আলীকদমে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও বাঙালিদের জনপ্রিয় সু-স্বাদু খাবার বাশঁ কোড়ল

fec-image

বান্দরবানের আলীকদম উপজেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির পাশাপাশি-বাঙালি জনগোষ্ঠীর অন্যতম জনপ্রিয় সু-স্বাদু খাবার এখন বাঁশ কোড়ল। মার্মারা একে বলে ” মেহ্যাং ” আর ত্রিপুরাদের কাছে ” মেওয়া” , চাকমা ভাষায় বলা হয় ‘বাচ্ছুরি’ ,তঞ্চঙ্গ্যাঁ ভাষায় ” বাচ্ছুুই”, বাঙালি জনগোষ্টির ভাষায় ” বাঁশ কোড়ল ” বলে ডাকে। মূলত বাঁশের গোঁড়ার কচি নরম অংশকে বলা হয় বাঁশ কোড়ল। বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ের প্রায় সব স্থানেই মেলে এ সবজি।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিদের পাশাপাশি এটি এখন বাঙ্গালিদেরও জনপ্রিয় একটি খাবারে পরিণত হয়েছে। প্রতি বর্ষা মৌসুমে বাঁশ বাগানে জন্ম নেয় নতুন নতুন কোড়ল। এসব বাঁশে পরিণত হওয়ার আগেই প্রতিদিন বাজারে বিক্রি হয় দেদার। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিদের পাশাপাশি বাঙালিরাও এখন বাঁশ কোড়ল খেতে শুরু করেছে। ফলে দিন দিন বাঁশ উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে ব্যাপক হারে।

গত কয়েক বছরে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বাঁশ অংকুরেই ঝরে পড়েছে বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। সচেতন মহল জানিয়েছেন, বাঁশ কোড়ল নিধন অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই এই অঞ্চল থেকে বাঁশ সম্পদ একেবারেই হারিয়ে যাবে।

জানা গেছে, বছরের মে থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত এ সবজির ভরা মৌসুম থাকে। মুলি বাঁশ, ডলু বাঁশ, মিতিঙ্গ্যা বাঁশ, ফারুয়া বাঁশ, বাজ্জে বাঁশ, কালিছুরি বাঁশসহ বেশ কয়েক প্রজাতির বাঁশ কোড়ল পাওয়া যায়। বর্ষার শুরুতে বৃষ্টির পানিতে মাটি নরম হলে এটি বাড়তে শুরু করে। মাটি হতে ৪-৫ ইঞ্চি গজিয়ে উঠলে এটি খাওয়ার উপযোগী হয়। বিভিন্ন জাতের বাঁশ কোড়ল স্বাদে ভিন্ন ভিন্ন । তবে মুলি বাঁশ কোড়ল সবচেয়ে সুস্বাদু হওয়ায় সবার কাছে এটি জনপ্রিয়।

ফলে বাজারে এর চাহিদা ও দাম কিছুটা বেশি। বর্ষা মৌসুমে প্রতিদিন সকাল-বিকাল বাজারে বাঁশ কোড়ল নিয়ে যান স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিরা। প্রতি কেজি বাঁশ কোড়ল পাওয়া যায় ৬০ – ১০০ টাকার মধ্যে। তবে চাহিদা অনুযায়ী এর দাম কম-বেশি হয়ে থাকে।

বর্তমানে পারিবারিক চাহিদা মিটিয়ে স্থানীয় হোটেল বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট গুলোতেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে এ সবজি।

আলীকদম উপজেলায় ঘুরতে যাওয়া টুরিস্ট ও পর্যটকদের কাছে এখন অন্যতম আকর্ষণ বাঁশ কোড়ল। এছাড়া এ সবজি বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন বিভিন্ন দূর্গম পাহাড়ি পল্লীর বহু মানুষ। প্রায় প্রতিদিনই দূর-দূরান্ত থেকে মাথায় থ্রুং (বিশেষ ঝুড়ি) বেঁধে বাজারে আনা বাঁশ কোড়লের পসরা সাজিয়ে বসেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি নারীরা।

পানবাজার এলাকায় বাশঁ কোড়ল বিক্রি করতে আসা রত্না তঞ্চঙ্গ্যা,প্রভাতি তঞ্চঙ্গ্য জানান, তারা প্রতি হাটের দিন সোমবার প্রায় ৭০/১০০ আঁটি বাঁশ কোড়ল বাজারে আনেন। প্রতি আঁটি ৬০ -১০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। বাঁশ কোড়ল বিক্রি করে যে টাকা পান সে টাকা দিয়ে চাউল, বাজারসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র কিনে সংসার চালান তারা।

অপর দিকে ২নং চৈক্ষ্যং ইউনিয়নের রেফার পাড়া বাজারে বাঁশ কোড়ল বিক্রি করতে আসা উওয়াংচিং মার্মানির সাথে কথা বলে জানা গেছে, তিনি সারাদিন রোদ বৃষ্টিতে ভিজে বাঁশ কোড়ল সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করেন, সংসার চালানোর তাগিদে। তার মতো আরও অনেকে সাপ্তাহিক দু’দিন হাট-বাজার ছাড়াও প্রতিদিন সকালে অথবা বিকালে বাঁশ কোড়ল বিক্রি করেন বাজারে। বাঁশ কোড়ল বিক্রির টাকা দিয়ে সংসার চালান তারা। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিদের পাশাপাশি বাঙালিদের কাছেও এ সবজি বেশ জনপ্রিয়।

স্থানীয়রা জানান, পাহাড়ে কয়েক প্রজাতির মূল্যবান বাঁশ জন্মায়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ডলু, কাতি, মিতিঙ্গা, মুলি, কালী ও ছোটিয়া। মূলত বছরের জুন-আগস্ট মাসে বর্ষা মৌসুমে বাঁশের বংশ বৃদ্ধি হয়। এ সময় পাহাড়ের গায়ে মাটি ভেদ করে উঠতে শুরু করলে পাহাড়িরা তা সংগ্রহ করে বাজারজাত করেন।

এছাড়া পাহাড়ে দিন দিন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ও প্রাকৃতিক কারণেও বাঁশবন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। ফলে চাহিদার তুলনায় বাঁশ কোড়ল এখন অপ্রতুল। সরকারি ভাবে বাঁশবন সংরক্ষণ করা না গেলে একসময় পার্বত্যাঞ্চল থেকে হারিয়ে যাবে বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ, সেইসঙ্গে বাঁশ কোড়ল। রাশেদা বেগম, উষা মার্মাসহ বেশ কয়েকজন গৃহীনি জানায়, স্যুপ, মুন্ডি, মাংস দিয়ে রান্না ও ভাজি করে খাওয়া যায় বাঁশ কোড়ল।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত চার বছর আগে পার্বত্য অঞ্চলে বাঁশে ফুল আসে ও মড়ক সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি ইঁদুর বন্যা দেখা দেয়। ফলে একদিকে বাঁশ বাগানে মড়ক অন্যদিকে ইঁদুরও বাঁশ বাগান নষ্ট করে ফেলে। এতেও বাঁশের উৎপাদন কমে যায়। প্রাকৃতিকভাবে বাঁশে মড়ক লাগার দু’বছরের মধ্যে আবার বাঁশের উৎপাদন শুরু হয়। গত বছর প্রতি হাজার মুলি বাঁশের দাম ছিল ১০-১১ হাজার টাকা। এরপরও অনেক পাহাড়ি পরিবার ঘর মেরামত ও নতুন ঘর তৈরি করতে অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে বলে জানিয়েছেন।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আলীকদম, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, বাঙালি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন