সৌর বিদ্যুতের দাম ইউনিট প্রতি ৪২ টাকা

সেন্টমার্টিনে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি

fec-image

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম লীলাভূমি দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন। প্রতিদিনই দেশি-বিদেশি শত শত পর্যটকের পদভারে মুখর থাকে নারিকেল জিঞ্জিরাখ্যাত এই দ্বীপ। এমন নীল আকাশ আর সাগরের স্বচ্ছ ঢেউ খেলা করে সেন্টমার্টিনের সৈকতে। তীরে বাঁধা নৌকা, নান্দনিক নারকেল গাছের সারি, সব মিলে এক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের হাতছানি প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন।

কিন্তু, পর্যটকের তুলনায় দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি। অভিযোগ রয়েছে হোটেল-মোটেল, রেস্তোঁরা আর পরিবহনে বাড়তি ভাড়া নেয়ার। নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও অসন্তোষ রয়েছে অনেকের। পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়সারা কথিত সিদ্ধান্তে আরো ফুসে উঠেছে দ্বীপবাসী।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে নামেমাত্র সাইনবোর্ড ঝুলানো সতর্কতা দেখা গেলেও বাস্তবে তা উল্টো। বিশেষ করে সমুদ্র সাইকেল চালানো নিষিদ্ধ বলা হলেও কার্যত কিছুই মানা হচ্ছে না।

অপরদিকে বিগত ১০ বছরের যে একমাত্র সড়ক তা এখনো আগের মত। এই সড়ক দিয়ে হাজার হাজার পর্যটক যাতায়াতে কঠিন হয়ে যায়। এরকম কয়েকটা দুর্ঘটনাও হয়েছে। এছাড়া দ্বীপে গ্রামীন এলাকায় পাকা সড়কের বেহাল অবস্থাও চলমান রয়েছে।

এদিকে সেন্টমার্টিনে সৌর বিদ্যুতের দাম ইউনিট প্রতি ৪২ টাকা নিয়ে পুকুরচুরি করছে সংশ্লিষ্টরা। স্থানীয়রা মনে করছেন, এরকম অতিরিক্ত টাকা আদায় একমাত্র দ্বীপেই আদায় করছে। তবে ৪ ও ৫ জানুয়াারি দ্বীপে সফররত কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ ও পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান এবং সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে নানান অভিযোগ শুনেন।

পরবর্তীতে সৌর বিদ্যুতের দাম কমাতে ও সড়কের উন্নয়ন কর্মকান্ড বৃদ্ধি করবে বলে আশ্বাস দেন।

স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বার ও রাজনৈতিক নেতারা স্বাক্ষাত করলে মুজিবুর রহমান বলেন, সেন্টমার্টিনে অনেক দিন পর এসে কিছুটা হতাশ হয়েছি। দ্বীপের উন্নয়ন হয়নি অনেকটা বলা চলে।

তিনি প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনকে পৌরসভায় উন্নীত করনসহ নানান উন্নয়ন প্রকল্পের কথা মন্ত্রনালয়ে উপস্থাপনের জন্য স্থানীয় সাংসদকে পরামর্শ দেন এবং তিনিও জোর প্রচেষ্টা চালাবেন বলে আশ্বাস দেন।

সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি বলেন, সেন্টমার্টিনকে উন্নয়নের রূল মডেল হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি ও তাঁর সহধর্মীনিসহ নানান পদক্ষেপ নিয়েছেন। দ্রুত দ্বীপের সড়ক-উপসড়কের কাজ, ভ্যান চালকদের অফিস, পর্যটকদের নিরাপত্তা এবং সবশেষ সেন্টমার্টিনকে পৌরসভা উন্নীত করতে বিভিন্ন দপ্তরে প্রস্তাব পাঠানো হবে।

তবে সার্বিক বিবেচনায়, ট্যুরিস্ট পুলিশের দাবি, সব সময়ই পর্যটকদের জন্য বাড়তি নিরাপত্তাবলয় থাকে সেন্টমার্টিনে। তবে প্রবালদ্বীপে পর্যটক বাড়াতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আরো পদক্ষেপ চায় স্থানীয়রা।

দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন দ্বীপের আয়তন প্রায় ৮ বর্গকিলোমিটার। এ দ্বীপের তিন দিকের ভিত শিলা, যা জোয়ারে তলিয়ে যায় এবং ভাটার সময় জেগে ওঠে। ভাটার সময় এই দ্বীপের আয়তন ১০-১৫ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত হয়ে থাকে। দ্বীপটি উত্তর ও দক্ষিণে প্রায় ৫.৬৩ কিলোমিটার লম্বা। দ্বীপটির পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে সাগরের অনেক দূর পর্যন্ত অগণিত শিলাস্তুপ আছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের গড় উচ্চতা ৩.৬ মিটার।

পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রায় ৬৬ প্রজাতির প্রবাল ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির গুপ্তজীবী উদ্ভিদ, ২৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, চার প্রজাতির উভচর ও ১২০ প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়।

স্থানীয়ভাবে পেজালা (অ্যালগি) নামে পরিচিত একধরনের সামুদ্রিক শৈবাল সেন্টমার্টিনে প্রচুর পাওয়া যায়। এগুলো বিভিন্ন প্রজাতির হয়ে থাকে, তবে লাল পেজালা বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয়।

এ ছাড়াও রয়েছে ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। অমেরুদন্ডী প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে সপঞ্জ, শিলকাঁকড়া, সন্ন্যাসী শিলকাঁকড়া ও লবস্টার ইত্যাদি। মাছের মধ্যে রয়েছে পরী মাছ, প্রজাপতি মাছ, বোল কোরাল, রাঙ্গা কই, সুঁই মাছ, লাল মাছ ও উড়ক্কু মাছ ইত্যাদি।

টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে দ্যা আটলান্টিক ক্রুজ জাহাজের কক্সবাজারস্থ ইনচার্জ নাসির উদ্দিন বলেন, শীত মৌসুম আসলে দেশি-বিদেশী পর্যটকদের সেন্টমার্টিনে ঢল নামে এবং প্রতিনিয়ত এই সংখ্যা বাড়ছেই।

বিশেষ করে প্রতি শুক্রবার ও শনিবারে পর্যটকের সংখ্যা বেশি থাকে। অনেকেই জাহাজের টিকেটও পায়না। সরকারি বন্ধের দিনে প্রায় ৩ থেকে চার হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিনে ভ্রমণে যায়। প্রতি বছর দেশি-বিদেশী হাজার হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিন দ্বীপে বেড়াতে আসে। তারা সেন্টমার্টিনের প্রাকৃতিক পরিবেশ উপলব্ধি করে। কোনো কোনো পর্যটক ধারণা করেন, সেন্টমার্টিন বিশ্বের সেরা দ্বীপগুলোর মধ্যেই অন্যতম। কিন্তু সেই তুলনায় দৃশ্যমান পর্যটক বান্ধব কোন উন্নয়ন হয়নি।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান খাঁন বলেন, দ্বীপের মানুষ সবসময় পর্যটকবান্ধব। অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও দেশি-বিদেশি পর্যটকরা নিরাপদে সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণ করতে পারছেন। প্রতিবছর পর্যটন মৌসুমে ৫-৬টি জাহাজ যোগে প্রতিদিন গড়ে ৩ থেকে ৫ হাজারের বেশি পর্যটক এ দ্বীপ ভ্রমণে আসেন।

সেন্টমার্টিন দ্বীপে দূর দূরান্ত থেকে আসা পর্যটকরা তাদের ইচ্ছেমতো ঘুরে আনন্দের মধ্যেই নিরাপদে বাড়ি ফিরছেন। এমন কি তাদের এখানে থাকাকালীন কোনো সমস্যাতে পড়তে হচ্ছেনা। তবে দ্বীপবাসীর মানোন্নয়নে এখনো কোন উন্নয়ন হয়নি।

বিশেষ করে বর্তমানে কুকুরের উপদ্রব, বেহাল জেটির বেহাল অবস্থা রয়ে গেছে। অথচ সরকার প্রতিদিন পর্যটকদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করছে।

এদিকে পর্যটকদের যাতায়াত সীমিত করার পাশাপাশি প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনে নিয়ন্ত্রিত পর্যটক চাই বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন কক্সবাজারের ইনভায়রনমেন্ট পিপলস নামের পরিবেশবাদী সংগঠনের প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ বলেন, অতিরিক্ত পর্যটক দ্বীপের ভারসাম্যের জন্য হুমকি এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে বলে পরিবেশ সমীক্ষায় উঠে আসে। আমরা চাই সীমিত পর্যটক আসা-যাওয়া। তারপর দ্বীপের পরিবেশ অন্তত কিছুটা রক্ষা পাবে।

সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা হোটেল সী-প্রবালের পরিচালক আব্দুল মালেক বলেন, দ্বীপে মৌসুম আসলে পর্যটক আসে। কিন্তু কোন উন্নয়ন হয়না। এভাবে হেলেদুলে চলছে দ্বীপের জিবনমাত্রা।

ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো: জিল্লুর রহমান বলেন, ‘সেন্টমার্টিনে পর্যটক সেবায় ট্যুরিস্ট পুলিশ অনেক কার্যক্রম চালু করেছে। রাতদিন ২৪ ঘন্টা সৈকতে পুলিশ টহল রয়েছে। তার সাথে ২৪ ঘন্টা চালু রয়েছে কন্ট্রোল রুম। এতে করে যেকোনো সমস্যায় পর্যটকরা ট্যুরিস্ট পুলিশের সহযোগিতা পাচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কক্সবাজার, পর্যটক, প্রবালদ্বীপ
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন