আলীকদমের পাহাড়ি এলাকায় চলছে ধান কাটার মহোৎসব

fec-image

বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি জনপদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর গ্রামে গ্রামে জুম থেকে ফসল তুলতে চাষিরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ে পাহাড়ে চলছে জুমের সোনালি ধান কাটার মহোৎসব। কাজের ফাঁকে বিশ্রামের জন্য পাহাড়ে তৈরি করা হয়েছে অস্থায়ী জুম ঘর। বছরের এই সময়ে পাহাড়ে জুমের সোনালি ধান জুম চাষিদের এনে দিয়েছে ব্যস্ততা। তবে এ বছর অতি বৃষ্টি ও ভূমিধস হওয়ায় খাদ্য সংকটে পড়ার আশঙ্কা করছেন অনেক জুম চাষি।

বান্দরবানের আলীকদম উপজেলায় ৭টি সম্প্রদায়ের ভিন্ন ভিন্ন ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। তাদের সামাজিক ভাষা ও সংস্কৃতিগত রয়েছে ভিন্নতা। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রধান জীবিকা নির্বাহ উৎস জুম চাষ। এটি পাহাড়িদের আদি পেশা। জুমের পাকা ধানের চাল দিয়ে চলে সারা বছরের খাদ্য। উচুঁ পাহাড়ের ঢালু ভূমিতে ধানসহ হলুদ, মারফা, মরিচ, ভূট্টা ও তিলসহ প্রায় ৩০-৩৫ জাতের নানা সবজির চাষাবাদ করে থাকেন তারা।

এপ্রিলে মাস জুড়ে চলে জুমের জায়গা সম্পূর্ণ প্রস্তুুতকরণের কাজ আর কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা। বৃষ্টি হলে জুমে ধানসহ বিভিন্ন ফসল বপন শুরু করা হয়। যারা বৈশাখ মাসের প্রথম বৃষ্টির পর জুমে ধান বপন করতে পারেন তাদের ধান আগে পাকা শুরু করে। আর যারা একটু দেরিতে বপন করেন তাদের ধান দেরিতেই পাকে। প্রতিবছর আগস্ট মাসের শেষে অথবা সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে জুমের ধান কাটা শুরু হয়। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত জুমের ধান কাটা, মাড়াই করা ও শুকানোর কার্যক্রম চলে। ধান শুকানো শেষে জুমঘর থেকে মূল ঘরে ধান স্থানান্তর করার পর ফেব্রুয়ারি-মার্চে চলে ঘরে ঘরে জুমের নবান্ন উৎসব।

কুরুকপাতা ইউনিয়নে জুম চাষিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আলীকদম উপজেলায় বসবাসকারী পাহাড়ি পরিবারগুলো সবাই কম-বশি জুম চাষ করেন। আলীকদম উপজেলায় মার্মা, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, খুমি, ত্রিপুরা, চাকসহ ৭টি সম্প্রদায়ের অধিকাংশই জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। জুমের উৎপাদিত ধান থেকে পুরো বছরের খাদ্যের যোগান মজুদ করেন তারা। তবে এ বছর ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ধসে অনেক জুমক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে।

জুম চাষিরা জানিয়েছেন, এবারে অতিভারী বৃষ্টির ফলে সৃষ্টি পাহাড়ি বন্যার পানিতে কিছু জুমের ধান পাহাড়ের পানির ঢলে ভেসে গেছে। অনেক স্থানে চাষ করা জুম পাহাড় ধসে পড়ে গেছে। এখনো জুমের ধান মাটিতে শুয়ে গেছে। সে সব ধান মাটি সাথে মিশে নষ্ট হয়ে গেছে।

আলীকদম উপজেলার কৃষি বিভাগ তথ্য মতে, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে উপজেলায় চলতি মৌসুমে ১ হাজার ২৭৫ হেক্টর জমিতে জুমে জুম ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৩.৪০ হেক্টর জুম ধান রোপণ হয়েছে। সাম্প্রতিক বন্যার ও অতি বৃষ্টিপাতের কারণে ভূমিধস হওয়ার ফলে গত বছরে তুলনায় এ বছরও ১ মেট্রিক টন ধান ফলন কম হয়েছে। তাছাড়া ভারী বৃষ্টির পাতের কারণে কিছু কিছু স্থানে জুমের পাহাড় ধসে গেছে ফলে ফলন কম হয়েছে।

কুরকপাতা এলাকায় মেনদন ম্রো পাড়ার বাসিন্দা পেনপোং ম্রো তার সপরিবার ও প্রতিবেশীদের নিয়ে জুমের পাকা ধান কাটছেন। তিনি বলেন, পরিবারের বাইরের সদস্যরা আমার শ্রমিক নয়, তারা সবাই প্রতিবেশী আগাম শ্রম দিতে এসেছেন। তার জুম কাটা শেষ হলে অন্যদের জুমেও সেভাবে তাদেরকে সহযোগিতা করতে হবে। সেটা ম্রো ভাষায় তৈপো ক্রোতমে, চাকমারা বলে মালেয়া অর্থাৎ এটা শ্রমের বিনিময়ে শ্রম, একে অপরকে দলবেঁধে সহযোগিতা করা।

জুমের ধান কাটতে কাটতে তিনি আরো বলেন, এবছর প্রায় ৪ শতক ধানের জুম করতে পেরেছেন। তবে এবছর জুমের ধান তেমন ভালো ফলন হয়নি। যখন বৃষ্টির দরকার ছিল তখন বৃষ্টি হয়নি, আর যখন রোদ দরকার তখন বৃষ্টি হয়েছে। সময় মতো রোদ-বৃষ্টি হলে জুমের ধান ভালো হতো। এখন সময় মতো কিছুই হয়না, প্রকৃতিও উল্টো হয়ে গেছে। সেজন্য জুম থেকে ধান যা পাবেন, তা দিয়ে কোনমতে বছর যাবে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো সোহেল রানা বলেন, এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে জুমিয়ারা যেসব জুমে বীজ বপন করতে পেরেছে, সেসব ধান ভালো হয়েছে। এপ্রিল শেষের দিকে যারা বীজ বপন করেছে, সে সব জুমের ধান কিছু বিলম্ব হতে পারে।

তিনি আরো বলেন, প্রতিটি পাহাড়ের এখন জুমের ধান কাটার উৎসব শুরু হয়েছে। ৮০ শতাংশ স্থানীয় জাতের আবাদ করা ধানগুলো অনেক স্থানে কাঁটা শুরু হয়েছে । তাছাড়া ফলন তেমন খারাপ হয় নি। তাই জুমের ফলন মোটামুটি ঠিক রয়েছে। তবে অতিবৃষ্টির ফলে আলীকদমের কিছু স্থানে জুমের ধস নেমেছে বলে জানা গেছে বলে জানান।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন