সন্তু লারমা পাহাড়ে অশান্তির বিষ বৃক্ষ লালন করছেন

fec-image

সন্তু লারমা বাংলাদেশের নাগরিক না হয়েও জাতীয় পতাকা ও রাষ্ট্রীয় সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। অথচ বাংলাদেশকে স্বীকার করেন না। শুধু তাই নয়, তিনি রাষ্ট্রের অংশ হয়েও বার বার অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। নিজে নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে এসি রুমে থাকলেও তার সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা পাহাড় জুড়ে হত্যা, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি অব্যাহত রেখেছে। তার এসব কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকলেও সরকার ও রাষ্ট্র নির্বিকার।

পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় ওরফে সন্তু লারমা পাহাড়ে অশান্তির বিষ বৃক্ষ। বাংলাদেশের নাগরিক না হয়েও জাতীয় পতাকা ও রাষ্ট্রীয় সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। অথচ বাংলাদেশকে স্বীকার করেন না। শুধু তাই নয়, তিনি রাষ্ট্রের অংশ হয়েও বার বার অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। নিজে নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে এসি রুমে থাকলেও তার সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা পাহাড় জুড়ে হত্যা, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি অব্যাহত রেখেছে। তার এসব কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকলেও সরকার ও রাষ্ট্র নির্বিকার। এখন সময় এসেছে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে কাগুজে বাঘ সন্তু লারমাকে আঞ্চলিক পরিষদ থেকে অপসারনের। দাবীও উঠেছে সন্তু লারমাকে হত্যা, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির জন্য গ্রেফতারের।

প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের এক রূপময় ভূখণ্ড। এরূপ দেশের সমতল ভূমি থেকে ভিন্ন। পার্বত্য অঞ্চলে রয়েছে ঢেউ খেলানো হাজারো ছোট বড় পাহাড়। যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই শুধু পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়ের বুক চিরে আপন মনে বয়ে চলেছে ফেনী, চেঙ্গী, মাইনী, সাঙ্গু ও মাতামহুরীসহ অসংখ্য নদী-খাল আর ছড়া। সবুজ বনে আবৃত শান্ত পাহাড়ের উপড় আছঁড়ে পড়ছে আকাশের শুভ্র মেঘ। সৃষ্টিকর্তা যেন তার মনের মাধুরী দিয়ে সাজিয়েছে দেশের এই এক দশমাংশ অঞ্চল।

দেশের সমতল অঞ্চলের তুলনায় এ অঞ্চলের প্রকৃতি যেমন ভিন্নতর তেমনি আইন-কানুন , রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিও সম্পূর্ণ আলাদা। দেশের সমতল ভূ-খণ্ডে দাঁড়িয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করাও সহজ নয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও দেশের প্রচলিত শাসন ব্যবস্থা এখানে কার্যত অচল। পার্বত্য চুক্তির বলে এ অঞ্চলে তৈরি করা হয়েছে বৈষম্যের দেয়াল। সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও এ অঞ্চলে বসবাসকারী বাঙ্গালীদের আজ সমঅধিকারের জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় সরকার ও শান্তিবাহিনীর রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় ওরফে সন্তু লারমার সাথে স্বাক্ষরিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি।

“পার্বত্য চুক্তির মুখবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া তরান্বিত করা এবং বাংলাদেশের সকল নাগরিকের স্ব-স্ব অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার আধিবাসীদের পক্ষ হইতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নিম্নে বর্ণিত চারি খণ্ড(ক,খ,গ,ঘ) সংম্বলিত চুক্তিতে উপনীত হইলেন”। কিন্তু বাস্তবে চুক্তির পর সন্তু লারমা কোন শর্তই রক্ষা করেননি। বরং গত দুই যুগে তিনি উল্টো পথে হাটছেন। নিজে অস্ত্র জমা দেওয়ার নাটক দেখালে জঙ্গলে রেখে এসেছেন তার সশস্ত্র সহকর্মীদের। তাদের হাতে রয়েছে বিশাল অস্ত্রের ভাণ্ডার। আর এই অবৈধ অস্ত্র দিয়ে সাধারণ মানুষের উপর স্টিম রোলার চালাচ্ছে। কখনো কখনো নিরাপত্তা বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করছে।

চুক্তির এ মুখবদ্ধ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল নাগরিকের সাংবিধানের আওতায় প্রাপ্ত সকল সুযোগ সুবিধা প্রদান করার এবং সকল নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন।

প্রথমত: সন্তু লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নন। তিনি এ অঞ্চলের উপজাতীয়দের একটি ক্ষুদ্র অংশের সশস্ত্র গ্রুপের নেতা মাত্র। তিনি পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্বা ও বাঙ্গালীসহ ব্যাপক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন না।

পার্বত্য অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙ্গালীসহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী সন্তু লারমাকে তাদের পক্ষে চুক্তি সম্পাদনের জন্য ম্যান্ডে প্রদান করেনি। তাছাড়া চুক্তি সম্পাদনের সময় এ অঞ্চলে বসবাসকারী কোন বাঙ্গালী কিংবা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি রাখা হয়নি। সন্তু লারমা পার্বত্য বাঙ্গালীদের স্বার্থের পরিপন্থী যে অসম চুক্তি করেছে মুখবন্ধের ভাষ্য অনুযায়ী তা কোনক্রমেই সংবিধানিক বলা যায় না।

সংবিধানে সকল নাগরিকের সমান সুযোগ সুবিধা প্রদানের কথা থাকলেও পার্বত্য চুক্তিতে চাকুরি, শিক্ষা, ব্যবসা ভূমি অধিকার, নাগরিকত্ব, ভোটাধিকার প্রভৃতি প্রশ্নে একটি গোষ্ঠীকে একতরফা সুযোগ সুবিধা প্রদান করার উল্লেখ আছে। এ চুক্তির কোথাও পার্বত্য বাঙ্গালীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করার কথা উল্লেখ নেই। এ চুক্তি বাংলাদেশের সংবিধানের এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র চেতনার পরিপন্থি। চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোকে যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তাতে বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি জেলা পরিষদ সমূহকে পৃথক আরও একটি সরকার বলা যায়।

রাষ্ট্রীয় উপাদানের অন্যতম উপাদন হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ড। এ ভূ-খণ্ড অর্থাৎ ভূমির মালিক হচ্ছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের পক্ষে সরকার আর সরকারের পক্ষে প্রতিটি জেলায় জেলা প্রশাসকরা ভূমি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু পার্বত্য চুক্তির সাধারণ অংশের ২৬নং ধারা পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের ৬৪ নং ধারা সংশোধন পূর্ব অনুমোদন ভূমি ক্রয়-বিক্রয়ে পূর্ব অনুমোদন ও খাস জমি বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে পূর্ব অনুমোদন, কানুনগো, সার্ভেয়ার সহকারী ভূমি কমিশনারদের তত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ রূপে জেলা প্রশাসকদের পরিবর্তে পার্বত্য জেলা পরিষদ সমূহের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। এমনকি চুক্তি ২৬(খ) ধারার শর্ত অনুযায়ী স্বয়ং সরকার জেলা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া কোন সম্পত্তি হুকুম দখল কিংবা হস্তান্তর করতে পারবে না মর্মে উল্লেখ আছে। যা দেশের সংবিধান এবং সার্বভৌমত্বের পরিপন্থি।

বাংলাদেশের সংবিধান অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে রাষ্ট্র কর্তৃক যে সুযোগ দেয়ার কথা বলা হয়েছে তা বাঙ্গালীদের বঞ্চিত করে শুধু মাত্র উপজাতীয়দের প্রাপ্য নয়। পার্বত্য অঞ্চলে অনগ্রসর জাতি হিসাবে বাঙ্গালীদের বুঝানো হয়। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র নিরাপত্তাজনিত কারণে সেনাবাহিনী কোথায় থাকবে, কি থাকবে না তা রাষ্ট্রের নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু চুক্তিতে পর্যায়ক্রমে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের বিষযটি সংযুক্ত করে এতদাঞ্চলকে নিরাপত্তাহীন করে তোলার পথ সুগম করা হয়েছে।

চুক্তির শর্ত অনুযায়ী এ পর্যন্ত প্রায় আড়াই শতাধিক নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। ফলে পার্বত্যাঞ্চল ক্রমেই অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। সে সাথে বেড়েই চলেছে সন্তু লারমাসহ জেএসএসসহ সশস্ত্র সন্ত্রাসী তৎপরতা। যার প্রমাণ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদের ঢুকে প্রকাশ্য দিবালোকে একজন জনপ্রতিনিধিকে গুলি করে হত্যা।

বাংলাদেশ সংবিধানের ১নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশ এক কেন্দ্রীক রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃত। এখানে আঞ্চলিক শাসনের কোন স্থান নেই। সংবিধানের ১৯(১) অনুসারে রাষ্ট্রের সকল নাগরিক সমান সুযোগ সুবিধা ভোগ করবে । অনুচ্ছেদ ২৭ অনুসারে রাষ্ট্রের সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান ও আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। অনুচ্ছেদ ২৮(১) অনুসারে কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষের ভেদ বা জম্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না।

অনুচ্ছেদ ২৯(১) অনুসারে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে। কিন্তু পার্বত্য চুক্তিতে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীকে একপেশে ও বৈষম্যমূলক যে সব সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে পক্ষান্তরে বাঙ্গালীদের সর্ব বিষয়ে বঞ্চিত করা হয়েছে। যা সংবিধানের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। অথচ বাংলাদেশ সংবিধানের ৭(২) ধারায় উল্ল্খে করা হয়েছে, সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। অন্য কোন আইন যদি সংবিধানের সাথে অসামঞ্চস্যপূর্ণ হয় তবে সে আইনের যতখানি অসামঞ্চস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হইবে।

বাংলাদেশ সংবিধানের ১১ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে কোন ব্যক্তিকে ভোটার হতে হলে প্রথমত: বাংলাদেশের নাগরিক, দ্বিতীয়ত: বয়স ১৮ বছর কিংবা তদ্ধউধর্ব এবং কোন যোগ্য আদালত কর্তৃক অপ্রকৃতিস্থ ঘোষণা না হওয়া এবং কোন নির্দিষ্ট ঠিকানায় বসবাস করতে হবে এ রূপ শর্ত রয়েছে। কিন্তু পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী শুধুমাত্র বাঙ্গালীদের ক্ষেত্রে সংবিধান বহির্ভূত অতিরিক্ত একটি শর্ত তথা ভোটার হতে হলে বৈধ জায়গা জমির মালিক হবার শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে এবং স্থানীয় বাসিন্দার সনদপত্র রাজা ও হেডম্যানদের উপর ন্যস্ত করেছে। পার্বত্য চুক্তির শর্তের ফলে এ অঞ্চলের হেডম্যান ও সার্কেল চিফরা উপজাতীয় হওয়ায় বাঙ্গালীদের ভূমির বৈধ মালিক হতে অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছে।

ইতিমধ্যে তারা পার্বত্যাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে বাঙ্গালীদের নাগরিকত্বের সনদপত্র দেয়ার ক্ষেত্রে নানা জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে প্রশাসনিক জটিলতায় পড়ে ভূমির মালিকানা অর্জনে ব্যর্থ বিশাল বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী তাদের সংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ বাংলদেশ সংবিধান দেশের সকল ভূমিহীনদের ভোটাধিকারের সুযোগ দিয়েছে।

সন্তু লারমা শান্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরকারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করলেও বাস্তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে কাঙ্খিত শান্তি ফিরে আসেনি। বরং চুক্তির পরও খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে। চুক্তির আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধুমাত্র জনসংহতি সমিতিকে চাঁদা দিতে হতো। কিন্তু চুক্তির পর জেএসএস(সন্তু), জেএসএস(এমএন) (প্রসিতের ইউপিডিএফসহ একাধিক সশস্ত্র গ্রুপকে চাঁদা দিতে হচ্ছে। এরা চাঁদার জন্য প্রতিদিন বিভিন্ন সেক্টরে হানা দিচ্ছে।

বিশেষ করে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্পগুলো পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করে নেয়ার ফলে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। বেড়েছে সন্ত্রাসীদের দৌরাত্য। চুক্তি স্বাক্ষরের পরের দিনই চুক্তি প্রত্যাখান করে প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে জম্ম নেয় ইউপিডিএফ নামে আরও একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এদের দাবি পার্বত্য চট্টগ্রামে পূণর্ শায়ত্বশাসন। শুরু হয় জনসংহতি সমিতি ও প্রসীতের ইউপিডিএফ’র মধ্যে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। প্রতিনিয়ত ঘটছে দু’পক্ষের মধ্যে বন্দুক যুদ্ধ, পাল্টাপাল্টি অপহরণ, মুক্তিপন আদায় ও চাঁদাবাজির ঘটনা। পর্যায়ক্রমে বর্তমানে পাহাড়ে চার চারটি সশস্ত্র গ্রুপের হাতে জিম্মি সাধারণ মানুষ। চুক্তির আগে সন্ত্রাসীদের হাতে দেখা যেতো ভাঙ্গাচোরা অস্ত্র। আর এখন দেখা যাচ্ছে এম-১৬, একে-৫৬, একে-৪৭, এলএলজি, এসএমজি ও রকেট ল্যাঞ্চারসহ আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র।

এক পরিসংখানে দেখা যায়, চুক্তির পর সন্তু লারমার জেএসএস, জেএসএস(এমএন)প্রসীতে ইউপিডিএফ ও ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের সশস্ত্র লড়াইয়ে এ পর্যন্ত সহাস্রধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এছাড়া এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বন্দুকযুদ্ধ, নিরাপত্তা বাহিনীর টহল দল ও বাঙ্গালীদের উপর অন্তত ৫শতাধিক বার হামলা হয়েছে।

পার্বত্য চুক্তির ধূয়া তুলে সন্তু লারমা পৃথক ভোটার তালিকা প্রণয়নের দাবি জানিয়ে আসছেন। তিনি এ দাবীতে এখনো ভোটার তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভূক্ত করেননি। তবে এটা আশ্চর্যের বিষয় সন্তু লারমা বাংলাদেশের ভোটা না হলেও তিনি বছরের পর পর প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হিসাবে রাষ্ট্রীয় পতাকা ব্যবহার করছেন এবং রাষ্ট্রের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। এটা কতটুকু সংবিধান সম্মত তা দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ভোটার তালিকা প্রণয়ন হলে বাঙ্গালীরা দীর্ঘদিন যাবত পার্বত্য এলাকায় বসবাস করা সত্বেও বৈধ ভূমির মালিক না হওয়ার কারণে ভোটার হতে পারবে না। যা বাঙ্গালীদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে কঠিনভাবে অন্তরায় সৃষ্টি করছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলিক পরিষদ এ অঞ্চলের জনপ্রতিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান পদ সমূহ শুধু মাত্র উপজাতীয়দের জন্য সংরক্ষিত এবং সদস্যদের ক্ষেত্রেও দুই তৃতীয়াংশই উপজাতীয়। আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান প্রতিমন্ত্রী ও জেলা পরিষদ সমূহের চেয়ারম্যানরা উপমন্ত্রীর মর্যাদা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদ সমূহের উপর অভাবনীয় ক্ষমতা ন্যাস্ত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভূমি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, পর্যটন, ক্রীয়া, সাংস্কৃতি প্রভৃতি সরকারি বিভাগ এসব পরিষদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ সব প্রতিষ্ঠানে উপজাতীয় সদস্যদের সংখ্যাধিকের কারণে বাঙ্গালীরা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী পদ মর্যাদার অভ্যন্তরীন উদ্বাস্তু চিহ্নিতকরন টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান পদটি শুধু মাত্র উপজাতীয়দের জন্য সংরক্ষিত। এ সকল পদে বাঙ্গালীদের পদায়নের সুযোগ রাখা হয়নি। এছাড়াও তিন পার্বত্য জেলায় তিন সার্কেল চিফ রাজা রয়েছেন।

অধিক ক্ষমতা সম্পন্ন এ সকল পদ সমূহ শুধু মাত্র উপজাতীয়দের জন্য সংরক্ষিত রাখায় বাঙ্গালীরা ক্ষমতার ভারসাম্যের পাশাপাশি চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। পার্বত্য জেলা সমূহের প্রতিটি মৌজায় একজন করে হেডম্যান বা মৌজা প্রধান রয়েছে। এ অঞ্চলের ভূমির খাজনা আদায়, ভূমি হস্তান্তর, ওয়ারিশন সনদপত্র ও নাগরিকত্বের সনদপত্র হেডম্যান বা মৌজা প্রধানরা ইস্যু করে থাকেন। এসব কর্তাব্যক্তিরা প্রায় সকলেই উপজাতি হওয়ায় বাঙ্গালীরা বৈষম্য ও হয়রানির শিকার হচ্ছে। উপজাতীয় হেডম্যানরা বাঙ্গালীদের ওয়ারিশন সনদপত্র ও নাগরিকত্বের সনদপত্র প্রদানে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে এবং অনেক ক্ষেত্রে দিচ্ছে না । তাছাড়াও ভূমি হস্তান্তর, ও ক্রয়-বিক্রয়েও বাঙ্গালীরা হয়রানির শিকার হচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা, চাকুরি, কর্মসংস্থান, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সর্ব ক্ষেত্রে বাঙ্গালীরা প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। ফলে ক্রমশ: পশ্চাৎপদে পরিণত হচ্ছে বাঙ্গালীরা। শিক্ষা ক্ষেত্রে বাঙ্গালীরা উপজাতীয়দের চেয়ে বহু পিছিয়ে রয়েছে। উপজাতীদের শিক্ষার হার ৯৭ % এবং বাঙ্গালীরা মাত্র ৩ % । তা সত্বেও উপজাতীরা বিভিন্ন কোটায় শিক্ষা বৃত্তি, সেনামৈত্রী বৃত্তিসহ উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ ভ্রমনে ১০০% সুযোগ পেলেও বাঙ্গালীরা বঞ্চিত হচ্ছে।

শিক্ষা ও কোটা ক্ষেত্রে একটি জনগোষ্ঠী নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলেও বাঙ্গালী ছাত্র/ছাত্রীরা অনেকটা বঞ্চিত। এ ধরনের বিদেশী সকল সংস্থা ও এনজিওগুলোতে একচেটিয়াভাবে একটি গোষ্ঠীকে সুযোগ দেয়া হলেও সকল যোগ্যতা থাকা সত্বেও বাঙ্গালী হওয়ার অপরাধে বঞ্চিত হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকুরীর ক্ষেত্রে উপজাতীদের বয়স ১০ বছর শিথিল করা হলেও বাঙ্গালীদের সে সুযোগ নেই। ঠিকাদারী ব্যবসার ক্ষেত্রে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত কাজ উপজাতীদের জন্য সংরক্ষিত। এর উপরের মূল্যমানের কাজগুলোতেও উপজাতীরা উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার সুযোগ ভোগ করছে। বাঙালি ঠিকাদাররা আয়কর দিতে হয়। পাহাড়ি ঠিকাদারদের আয়কর দিতে হয় না। ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে একই ধরনের বৈষম্য।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালীদের কয়েকশত বছরের ইতিহাস রয়েছে। তা সত্বেও এদের সেটেলার, বহিরাগত ও অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ইত্যাদি অপবাদ দেয়া হয়। পক্ষান্তরে এ অঞ্চলের একটি জনগোষ্ঠীকে বলা হয় আদিবাসী। যা সংবিধান স্বীকৃত নয়। অপর দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘ উপজাতীয় খ্রিষ্টান’ বলয় গড়ে তুলতে পশ্চিমা সহায়তাপুষ্ট এনজিওরা দীর্ঘদিন ধরে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এদের তৎপরতায় পার্বত্যাঞ্চলের ক্ষুদ্র উপজাতীয় গোষ্ঠীগুলো অস্তিত্ব যেমন বিলুপ্তির সম্মুখীন তেমনি ক্ষেত্রবিশেষ পাহাড়ি-বাঙ্গালী বিরোধে ইন্ধন যোগানো, বহির্বিশ্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে মিথ্যা-বানোয়াট প্রচারনা চালাচ্ছে। ফলে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের ভাবমূর্তিও দীর্ঘদিন ধরে অনাকাঙ্খিতভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে।

শান্তিবাহিনীর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের প্রেক্ষিতে ১৯৮৬ সালে ২৬ হাজার বাঙ্গালী পরিবার নিজেদের বসত ভূমি থেকে ৮৬টি গুচ্ছগ্রামে আবদ্ধ। এখানে তাদের কোন কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। জীবন ধারনের একমাত্র সম্বল সরকার বরাদ্দ মাসিক ৮৬ কেজি খাদ্যশষ্যের রেশন। কথা ছিল পরিস্থিতি শান্ত হলে এদের নিজ ভূমিতে ফিরিয়ে নেয়া হবে। অথচ তিন যুগের দ্বার প্রান্তে এসেও ফিরিয়ে দেয়া হয়নি এদের ভূমির অধিকার। সেই সময়ের গুচ্ছগ্রামের ২৬ হাজার পরিবার এখন প্রায় পৌঁনে এক লাখ পরিবারে পরিনত হয়েছে। বস্তিরসাদৃশ্য ঘরবাড়িতে তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে। পার্বত্য চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে ১০ বছর কোন জমি পরিত্যক্ত থাকলে বন্দোবস্তি বাতিল হয়ে যাবে। গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দারা এখন ভূমি হারানোর আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে।

বর্তমান সরকারের সাহসী পদক্ষেপের কারণে বিচার বিভাগ শাসন বিভাগ থেকে পৃথক হয়েছে। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা । সাধারণ মানুষের সুবিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু সারা দেশে বিচার বিভাগ পৃথক হলেও পার্বত্য জেলাগুলোতে এর ছোঁয়া লাগেনি। এখনও পার্বত্যাঞ্চলে চলছে উপনিবেশিক আইন-কানুন। পার্বত্য জেলাগুলোতে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার আওতায় এনে অবহেলিত জনপদের মানুষের সুবিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

পার্বত্য চুক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন, বিএনপির নেতৃত্বে তৎকালীন বিরোধী দল।পার্বত্য চুক্তি বাতিলের দাবীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম অভিমুখে বিরোধীদল লং মার্চ করে। লং মার্চের সমাপ্তিতে ১৯৯৮ সালের ৯ মার্চ খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী তার সরকার ক্ষমতায় গেলে চুক্তি বাতিলের ঘোষণাও দেন। কিন্তু জোট সরকারের আমলে চুক্তি বাতিলের পরিবর্তে চুক্তির অনেক আন্তরিকতার সাথে চুক্তি বাস্তবায়ন করে গেছেন এমন অভিযোগ রয়েছে।

বাস্তবে পার্বত্য বাঙ্গালীদের অবস্থা খুবই করুন। এদের কান্না নির্জন পাহাড়ে প্রতিধ্বণি তোলে অন্তহীন হতাশার আর নিস্ফল আবেদন নিয়ে ফিরে আসে। রাষ্ট্র ও সরকার হতদরিদ্র পার্বত্য বাঙ্গালীদের নিরাপত্তা এবং নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে স্পষ্টই ব্যর্থ। এর দায় কে নেবে?

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন