‘আদিবাসী’ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান

fec-image

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করতে সরকারের সুস্পষ্ট অবস্থান ব্যাখ্যা করে বিভিন্ন সময় প্রজ্ঞাপন জারি করে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করা হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণলায় থেকে জারি করা এসব প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ছোট ছোট সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ না বলে বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী মতে, তাদের উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

দেশের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত সংবাদ, নিবন্ধ, টকশো বা অন্যকোনো কন্টেন্টে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করার ব্যাপারেও সতর্কবার্তা রয়েছে। এমনকি পাঠ্যপুস্তক ও আইনসহ সরকারি সকল ধরনের কাগজপত্রে বিদ্যমান ‘আদিবাসী’ শব্দটি বিলোপের সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেছে সরকার। পাশাপাশি দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী মহলের সহায়তায় যারা অসাংবিধানিক শব্দ ‘আদিবাসী’ দাবি আদায়ের ব্যাপারের কোনো কর্মসূচি বা অনুষ্ঠান করে থাকে তাদের এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জাতীয় শহিদ মিনার, টিএসসি চত্বর, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ব্যবহারের অনুমোতি না দিতেও নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশে বসবাসরত বাঙালি ব্যতিত অন্যান্য জনগোষ্ঠিগুলো সম্পর্কে বাংলাদেশের সংবিধানের ২৩ ক অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা করিবেন’।

অন্যদিকে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির সহিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির চুক্তির ক খণ্ডের ১, খ খণ্ডের ৮, ১১, ১৪(খ), ৩৪(গ), গ খণ্ডের ৩, ৭, ৮(ক), ৯(ঙ), ১৩ ও ঘ খণ্ডের ১, ২, ৩, ৭, ১০, ১১, ১৯ ধারাসমূহে, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন, ১৯৯৮ এর ২(গ), ৫(১)(খ), ৫(২), ৫(৩), ৫(৫), ৭(১), ৭(২), ৮(১), ৮(৩), ২৮, ২৯(১) ধারাসমূহে, পার্বত্য জেলা (স্থানীয় সরকার) পরিষদ আইন, ১৯৮৯ এর ২(খ), ৪(১)(খ, ঘ), ৪(৩), ৪(৪), ৫(১), ৫(২), ৬(১), ৬(৩), ১৪, ১৯, ২৫(২), ৩২(২), ৬২, ৬৬ ধারাসমূহে সকল পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসরত অবাঙ্গালীদের উপজাতীয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পার্বত্য চুক্তি এবং জেলা পরিষদ আইন প্রণয়নের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠিগুলোর পক্ষ থেকেও নিজেদের উপজাতি বলেই দাবি করা হয়েছিল।

গণমাধ্যমে সংবিধান পরিপন্থী ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করতে সর্বশেষ প্রজ্ঞাপনটি জারি করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। ২০২২ সালের ১৯ জুলাই উপসচিব শেখ শামছুর রহমান স্বাক্ষরিত এই প্রজ্ঞাপনটি জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনটির স্মারক নম্বর: ১৫.০০.০০০০.০২৪.১৮.১৮৩.১৪.৫৯৬।

প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ছোট ছোট সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আগামী ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত টকশোতে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ, ৩৫টি টেলিভিশন ও বেতারকেন্দ্র, সংবাদপত্রের সম্পাদকসহ সুশীল সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করার বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

এর আগে ২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য অধিদফতর থেকেও একই ধরনের একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে গণমাধ্যমে সংবিধান পরিপন্থী ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহার বন্ধ করতে বলা হয়েছিল। সিনিয়র উপপ্রধান তথ্য অফিসার (প্রেস) মুহ. সাইফুল্লাহ স্বাক্ষরিত ১৫.৫২.০০০০.০০৪.১৮.০১২.১৪.৪০৫৩ স্মারক নম্বর সম্বলিত প্রজ্ঞাপনটিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ক্ষুদ্র সম্প্রদায়/গোষ্ঠীকে উপজাতি/ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা/নৃ-গোষ্ঠী বলে অভিহিত করা হয়েছে। দেশে বসবাসরত বিভিন্ন উপজাতীয় সম্প্রদায়কে কোনো অবস্থাতেই ‘উপজাতি’ এর পরিবর্তে ‘আদিবাসী’ হিসেবে উল্লেখ না করার বিষয়ে সংবিধানে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। ফলে গণমাধ্যমে সংবিধান পরিপন্থী ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার বন্ধে আপনার নিজস্ব অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালনের জন্য পরামর্শ দেয়া হলো।

‘আদিবাসী’ নিয়ে সরকারের সকল মন্ত্রণালয়/বিভাগের একই অবস্থান

আদিবাসী বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান প্রথম ব্যক্ত করা হয় বিগত ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে। ২০০৫ সালের ২৫ জুলাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতিসংঘ অনুবিভাগ থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকারিভাবে জানানো হয় যে, বাংলাদেশে কোনো ‘আদিবাসী’ নেই এবং একই সাথে বাংলাদেশে বসবাসকারী উপজাতি জনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ না বলতে নির্দেশ দেয়া হয়। মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব (জাতিসংঘ) সামিয়া আঞ্জুম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনটির স্মারক নম্বর: ইউএন-এইচআর-৫০১৫।

‘উপজাতি ও আদিবাসী বিতর্ক প্রসংগ’ বিষয়ে প্রজ্ঞাপনটিতে বলা হয়, উপর্যুক্ত বিষয়ে আদিষ্ট হয়ে জানানো যাচ্ছে যে, জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট ফোরামসমূহে আদিবাসী (Indigenous) ও উপাজাতি (Tribal) জনগোষ্ঠীর সংজ্ঞা নিয়ে একটি বিতর্ক আছে।

Indigenous people হলো তারাই, যারা যুগ যুগ থেকে তাদের বর্তমান আবাসভূমিতে বাস করে আসছে, যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ‘Red Indians’ এবং অস্ট্রেলিয়ার ‘Aborigins’। এ বিবেচনায় জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের উপজাতি গোষ্ঠীকে Indigenous বা আদিবাসী হিসেবে আখ্যায়িত না করে Tribal বা Ethnic minority group হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে। জাতিসংঘ ফোরামে ভারত, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোও তাদের উপজাতি (Tribal) জনগোষ্ঠিদের কখনো Indigenous হিসেবে আখ্যায়িত করে না। তবে লক্ষণীয় যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আদিবাসী (Indigenous) ও উপজাতি (Tribal) শব্দ দুটি আমাদের দেশে সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা জাতিসংঘে ‘Indigenous’ সম্পর্কিত বাংলাদেশের উক্ত অবস্থানের পরিপন্থী।

উপর্যুক্ত বিবেচনায় জাতিসংঘে আদিবাসী (Indigenous) ও উপজাতি (Tribal)-এর সংজ্ঞা নিয়ে বিদ্যমান বিতর্ক এবং জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট অধিবেশনে বাংলাদেশের উপরোক্ত অবস্থানের প্রেক্ষিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়/বিভাগের একই অবস্থান গ্রহণ করা বাঞ্চনীয় বলে অত্র মন্ত্রণালয় মনে করে।

ওয়ান-ইলেভেনের পর গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে আদিবাসী ইস্যু (Indigenous Issue) বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান সুস্পষ্ট করা হয়। মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব কাজী আবুল কালাম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনটির স্মারক নম্বর: পাচবিম (সম-১)-৩৭/৯৭-১১৭, তারিখ: ৯/৯/২০০৮ খ্রি.। এতে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় দেশের পার্বত্য এলাকা তথা রাঙামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ির সাথে সম্পৃক্ত। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসরত সকল জনগোষ্ঠী দু’টি প্রধান ভাগে বিভক্ত যথা- (ক) উপজাতি ও (খ) অ-উপজাতি (বাংগালী)।

প্রজ্ঞাপনে আরো উল্লেখ করা হয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির সহিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির চুক্তির ক খণ্ডের ১, খ খণ্ডের ৮, ১১, ১৪(খ), ৩৪(গ), গ খণ্ডের ৩, ৭, ৮(ক), ৯(ঙ), ১৩ ও ঘ খণ্ডের ১, ২, ৩, ৭, ১০, ১১, ১৯ ধারাসমূহে, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন, ১৯৯৮ এর ২(গ), ৫(১)(খ), ৫(২), ৫(৩), ৫(৫), ৭(১), ৭(২), ৮(১), ৮(৩), ২৮, ২৯(১) ধারাসমূহে, খাগাড়ছড়ি পার্বত্য জেলা (স্থানীয় সরকার) পরিষদ আইন, ১৯৮৯ এর ২(খ), ৪(১)(খ, ঘ), ৪(৩), ৪(৪), ৫(১), ৫(২), ৬(১), ৬(৩), ১৪, ১৯, ২৫(২), ৩২(২), ৬২, ৬৬ ধারাসমূহে সকল পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসরত অবাঙ্গালীদের উপজাতীয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

‘এমতাবস্থায় স্মারক নং ইউ-এন-জিএ-৪২২২/০৮, তারিখ: ১৯/৮/২০০৮ খ্রি. সূত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের পত্রে বাংলাদেশের যে অবস্থান তথ্য The country has some tribal populations and there are no indigenous peoples. মর্মে উল্লেখ করা আছে, তার সাথে এ (পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক) মন্ত্রণালয় একমত পোষণ করে। উল্লেখ্য যে, এসময় প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পত্র নং- ২২.০৯.১.০.০.২৪.২০০৯ (অংশ-৮)-৭৯৯, তাং-২৮/০১/২০১০ এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ জানুয়ারি ২০১০ তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব (সমন্বয়-২) মো. মজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত ‘উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলোকে আদিবাসী হিসেবে অভিহিত করার অপতৎপরতা প্রসঙ্গে’ শিরোনামের গোপনীয় প্রতিবেদনে (স্মারক: পাচবিম (সম-২)২৯/২০১০/২৫, তারিখ: ২৮/১/২০১০) বলা হয়েছে: বাংলাদেশে ৪৫টি উপজাতীয় জনগোষ্ঠী বসবাস করে। বাংলাদেশের সংবিধান, পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ আইন, পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ আইন এবং ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তিতে উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলোকে ‘উপজাতি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। তাদেরকে কোথাও ‘আদিবাসী’ হিসাবে অভিহিত করা হয়নি। তথাপি কতিপয় নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী, পাহাড়ে বসবাসরত শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ, এমনকি সাংবাদিকেরাও ইদানীং উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলোকে ‘উপজাতি’ না বলে ‘আদিবাসী’ হিসাবে অভিহিত করতে দেখা যাচ্ছে। এতদ বিষয়ে বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠান, বিদেশি সংবাদ মাধ্যম, জাতিসংঘের আড়ালে থাকা খ্রিস্টান রাষ্ট্রসমূহ এসকল ব্যক্তিবর্গের সাহায্যে তাদের একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সহায়তায় অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে বসবাসকারী অধিকাংশ উপজাতীয় সম্প্রদায় এখন নিজ নিজ ধর্ম সংস্কৃতিতে অবস্থান না করে তাদের অনেকেই খ্রিস্টান হয়ে গেছে। বাংলাদেশীয় উপজাতীয়দেরকে ‘আদিবাসী’ উল্লেখ না করার বিষয়ে ইতোপূর্বে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হতে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিল। তবে বর্তমানে সে নির্দেশনার কোনো কার্যকারিতা লক্ষ করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি উপজাতীয়দেরকে ‘আদিবাসী’ হিসাবে চিহ্নিতকরণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন করে আদিবাসী মন্ত্রণালয় করার ব্যাপারে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উত্থাপিত হচ্ছে বলে জানা যায়। ইউএনডিপি, ডানিডা, এডিবিসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ এবং উপজাতীয়দের ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এইসাথে উপজাতীয়দের ‘আদিবাসী’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তাছাড়া আমাদের দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও ওয়ার্কশপে এবং সাংবাদিকেরা বিভিন্ন লেখায় উপজাতীয়দের ‘আদিবাসী’ হিসাবে চিহ্নিত করছে। এরূপ কাজ অব্যাহত রাখলে উপজাতীয়দের ভবিষ্যতে ‘আদিবাসী’ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া আবশ্যক হয়ে পড়বে। বর্ণিত অবস্থায় বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন উপজাতীয় সম্প্রদায়কে কোনো অবস্থাতেই যেন ‘উপজাতি’ এর পরিবর্তে ‘আদিবাসী’ হিসাবে উল্লেখ না করা হয় এবং পার্বত্য অঞ্চলে যে সমস্ত এনজিও প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের কার্যক্রমের উপর নজরদারী বৃদ্ধিকরণসহ সতর্কতামূলক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।

পাঠ্যপুস্তক ও আইনসহ সরকারি সকল কাগজপত্র থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দটি বিলোপের সিদ্ধান্ত
পাঠ্যপুস্তক ও আইনসহ সরকারি সকল ধরনের কাগজপত্র থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দটি বিলোপের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ‘আদিবাসী’ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘ক্ষুদ্র ও নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ সংক্রান্ত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ২০১১ সালের ২১ জুলাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে পররাষ্ট্র সচিবের সভাপতিত্বে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের সকল আইন, নীতি, দলিল, প্রকাশনা, বিবৃতি এবং সরকারি ও বেসরকারি সকল পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক ও পাঠক্রম থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দটিকে বিলোপ করে বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর আলোকে ‘ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী (Ethnic Minorities)’ শব্দটি দিয়ে প্রতিস্থাপন করার প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রয়োজনীয় Act/SRO সার্কুলেশনের মাধ্যমে সরকারের সকল মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, অধঃস্তন অফিস ও সংস্থাসমূহকে এই বিষয়ে নির্দেশ প্রদান করা হবে। মন্ত্রিসভার অনুমোদন সাপেক্ষে সরকারের সকল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং তাদের আওতাধীন সংস্থাসমূহের সকল ধরনের কাগজপত্র থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দটি বিলোপ করে তা ‘ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী (Ethnic Minorities)’ শব্দটি দিয়ে প্রতিস্থাপন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করারও সিদ্ধান্ত হয়।

২৪ জুলাই ২০১১ পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের জাতিসংঘ অণুবিভাগের মহাপরিচালক সাইদা মুনা তাসনীম স্বাক্ষরিত সভার কার্যবিরণী (নং-ইউ এন-এইচ-আর-৫০১৫/১০) সূত্রে আরো জানা যায়, আলোচনার শুরুতে সভাপতি প্রারম্ভিক বক্তব্যে বলেন যে, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বা উপজাতি কর্তৃক নিজেদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে দাবি করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিতর্কের সৃষ্টি করছে, যাতে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। ‘আদিবাসী’ শব্দটির ভুল ব্যবহারের ফলে শব্দটির সমাজতাত্ত্বিক, রাজনৈতিক এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে আলোকপাত করেন।

পররাষ্ট্র সচিব উল্লেখ করেন, ওয়ারী বটেশ্বরে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ যে এ ভূখণ্ডের আদি অভিবাসী বা First Nation হিসেবে বিগত ৪০০০ (চার হাজার) বছর ধরে বসবাস করছে বলে প্রতীয়মান হয়। অপরপক্ষে ঐতিহাসিক সূত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের ভূখণ্ডে তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মাত্র ১৭২৭ সালে আগমন করে অভিবাসী হিসেবে বসবাস করছে বিধায় তারা আদিবাসী নন।

আইএলও কনভেনশন-এর ১৬৯ ধারা অনুযায়ী এবং ‘আদিবাসী’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ অনুসারে কোন ভূখণ্ডে বিদেশি Colonial Settler কর্তৃক উৎখাতকৃত First Nation মূল ভূখণ্ডের আদিবাসী হিসেবে পরিগণিত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা থাকলেও ব্রিটিশরা এ অঞ্চলে Settlement Colonization না করায় এ অঞ্চলের আদি বাসিন্দাদের কখনওই মূল ভূখণ্ড থেকে উৎখাত করেনি এবং তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির উপরও কোন প্রভাব বিস্তার করেনি। ফলে উপর্যুক্ত বিবেচনায় এবং আইএলও কনভেনশনের সংজ্ঞানুযায়ী, বাংলাদেশের ১৫ কোটি জনগোষ্ঠীর সকলেই এ ভূখণ্ডের আদিবাসী। এ জনগোষ্ঠীর হাজার বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও নিজস্ব ঐতিহ্য রয়েছে। অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সকল উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী আছে তারা ১৭শ খৃষ্টাব্দে সুলতানী ও মুঘল আমলে মায়ানমার, কম্বোডিয়া ইত্যাদি রাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আগমন করে বাংলাদেশে বসবাস করছে। তাই তারা কখনওই পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমির First Nation হিসেবে এ অঞ্চলের আদিবাসী তো নয়ই বরং ঐতিহাসিকভাবে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অভিবাসনকারী জনগোষ্ঠী। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৩৩৯ খৃষ্টাব্দে সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে তার রাজত্বের অধীনে এনে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খান মগ রাজাকে উৎখাত করে মুসলিম শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতিরা মুঘল আমলে (১৭২৭-১৭৩০ সালে) এ অঞ্চলে অভিবাসন করে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।

সভায় সেনাসদরের প্রতিনিধি পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সেখানে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর আগমনের ইতিহাস সংক্রান্ত বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য ও তত্ত্ব এবং বোমাং রাজা অং শু প্রু চৌধুরীর সাক্ষাৎকার প্রদর্শন করেন, যেখানে ৯৬ বছর বয়স্ক বোমাং রাজা স্বীকার করেছেন যে তারা আদিবাসী নন বরং তারা প্রায় তিনশ বছর ধরে (১৭২৭ খৃষ্টাব্দ থেকে) বাংলাদেশে বসবাস করছেন।

সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি উল্লেখ করেন যে, তারা তাদের কোন নথি বা সরকারি কাগজপত্রে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করবেন না এবং তারা এ সংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী শব্দটি ব্যবহার করবেন। এছাড়াও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং ভূমি মন্ত্রণালয় তাদের বক্তব্যে তাদের সকল আইন ও নীতিমালা থেকে আদিবাসী শব্দটি সংশোধন করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন।

সভায় আইএলও কনভেনশন ১০৭ ও ১৬৯-এ ব্যবহৃত ‘আদিবাসী’ ও ‘উপজাতি’ শব্দ দুটি ব্যবহারের বিষয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এবং সেইসঙ্গে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর প্রতিনিধিগণের উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব মনে করিয়ে দেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিচুক্তি যেটি পার্বত্য অঞ্চলের প্রতিনিধিদের সাথে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের মাঝে স্বাক্ষরিত হয়, সেখানেও আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার না করে উপজাতি বা Tribal শব্দটি ব্যবহার করা হয়।

সভার কার্যক্রমের শেষ পর্যায়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সভায় আগমন করেন। এসময় আন্তঃমন্ত্রণালয় প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে বক্তব্যে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ‘ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি দেশের সকল আইন/অ্যাক্ট-এ শব্দটি অন্তর্ভুক্তি/প্রতিস্থাপন ও সুষমীকরণের লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করার বিষয়টিও উল্লেখ করেন।

তিনি উল্লেখ করেন, জাতিসংঘের আদিবাসী ফোরামে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধিগণ নিজেদেরকে আদিবাসী হিসেবে পরিচয় দিয়ে এবং আদিবাসীদের সাথে স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তি সরকার বাস্তবায়ন করছে না মর্মে অভিযোগ তুলেছেন এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক তারা লাঞ্ছিত হচ্ছে মর্মে অভিযোগ করে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে তাদের অংশগ্রহণ না করার পক্ষে মতামত তৈরি করার জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। ফলে বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের জন্য নেতিবাচক হয়ে উঠতে পারে। এসময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সভার কার্যবিবরণী সম্পর্কিত সুপারিশ/মতামত/অনাপত্তি দুই কার্যদিবসের মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের জন্য অনুরোধ জানান, যেন পরবর্তী মন্ত্রিসভার বৈঠকেই বিষয়টি উপস্থাপন করা যায়। তিনি এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সহযোগিতা কামনা করেন।

কার্যবিবরণী সূত্রে পাওয়া সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ হলো:
১. বাংলাদেশ সরকারের সকল আইন, নীতি, দলিল, প্রকাশনা, বিবৃতি এবং সরকারি ও বেসরকারি সকল পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক ও পাঠক্রম থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দটিকে বিলোপ করে বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর আলোকে ‘ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী (Ethnic Minorities)’ শব্দটি দিয়ে প্রতিস্থাপন করার প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রয়োজনীয়Act/SRO সার্কুলেশনের মাধ্যমে সরকারের সকল মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, অধঃস্তন অফিস ও সংস্থাসমূহকে এই বিষয়ে নির্দেশ প্রদান করা হবে। মন্ত্রিসভার অনুমোদন সাপেক্ষে সরকারের সকল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং তাদের আওতাধীন সংস্থাসমূহের সকল ধরনের কাগজপত্র থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দটি বিলোপ করে তা ‘ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী (Ethnic Minorities)’ শব্দটি দিয়ে প্রতিস্থাপন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

২. পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ যে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের আদিবাসী নয়, বরঞ্চ বাংলাদেশের ১৫ কোটি জনগণের সকলেই বাংলাদেশের আদি এবং প্রাচীন ভূখণ্ডে শাশ্বতকাল ধরে বসবাস করার সুবাদে বাংলাদেশে আদিবাসী। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসরত ‘ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ আদিবাসী হলে অবশিষ্ট জনগণ বিদেশি হিসেবে পরিগণিত হবে। এই বিষয়টি সম্পর্কে স্ব-স্ব মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী/সচিবগণ এবং জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক এবং স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিগণ তৃণমূল ও স্কুল-কলেজ পর্যায়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

৩. শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাথে পরামর্শক্রমে ‘আদিবাসী বিষয়ক’ এ ভ্রান্ত ধারণাটি বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি সকল পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক থেকে সংশোধনক্রমে সঠিক ইতিহাস ও তথ্য তুলে ধরবে, যাতে করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসরত বাংলাদেশের ‘ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী (Ethnic Minorities)’ সম্পর্কে সকল স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সঠিক তথ্য জানতে পারবে এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে সকল প্রধান শিক্ষক, প্রিন্সিপাল ও ভাইস চ্যান্সেলরদের নিকট পত্র প্রেরণ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

৪. তথ্য মন্ত্রণালয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে পরামর্শক্রমে ‘আদিবাসী বিষয়ক’ এ ভ্রান্ত ধারণাটি সংশোধন করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীরা’ যে আদিবাসী নয়, সে সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাথে আলোচনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় প্রচারের ব্যবস্থা নিবেন।

৫. সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে পরামর্শক্রমে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংস্থা, দেশি ও বিদেশি এনজিও, মানবাধিকার সংস্থা এবং সুশীল সমাজের সাথে আলোচনা করে ‘ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী (Ethnic Minorities)’ সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি এবং ‘আদিবাসী’ নামে যে সকল সংগঠন ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং যে সকল আইন, নীতিমালা বা প্রকাশনা রয়েছে তা সংশোধন করে ‘ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ হিসেবে নামকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

৬. ‘আদিবাসী’ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্রিফিং এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ করে জাতিসংঘের মাধ্যমে এবং দ্বি-পাক্ষিকভবে বিদেশি রাষ্ট্রসমূহকে অবহিতকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন যে, বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণই আদিবাসী, পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’রা আদিবাসী নয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র সচিব এ বিষয়ে বাংলাদেশে অবস্থিত সকল দূতাবাসসমূহকে, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনসমূহের মাধ্যমে বিদেশি রাষ্ট্রসমূহকে এবং জাতীয় পর্যায়ের সকল সরকারি ও বেসরকারি ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার প্রতিনিধিদের ব্রিফিং দেবেন এবং বহিঃপ্রচারের মাধ্যমে এ বিষয়ে ফিল্ম, পোস্টার, বই, লিফলেট ও অন্যান্য যাবতীয় প্রকাশনার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

৭. বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ এবং এনজিও বিষয়ক ব্যুরো-কে অনিচ্ছাকৃতভাবে নোটিশ প্রদান না করা হলেও তদারক কার্যপত্র প্রদান এবং তাদের থেকে সুপারিশ/মতামত/অনাপত্তি গ্রহণের পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

৮. পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ এবং এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর অধীনে ‘আদিবাসীদের উন্নয়নের’ নামে কোন বৈদেশিক সাহায্য প্রকল্প বা এনজিও প্রকল্প থাকলে সেটি গ্রহণ না করে ‘ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন প্রকল্প’ হিসেবে গ্রহণ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

৯. বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় আদিবাসী ইস্যুতে বিমান বন্দরসহ বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় যে সকল প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা করেছেন সে সকল স্থানে আদিবাসী শব্দটি সংশোধন করে ‘ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা করবে।

১০. ‘আদিবাসী’ বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে সরকারি নীতিমালা প্রণয়নের লক্ষ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উপর্যুক্ত সুপারিশ ও অন্যান্য সুপারিশ প্রাপ্তি সাপেক্ষে যতশীঘ্র সম্ভব মন্ত্রিসভার সদয় বিবেচনার জন্য অতি শীঘ্র সারসংক্ষেপ প্রেরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

আদিবাসী বিষয়ক কোনো অনুষ্ঠানের জন্য রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ব্যবহার করতে দেওয়া যাবে না
অসাংবিধানিক শব্দ ‘আদিবাসী’ দাবি আদায়ের কোনো কর্মসূচি বা অনুষ্ঠানের জন্য জাতীয় শহিদ মিনার, টিএসসি চত্বর, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ব্যবহারের অনুমোতি না দিতে নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। ২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব মো. মনিরুজ্জামান স্বাক্ষরিত ‘সংবিধান সম্মত শব্দ চয়ন ও তথাকথিত আদিবাসী দাবির কর্মসূচি পালনে স্থান নির্বাচন প্রসঙ্গে’ প্রজ্ঞাপনটির স্মারক নম্বর: ২৫.০১৫.০০১.০২.০০.০১০.২০০৫.১৩১৩।

প্রজ্ঞাপনটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ছোট ছোট সম্প্রদায়/গোষ্ঠীকে উপজাতি/ক্ষুদ্র জাতিসত্তা/নৃ-গোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। একটি স্বার্থান্বেষী মহল দেশি-বিদেশিদের সহায়তায় বাংলাদেশে আদিবাসী নামক অসাংবিধানিক দাবিটি প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। এই অপকৌশল ও ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক শহরকেন্দ্রিক বিশেষ করে ঢাকা মহানগরের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা/অবকাঠামো যেমন: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, জাতীয় শহিদ মিনার, শিল্পকলা একাডেমী, জাতীয় জাদুঘর, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বর, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটসহ আরো অনেক জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কর্মসূচি পালনের জন্য ব্যবহারের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সকল অনুষ্ঠানে জাতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাগণকে সুকৌশলে সম্পৃক্ত করার প্রবণতাও লক্ষ্যণীয়। পত্রে বাংলাদেশে আদিবাসী নামক অসাংবিধানিক দাবি বাস্তবায়নের অপকৌশল রোধকল্পে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, জাতীয় ঐতিহাসিক স্থান ব্যবহারের অনুমতি প্রদানের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে।

নাগরিক সনদে উপজাতিদের আদিবাসী আখ্যা না দেয়ার নির্দেশ

পার্বত্য চট্টগ্রামের নাগরিক সনদে ও দাপ্তরিক কাজে উপজাতীয় বাসিন্দাদের আদিবাসী আখ্যা না দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এর পরিবর্তে সংবিধানে উল্লেখিত ‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা’, ‘নৃগোষ্ঠী’ ও ‘সম্প্রদায়’ হিসেবে উল্লেখ করতে বলা হয়েছে।
২৩ অক্টোবর ২০১৭ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক সার্কুলারে এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, তিন পার্বত্য জেলা প্রশাসক, তিন পার্বত্য সার্কেল চিফকে এই নির্দেশ কার্যকর করার জন্য অবগত করা হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়-২ অধিশাখার উপ-সচিব(সমন্বয়-২) এ এস এম শাহেন রেজা স্বাক্ষরিত স্মারক নং ২৯.০০.০০০০.২২৪.২৭.১৬.২০১৬-৭৪৬, তারিখ: ২৩ অক্টোবর-২০১৭ মূলে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির মং সার্কেল চিফ তার ব্যবহৃত স্থায়ী নাগরিক সনদে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় বাসিন্দাদের ‘আদিবাসী’ বলে উল্লেখ করা শুরু করেছিলেন। এ নিয়ে পার্বত্যনিউজে একটি রিপোর্ট হলে বিষয়টি সর্বত্র আলোচিত হয়। এক পর্যায়ে বিষয়টি চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার সূত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় অবগত হয়।

মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি তথা শান্তিচুক্তির ‘খ’ খণ্ডের ১ নং ধারায় পরিষদের আইনে ‘উপজাতি’ শব্দটি বলবৎ থাকবে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের সংবিধানের ২৩ ক অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা করিবেন’। পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী বিভিন্ন উপজাতীয় সম্প্রদায়কে সংবিধানে উল্লেখিত ‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’, ‘নৃ-গোষ্ঠী’ ও সম্প্রদায়-এর বাইরে নাগরিক সনদ প্রদানে বা দাপ্তরিক কাজে ‘আদিবাসী’ নামে অভিহিত করার অবকাশ নাই মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তা কার্যকর করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

খাগড়াছড়ির মং সার্কেল চিফ এবং বান্দরবানের বোমাং সার্কেল চিফ মন্ত্রণালয়ের এ নির্দেশ মেনে নিলেও রাঙামাটির চাকমা সার্কেল চিফ তা অমান্য করছেন বলে জানতে পেরে ২০২০ সালের ১১ অক্টোবর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এক পত্রের মাধ্যমে চাকমা সার্কেল চিফকে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় নাগরিকদের ক্ষেত্রে আদিবাসী শব্দের ব্যবহার না করার নির্দেশ প্রদান করে। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শাহানারা ইয়াসমিন লিলি স্বাক্ষরিত ২৯.০০.০০০০.২২৪.২৭.১৮.২০১৮.২১৬ নং স্মারকের পত্রটিতে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি তথা পার্বত্য শান্তি চুক্তির ক খণ্ডের ১ নং ধারায় পরিষদ আইনে ‘উপজাতি’ শব্দটি বলবৎ থাকবে মর্মে উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৩ ক অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে, ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ সূত্রের স্মারকে সংশ্লিষ্ট সকলকে সংবিধানে উল্লেখিত শব্দাবলী ব্যবহারের নির্দেশ প্রদান করা হয়।

ইতিপূর্বে মন্ত্রণালয়ের জারি করা নির্দেশনা না মানার বিষয়টি উল্লেখ করে চাকমা সার্কেল চিফকে, নাগরিক সনদ প্রদানে বা দাপ্তরিক কাজে ‘আদিবাসী’ শব্দের পরিবর্তে সংবিধানের উল্লেখিত শব্দাবলী ব্যবহার করতে নির্দেশ দেয়া হয়।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন