রুমা এবং আলীকদমে স্থায়ী সেনানিবাস গড়ে তোলার সময় এসেছে

fec-image

গত কিছু দিন ধরে বান্দরবানের রুমা এবং রাঙামাটির বিলাইছড়ির দুর্গম এলাকায় যৌথবাহিনী অপারেশন পরিচালনা করছে। র্যাবের হাতে আটক জঙ্গি সংগঠনের কয়েক সদেস্যের দেয়া তথ্য-উপত্তের ভিত্তিতেই মূলত এই অপারেশনের শুরু। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়, বান্দরবানের গহীন অরণ্যে নবগঠিত সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফের ঘাঁটিতে অবস্থান করে সশস্ত্র জঙ্গিরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। আটককৃতদের এমন স্বীকারুক্তির পরিপ্রেক্ষিতেই নড়েচেড় বসে প্রশাসন। তারা দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে কেএনএফের ঘাঁটিতে অভিযান পরিচালনার। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেও এ ব্যাপারে গণমাধ্যমকে বলেছেন, সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ এবং তাদের ঘাঁটিতে অবস্থান করা জঙ্গিদের ধরার জন্যই মূলত এই অপারেশন পরিচালনা করা হচ্ছে।

এই অপারেশন ঠিক কবে শুরু হয়েছে এবং কবে নাগাদ শেষ হতে পারে সে ব্যাপারে আমাদের কাছে এখনো নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই। তবে জেএসএস এবং কেএনএফের তরফ থেকে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজাকি যোগাযোগের মাধ্যমে এই অপারেশন নিয়ে নানা রকম প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। অপারেশন চলাকালে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে এবং তাতে উভয় পক্ষের হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে বলে প্রচার করা হচ্ছে সংগঠন দুটির পক্ষ থেকে।

জেএসএসের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কেএনএফের সাথে যৌথবাহিনীর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে এবং তাতে কেএনএফের ৩ সদস্য নিহত হয়েছে, ৩ সদস্য আটক হয়েছে। অন্যদিকে কেএনএফের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যৌথবাহিনীর উপর তারা কোনো হামলা করেনি, বরং তাদের উচ্চ মহলের নির্দেশে সংঘাত এড়ানোর জন্য যৌথবাহিনী তাদের ঘাঁটিতে পৌঁছার আগেই তারা পিছু হটেছে। তবে জেএসএসের সশস্ত্র সংগঠন জেএলএ’র সদস্যরা অ্যাম্বুশ করে যৌথবাহিনীর উপর হামলা করে হতাহতের ঘটনা ঘটিয়ে এর দায় কেএনএফের উপর চাপিয়ে মিথ্যা ছড়াচ্ছে।

জেএসএস এবং কেএনএফের প্রচার-অপ্রচারের পরিপ্রেক্ষিতে যৌথবাহিনীর পক্ষ থেকে এখনো বিস্তারিত না জানানোর কারণে প্রকৃত পক্ষে সেখানে কী ঘটেছে বা ঘটছে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে এটা অন্তত নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, যৌথবাহিনীর অভিযানের ফলে নবগঠিত কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এবং এতদিন বাংলাদেশ-ভারত-মায়ানমার এই ত্রিদেশীয় সীমান্ত এলাকায় দাপিয়ে বেড়ানো অন্যান্য সশস্ত্র সন্ত্রাসীরাও কোণঠাসা হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এইভাবে অভিযান চালিয়ে আর কতদিন এই দুর্গম এলাকাকে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের প্রভাবমুক্ত রাখা যাবে? তার চেয়ে বরং এর স্থায়ী সমাধানের কথা ভাবার সময় এসেছে বলে আমরা মনে করছি। কেননা, দুর্গমতার কারণে এই অঞ্চলে সশস্ত্র গোষ্ঠিগুলোর অভয়ারণ্য হওয়ার আশঙ্কা বহু পূর্ব থেকেই অনুভূত হচ্ছিল। দেশের ভেতরের এবং বাইরের সশস্ত্র গোষ্ঠিগুলোর সদস্যদের এ অঞ্চলে বিভিন্ন সময় অবস্থান করার কথা নানা সময় শোনা গেছে। বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করে জেএসএস সভাপতি সন্তু লারমাও এ অঞ্চলে স্থায়ী সেনানিবাস গড়ে তোলার ব্যাপারে একমত হয়ে পার্বত্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন।

পার্বত্যচুক্তির ‘ঘ’ খণ্ডের ১৭(ক) ধারায় খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবান ব্রিগেডের পাশাপাশি দীঘিনালা, আলীকদম এবং রুমাতেও অনুরূপ স্থায়ী সেনানিবাস থাকার ব্যাপারে উভয় পক্ষ একমত হয়েই ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এতদিন সেটির বাস্তবায়ন না হলেও এখন সময় এসেছে, তা বাস্তবায়ন করে ওই দুর্গম অঞ্চলের জনমানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে, সাম্প্রতিক সময়ে সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ এবং তাদের সাথে জঙ্গিদের কানেকশানের ব্যাপারে যে খবর প্রচারিত হয়েছে, তা সঠিক হলে বিষয়টি অবশ্যই আতঙ্কের।

অন্যদিকে আলীকদম এবং নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তের অপর পাশের বিশাল এলাকা মায়নমারের সেনাবাহিনীর হাতছাড়া হয়ে গেছে, সেখান থেকে সেদেশের রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে হটিয়ে দিয়ে দখল নিয়েছে আরাকান আর্মি নামের একটি বিদ্রোহী সশস্ত্র সংগঠন। এটা আমাদের সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তার জন্যও হুমকিস্বরূপ। কেননা, আমাদের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় অপর দেশের একটি বিদ্রোহী সশস্ত্র সংগঠনের আস্তানা থাকলে তা থেকে যে কোনো সময় আমাদের নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে।

সাম্প্রতিক সময়ে মায়ানমার সেনাবাহিনী বিদ্রোহীদের নির্মূল অভিযান শুরু করার পর অনেক গোলা আমাদের ভূখণ্ডেও এসে পড়েছে এবং এখনো মাঝে মাঝেই সীমান্তের ওপারে তুমুল গোলা-গুলির ঘটনা ঘটছে। তাছাড়া মায়ানমারের পক্ষ থেকেও একাধিকবার অভিযোগ করে বলা হয়েছে যে, তাদের দেশের বিদ্রোহী গোষ্ঠির সদস্যরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও ঘাঁটি গেড়ে অবস্থান করে থাকে। তাই ভবিষ্যতে যেন এই ধরনের অভিযোগ মায়ানমার আর করতে না পারে এবং তাদের আভ্যন্তরীণ সমস্যার জেরে আমাদের সীমান্ত এলাকার মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয় তার জন্য সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এটা জোর দিয়ে বলা যায় যে, পার্বত্যচুক্তির শর্ত মোতাবেক আলীকদম এবং রুমায় স্থায়ী সেনানিবাস গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। আশা করি, বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখবেন।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আলীকদম, রুমা, স্থায়ী সেনানিবাস
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন