আশীর্বাদের সেই মাতামুহুরী  এখন যেন অভিশাপ: খনন জরুরী

2015-11-06-15-08

চকরিয়া প্রতিনিধি:

ভরাট হয়ে যাচ্ছে মাতামুহুরী। গেল বর্ষায় পাহাড়ি ঢলে আসা পলিতে চর জাগছে বিভিন্ন স্থানে। নদী খনন ও তীর রক্ষায় পানিসম্পদ মন্ত্রীর আশ্বাস বাস্তবায়ন হয়নি দ্ইু বছরেও। বর্ষায় মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে চকরিয়ায় তেমন বন্যা হয়নি। তবে ঢলের সঙ্গে ব্যাপকভাবে পলি এসে নদী ভরাট হয়ে যায়। এছাড়া ২০১৪ সালে একাধিক ভয়াবহ বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় নদীর দুই তীরে। ওই সময় পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন।

পরিদর্শন শেষে এক জনসভায় তিনি খনন করে নদীর গতিপথ ফিরিয়ে দেওয়াসহ দুই তীর টেকসইভাবে সংরক্ষণের আশ্বাস দেন। কিন্তু সেই আশ্বাসের দুই বছর পেরিয়ে গেলেও তা বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ নেই। এতে হতাশ চকরিয়া ও পেকুয়ার সাত লাখ মানুষ। দুই উপজেলার মানুষের দাবি, মাতামুহুরী নদী এলাকার জন্য আশীর্বাদ। কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট অপকর্মে এই নদী তার সেই যৌবন রূপ হারিয়ে কান্না করছে। তাই দ্রুত পাইলট প্রকল্প নিয়ে তলদেশ খনন (ড্রেজিং) করে মাতামুহুরীর গতিপথ ফিরিয়ে দিতে হবে। তা না হলে প্রতিবছর বর্ষায় উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নদীর দুকূল উপচে লোকালয়ে আঘাত হানবে। এতে তীরের বাসিন্দারা বাপ-দাদার ভিটে-বাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হবে। গত দুই যুগে তীরের অন্তত ১০ হাজার পরিবার ভিটে ছাড়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের জাতীয় পার্টির (এরশাদ) সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ইলিয়াছ বলেন, ‘একযুগ আগেও মাতামুহুরী চকরিয়া-পেকুয়াবাসীর জন্য আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করেছে। এই নদীর মিঠাপানি ব্যবহার করে প্রতিবছর কৃষক চাষাবাদ করে আসছে। কিন্তু ব্যাপকভাবে পাহাড় ধস, বৃক্ষ নিধনসহ পরিবেশ বিধ্বংসী নানা কারণে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। নদীটি প্রতি বর্ষায় চকরিয়ার জন্য অভিশাপে পরিণত হয়েছে।’ তিনি জানান, মন্ত্রীর আশ্বাসের প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড সমীক্ষা কার্যক্রম চালিয়েছে। চলতি শুষ্ক মৌসুমে নদী খননের কাজ দৃশ্যমান হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান বলেন, ‘কয়েকমাস আগে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা সমীক্ষা কার্যক্রম চালিয়েছেন। এর পর এটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে।’

তিনি জানান, দুই কোটি টাকা ব্যয়ে প্রথমদিকে দুই কিলোমিটার এলাকায় নদীর তলদেশ খনন করা হবে। ওই এলাকার খনন সফলভাবে সম্পন্ন হলে পরে একটি মেগাপ্রকল্প হাতে নেওয়া হবে। এতে প্রায় ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হবে। চলতি শুষ্ক মৌসুমে মাতামুহুরী নদীর তলদেশ খনন কাজে হাত দেওয়া হবে। এর সঙ্গে নদীর দুই তীর টেকসইভাবে সংরক্ষণ করা হবে।

চকরিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম বলেন, ‘নাব্যতা সংকটে নদীর দুই তীরে ভাঙন ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। গত দুই দশকে ভাঙনের কবলে অন্তত ১০ হাজার পরিবার ভিটে বাড়ি ও জায়গা-জমি হারিয়েছে। অনেকে পরিবার পরিজন নিয়ে পাহাড়ি অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে।

তাঁর মতে, ভাঙনের ভয়াবহতা ঠেকাতে হলে নদীর চিরিঙ্গা মাতামুহুরী সেতু থেকে শুরু করে উজানে মানিকপুর ও নিচে পালাকাটা রাবার ড্যাম পর্যন্ত এলাকায় খনন করতে হবে।

চকরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. আতিক উল্লাহ বলেন, ‘প্রতিবছর মাতামুহুরী নদীর মিঠাপানি আটকিয়ে চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলা এবং বান্দরবানের লামা ও আলীকদম উপজেলার কয়েক লাখ কৃষক সেচ সুবিধা নিয়ে ইরি-বোরো ও রবি শস্যের চাষাবাদ করে আসছে। এর মধ্যে নদীর সেচ সুবিধা নিয়ে চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় প্রতিবছর অন্তত ৭০ হাজার একর জমিতে আমন, বোরো ও রবি শস্যের চাষাবাদ করেন কৃষক। তিনি জানান, নদীতে একাধিক স্থানে ডুবোচর জেগে ওঠায় কিছু কিছু এলাকায় সেচ সুবিধা নিতে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।

চকরিয়া পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি এম আর মাহমুদ বলেন, ‘দুই উপজেলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে মাতামুহুরী। প্রতিবছর কৃষক নদীর সেচ সুবিধা নিয়ে চাষাবাদ করে  শত কোটি টাকার ফসল উৎপাদন করছে।’

চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী বলেন, ‘একসময় মাতামুহুরী আশীর্বাদ হলেও বর্তমানে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ প্রতিবছর বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢলের ধাক্কায় নদীর দুই তীরে ভয়াবহ ভাঙনের সৃষ্টি হয়। নদীর খনন এবং দুই তীর যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা না হলে অচিরেই পৌরশহর রক্ষাবাঁধসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।’

সুরাজপুর-মানিকপুর ইউপি চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম বলেন, ‘মাতামুহুরীর উৎপত্তিস্থল বিশেষ করে লামা-আলীকদমে কয়েক দশকে পাহাড়ে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ও পাথর আহরণের কারণে পলি জমে নদীটির সর্বনাশ হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে নদীতে অবশ্যই ড্রেজিং করা জরুরি হয়ে পড়েছে।’

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন