আসছিল। ঠিক যেমনটা করেছিলেন কামিনী মোহন দেওয়ান; ১৯১৬ সালে তিনি গঠন করেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসমিতি নামে একটি সামাজিক সংগঠন, যাকে বর্তমানের জেএসএস’র মাতৃ সংগঠন বলে মনে করা হয়।
আসলে কুকি-চিন-লুসাইরা অনেক আগে থেকেই ‘জো রি-ইউনিফিকেশন অরগানাইজেশান’ বা ZORO নামক একটি রেনেসাঁবাদী সংগঠনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আসছিলো। এর নেতা R Thangmawia মিজোরাম ও বার্মার চিন প্রদেশে থাকা তার জ্ঞাতিদের একত্রিত করার প্রচেষ্টায় নিবেদিত ছিলেন আমৃত্যু। তিনি চাকমা সার্কেল চিফের মতো United Nations Permanent Forum on Indigenous Issues এর বিভিন্ন সেশনে বহুবার বক্তব্য দিয়েছেন।
সে সময় এসব আন্দোলন এতটাই জোয়ার আনে যে মিজোরামের তৎকালীন চিফ মিনিস্টার ব্রিগেডিয়ার টি সাইলো পার্শ্ববর্তী চিন প্রদেশের সীমান্ত পর্যন্ত মার্চ করেন সংহতি প্রকাশের জন্য। চিন প্রদেশের বৃহত্তর কুকি-চিন-লুসাই জনগোষ্ঠীর লোকেরাও ‘জো’ জাতীয়তাবাদের ঢেউয়ে উদ্বেলিত হয়ে ভারতের সাথে সংযুক্তির দাবি তুলেন এবং সেখানে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।
কিন্তু মায়ানমার এর কড়া জবাব দেয় চিন প্রদেশে ব্যাপক সামরিক অভিযানের মাধ্যমে। ২০২১ সালে এ অঞ্চলের পরিস্থিতিতে আবার উত্তেজনার বীজ ছড়ায় মায়ানমারের সামরিক শাসকদের ক্ষমতা দখলের কারণে। মায়ানমার সরকারের সামরিক অভিযানের ফলে ৫০ হাজার কুকি জনজাতি মিজোরামে আশ্রয় নেয়। চিন প্রদেশের বা জো জাতি গণতান্ত্রিক শক্তির সাথে হাত মিলায়। পিডিএফ (পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট)কে প্রশিক্ষণ দেয় তারা। সাম্প্রতিক সময়ে মণিপুরের ঘটনায় কুকি জনগোষ্ঠীর ফের কয়েক শত লোক মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছে। ফলে সব কিছু মিলিয়েই এই অঞ্চলে একটা ‘জো জাতীয়তাবাদ’ এর পুনর্জন্ম হচ্ছে কিনা তা নিয়ে পর্যবেক্ষকদের আগ্রহ আছে।
এ প্রসঙ্গে বিবিসির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে মন্তব্য করেন মিজোরাম ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানী জে ডাউঙ্গেল। তিনি বলেন, ‘এ অঞ্চলের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহ বিচলিত করার মতো। সে কথা মানলেও তিনটি দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা কুকি-চিন-মিজোদের এখনই কোনো জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জন্ম দেবে বলে মনে হয় না। জো-রা নানা প্রান্তে নির্যাতিত হলেও তারা কিন্তু এখনই কোনো সার্বভৌম স্বদেশ ভূমির জন্য লড়ছে না। বরং এক এক জায়গায় তাদের আন্দোলনের দাবিটা এক এক রকম। মায়ানমারে চিন-রা আর আলাদা হতে চান না।’
যাহোক, এতো সব ঘটনার ঐতিহাসিক তাৎপর্য হলো আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে এতদিন ধরে শুনে আসা ‘জুম্ম’ জাতীয়তাবাদের একক আধিপত্যে পেরেক ঠুকে দিয়েছে ‘জো’ জাতীয়তাবাদ। এক্ষেত্রে নাথান বম তার প্রাক্তন গুরু সন্তু লারমার পদাংক অনুসরণ করেছেন। তিনিও প্রথমে একটি সামাজিক সংগঠনের (কেএনডিও- কুকি ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন) আড়ালে সংগঠিত হয়েছেন। তার পরে কেএনএফ ( কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট) এবং তার পর গঠন করেছেন এর সশস্ত্র শাখা কেএনএ (কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি)।
হঠাৎ করে নাথান বম সন্তু লারমার হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ায় তিনি খুব বিচলিত। কারণ, তিনি জানেন, কুকিদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালে তার পরিণতি উনিশ শতকের মতো হবে। অপরদিকে সন্তু লারমা একজন ঝানু এবং পোড় খাওয়া আপাদমস্তক কমিউনিস্ট। ৬৫ বছরের সংগ্রামী জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি জানতেন ‘জো’ জাতীয়তাবাদের উত্থানের বিপদের কথা। তিনি চাইছিলেন বা আশা করেছিলেন বা হিসাব করে ভেবেছিলেন, খুব দ্রুত মানে ১/২ বছরের মাথায় চুক্তি বাস্তবায়িত হয়ে গেলে ‘জো’ জাতীয়তাবাদের ফণা তিনি পিষে ফেলতে পারবেন। কিন্তু তার শুরুতেই প্রসীত খীসার উত্থানে তার হিসাবে গড়-মিল হয়ে যায়। তাই ২০০০ সাল থেকেই তিনি ‘বিশেষ মহল, স্বার্থান্বেষী মহল, চুক্তির বিপক্ষ শক্তি’ ইত্যাদি বলে তিনি দূরের ও কাছের শত্রুদের দিকে তীর ছুড়তে থাকেন।
সন্তু লারমা ১৯৯৪ সালেই ‘জো’ জাতীয়তাবাদের ঢেউ এখানেও আসবে তা বুঝতেন। তাহলে নিজ হাতে গড়া নাথান বম তার হাত ফসকে যাবে তিনি কি তা জানতেন না? জানতেন। কারণ, নাথান বমরা অনেক খৃস্টিনিয়াজমের মতো ‘জো’ জাতীয়তাবাদের চেতনা নিয়েই জন্মেছেন। যতই তারা নিজেদের ‘আদিবাসী’ ‘আদিবাসী’ বলে শ্লোগান দিক না কেন; চূড়ান্ত বিচারে প্রতিটি নৃগোষ্ঠী অত্যন্ত জাতীয়তাবাদী এবং খুব আত্মম্ভরি। একই পাহাড়ের আলো-বাতাসে বসবাস করলেও তাদের মধ্যে সূক্ষ্ম বিভেদ রয়েছে, যা সময়ে সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে যা কিছু ঘটে তার শিকড় পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতও থাকে। বিপরীতভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার বাইরে যা ঘটে, তার ঢেউ এখানেও এসে পড়ে। উত্তর-পূর্ব ভারতের ২০০টির মতো জাতিস্বত্বার মানুষের মধ্যে আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিনিয়ত নানান পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়। তাই কোনো একটি বিশেষ শাসন ব্যবস্হা বা কোনো গোষ্ঠীর কোনো একদিনের দাবি মানা বা না মানার মধ্যেই সমাধান নিহিত নয়। কেননা, এখানে বসবাসরত জনগোষ্ঠিগুলোর মধ্যে চাহিদা বা দাবি-দাওয়ায় প্রতিনিয়ত নানান ধরনের মেরুকরণ ঘটতে থাকে।
১৯৯৭ সালের চুক্তির পর রাজনৈতিক নেতৃত্ব সবাই হয়তো ভেবেছিলেন, ‘যাক বাবা লেটা চুকে গেল’। এক জেএসএস’র পর আবার কেএনএফ বা এক সন্তুর পর আবার ‘ছোট সন্তু নাথান বমে’র জন্ম হবে তা কি কেউ ভেবেছিলো?
ভাবেনি। কারণ, পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃগোষ্ঠীগুলোকে আমরা খুব কমই জানি। তাদের মধ্যকার বৈপরীত্য বা তাদের মধ্যকার সূক্ষ্ম বিভাজনের বা আত্মম্ভরিতার খবর আমরা রাখি না বা বুঝতে চাই না। আবার কখনো কখনো বুঝলেও তা আড়াল করে রাখা হয়। আজ কেএনএফ’র স্বতন্ত্র রাজ্য মেনে নিলেই কি সমাধান হবে? কাল তো আরেক নৃগোষ্ঠী মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। যেমন এখন ত্রিপুরার কোনো কোনো সংগঠন আসাম, খাগড়াছড়ির কিছু অংশ নিয়ে গ্রেটার ত্রিপুরা স্টেট করার কথা বলছে। আবার ত্রিপুরাতে ‘চাকমা অটোনমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল’ চাচ্ছে সেখানের চাকমারা। নাগারা চাচ্ছে নাগালিংগাম। এই নাগালিংগাম নিয়েও মতভেদ ২৬টি গোত্রে বিভক্ত আসাম, নাগাল্যান্ড, মনিপুর সংলগ্ন নাগারা।
মনিপুরে কুকিরা চাচ্ছে মেইতীদের থেকে আলাদা হতে তা আলাদা রাজ্য, কেন্দ্র শাসিত অন্চল, বা আলাদা কোন প্রশাসনিক ব্যবস্হা তা যে নামেই হোক।
কুকি-চিন-লুসাই জনগোষ্ঠী ১৮৯২ সালের ব্রিটিশ শাসক কর্তৃক তাদের পিতৃভূমিকে ত্রিখন্ডিত করে দেওয়া হয়েছে বলে এখন ‘জো’ জাতীয়তাবাদ দ্বারা উদ্বুদ্ধ এবং তারা তাদের পিতৃভূমির অখণ্ডতা (যা তারা ১৮৩২ সালে বৃটিশ দখলদারির কারণে হারিয়েছে) এবং সকল জো’ জাতির মিলন চায়। এটা অনেকটা ইহুদীদের ‘রিটার্ন টু দ্য প্রমিজডল্যান্ড’র মতো প্যালেস্টানিদের উচ্ছেদ করে সে ভূমিতে ইহুদিদের ফিরিয়ে আনার মতো চলতি মতবাদ। ইহুদিরা মনে করে জেরুজালেমসহ প্যালেস্টাইন ভূমি হলো ‘গডস চুজেন পিপল’ শুধু ইহুদিদের জন্য। বাকীরা সব বহিরাগত। কুকিরাও তাই মনে করে লুসাই হিলসের পাদভূমি কুকিদের পিতৃভূমি, বাকীরা (চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা) সব বহিরাগত। তারা বৃটিশ আমল থেকে এপর্যন্ত সকল রাজনৈতিক কারণে দেশান্তরীত সকল কুকি জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবর্তন চায় পার্বত্য চট্টগ্রামের নয়টি উপজেলা নিয়ে তাদের কল্পিত স্বপ্ন রাজ্যে- যা একটা পৃথক শাসন ব্যবস্হা ও পৃথক স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল।
তাহলে প্রশ্ন জাগে, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে প্রদত্ত ‘রিজিয়নাল কাউন্সিল ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের মাধ্যমে দেওয়া আঞ্চলিক শাসন ব্যবস্হার ভবিষ্যৎ কী? কিংবা সন্তু লারমার সাথে সরকার কী চুক্তি করলো যদি কুকিরা তাতে সন্তুষ্ট না হয় চুক্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত স্ব-শাসন ব্যবস্হায়?
এমন প্রশ্নও উঠবে, কেএনএফ’র আজকের উচ্চকণ্ঠ তখন (২ ডিসেম্বর ১৯৯৭) কোথায় ছিলো? কারা তখন কুকিদের প্রতিনিধিত্ব করেছে? ‘জো’ জাতীয়তাবাদের ধ্বনি তখন কি কেউ তুলেছিলো?
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হবে, ‘জো’ আর ‘জুম্ম’ জাতীয়তাবাদের দ্বন্দ্ব তাহলে কীভাবে মিটানো হবে?
ধর্মীয় বিভাজন জাতিগত সংঘাতে সবসময়ই এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এই অঞ্চলে। খৃষ্টান অধ্যুষিত নাগাল্যান্ড, চিন, মিজোরাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের কুকি জনগোষ্ঠী নতুন এক মাত্রা যোগ করেছে। এই অঞ্চলে একটা ‘লর্ডস কিংডম’ অনেকেরই কাম্য। কিন্তু সন্তু লারমা কি তার নিয়ন্ত্রণ ভাগাভাগি করবেন নাথান বমের সাথে? কিংবা সরকারের হাতে কি আরেকটা সুযোগ আছে কেএনএফ’র সাথে আলাদা কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থায় যাওয়ার?
লেখক: পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সামরিক বিশ্লেষক