ইউপিডিএফের সহায়তায় উত্তর ফটিকছড়ির গ্রামে গ্রামে চলছে গণডাকাতি ॥ মানুষ অসহায়, পুলিশ নিষ্ক্রীয়

মেয়েদের ইজ্জত বাঁচাতে গ্রাম ছেড়েছে ভূজপুরের পাঁচটি পরিবার

Ramgarh 02

নিজাম উদ্দিন লাভলু, ভুজপুর থেকে ফিরে:
পাবর্ত্য এলাকার আঞ্চলিক উপজাতীয় সংগঠন ইউপিডিএফের সন্ত্রাসীদের সহায়তায় উত্তর ফটিকছড়ির বিভিন্ন গ্রামে দফায় দফায় চলছে ডাকাতির ঘটনা।

সর্বশেষ গত বুধবার রাত ৩ টার দিকে ভুজপুর থানাধীন পশ্চিম চানপুরে এক প্রবাসীর বাড়িতে সংঘটিত হয় দুর্ধর্ষ ডাকাতি। সশস্ত্র ডাকাতরা বাড়ির কর্তা বিদেশ ফেরৎ আবুল কালাম(৩৫)কে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে মারাত্মক আহত করেছে। ৭-৮ জনের মুখোশপড়া ডাকাত অস্ত্রেরমুখে ঘরের লোকদের জিম্মি করে লুট করে নিয়ে যায় ১৩ ভরি স্বর্ণালংকার, নগদ অর্থসহ লক্ষাধিক টাকার মালামাল। এভাবে একের পর এক ডাকাতির ঘটনায় ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে ভুজপুরের অসহায় পাঁচটি পরিবার।

ডাকাতের নির্যাতন ও তাদের হাত থেকে যুবতী মেয়ের ইজ্জত বাচাঁতে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে ঐ পরিবার গুলো। এছাড়া ডাকাত আতংকে বিনিদ্র রজনী কাটাচ্ছে উপজেলার ভূজপুর থানাধীন ঘরকাটা ও ধামারখীল এলাকার আরো অন্তত ৭০/৮০ পরিবারের নারী পুরুষ। ডাকাতরা ইতিমধ্যে লুট করে নিয়েছে প্রায় অর্ধকোটি টাকার সম্পদ।

ডাকাতদলের তান্ডবে গ্রামবাসিরা অসহায় জীবন যাপন করলেও পুলিশ রয়েছে সম্পূর্ন নিষ্ক্রীয়। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো: শহিদুল্লাহ বলেন, গণ ডাকাতির ব্যাপারে কেউ তাঁকে অবহিত করেনি। খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। হোক্কা ভাঙ্গা নামার মাথা নামক এলাকায় ডাকাতির সময় এক মহিলাকে ধর্ষন করলেও সামাজিক লোক লজ্জার ভয়ে তা প্রকাশ করেনি নির্যাতিতার পরিবার। এ ছাড়া পর পর দুবার একই বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও এনিয়ে থানা পুলিশের কাছ থেকে কোন ধরনের আইনি সহায়তা পায়নি নির্যাতিত আবদুচ ছালামের পরিবার।

গত রমজানের ঈদের পর থেকে সংঘবদ্ধ ডাকাতদলের অব্যাহত অত্যাচারে এসমস্ত পরিবারের সদস্যরা ঘরকাটা ও ধামারখীল এলাকা ছেড়ে দাঁতমারা ইউনিয়নের হাসনাবাদ ও নারায়নহাট ইউনিয়নের হরিনমারা ও শেতছড়া এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে ফেলে এসেছে তাদের বসতভিটা, ঘরবাড়ি, বিভিন্ন প্রকারের ক্ষেতখামারসহ কোটি টাকার সম্পদ। আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েও শান্তিতে নেই এসকল পরিবারের সদস্যরা। সংঘবদ্ধ ডাকাতরা তাদের এজেন্ট মারফত সেখানেও হুমকি ধমকি দিচ্ছে বলে জানায় ভূক্তভোগীরা। মোটা অংকের টাকা না দিলে বাড়ি ঘরে আর ফিরতে পারবেনা বলেও সাফ জানিয়ে দিচ্ছে দস্যুরা।

স্থানীয় একাধিক সুত্র জানায়, গত প্রায় তিনমাস ধরে ঘরকাটা,ধামারখীল,হোক্কা ভাঙ্গা,মরা কয়লা,নামার মাথা এলাকায় চলছে প্রতিনিয়ত ডাকাতির ঘটনা। বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রে সজ্জিত উপজাতি আর বাঙ্গালির সমন্বয়ে গঠিত ২৫/৩০ জনের সংঘবদ্ধ ডাকাতদল রাতে ঘরের দরজা ভেঙ্গে হানা দেয়। ঘরের লোকজনকে হাত পা বেঁধে রেখে লুটপাট শুরু করে। প্রতিবাদ করলে শুরু করে শারিরীক নির্যাতন। ঘরের কাপড় চোপড় থেকে শুরু করে নগদ টাকা, মোবাইল,স্বর্নালংকার যা পায় সবই লুটে নিয়ে যায় এসব সংঘবদ্ধ দস্যুর দল।

এ ব্যাপারে স্থানীয় বাসিন্দারা এলাকার জনপ্রতিনিধিসহ পুলিশের কর্তাব্যক্তিদের একাধিকবার অবহিত করেও কোন ধরনের আইনি সহায়তা পায়নি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। তবে ঘটনার পর দাঁতমারা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ উপ পুলিশ পরিদর্শক মীর কাসেম আলী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন বলে তিনি জানান।

ঘরকাটা এলাকার বাসিন্দা আবদুচ ছালাম জানান, গত ছয়মাস আগে তার ঘরে একদফা ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এর পর গেল রমজানের ঈদে এবং ঈদের পরে পর পর দু দফা ডাকাতি হয়। ২৫/৩০ জনের ডাকাতদল ঘরের দরজা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করে তার স্ত্রী ও ছেলেকে মারধর করে । এসময় নগদ দশ হাজার টাকাসহ প্রায় ৫০ হাজার টাকার মালামাল লুট করে। এ ছাড়া ডাকাতের প্রহারে তার স্ত্রী কুনসুমা (৪০) ছেলে মালেক(২০) মেয়ে সাহেদা(১৫) ও রফিক (৩৫) নামের অপর এক আত্মীয় আহত হয়।

প্রথম দফা ডাকাতির পর ডাকাতরা তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়ায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা ডাকাতির সময় তিনি ঘরে ছিলেননা বলে জানান। এরপরও ডাকাতরা তাদের নির্ধারিত এজেন্ট মারফত মোটা অংকের টাকা না দিলে ছালামকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। ডাকাতদের অব্যাহত নির্যাতন আর মেয়ের সম্ভ্রম বাঁচাতে তিনি বাধ্য হয়ে বড় বেতুয়া এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তিনি জানান পর পর তিন দফা ডাকাতির পর তিনি বিষয়টি নিয়ে ভূজপুর থানা পুলিশের কাছে আইনি সহায়তা চাইলেও কোন ধরনের সহায়তা পায়নি। পুলিশ ঘটনাস্থলে আজকে যাবে কালকে যাবে বলে সময় ক্ষেপন করতে থাকে।

চেলামারা এলাকার নাছির নামের অপর এক ভূক্তভোগী জানান, ডাকাতরা তার বাড়িতেও পর পর দুবার ডাকাতি করে। গত আগষ্ট মাসে পর পর দুবার হানা দিয়ে অস্ত্রের মুখে তাদেরকে জিম্মি করে নগদ টাকা,দুটি ছাগলসহ ৩০/৪০ হাজার টাকা মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এছাড়া মোটা অংকের টাকা না দিলে তার মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে বলেও হুমকি দেয়। বর্তমানে ডাকাতের হাত থেকে মেয়ের ইজ্জত বাঁচাতে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। আইনি সহায়তার আশায় পুলিশকে বিষয়টি জানিয়েও কোন লাভ হয়নি তার।

এছাড়া ঘরকাটা এলাকার চান্দু মিঞার বাড়ী,নুরুর বাড়ী,গত ২৩ আগষ্ট বাইল্যার বাড়ী,চাক্কা তলি এনামের বাড়িতেও ঘটে একই কায়দায় ডাকাতির ঘটনা। সংঘবদ্ধ ডাকাতের দলটি দিনের বেলায়ও এসব এলাকায় মহড়া দেয় বলে জানান স্থানীয়রা। তাছাড়া কে কোথায় যায় তাও কড়া নজরদারিতে রাখে তারা। স্থানীয় সোর্স মারফত এসব খবরাখবর সংগ্রহ করে ডাকাত দলটি। এছাড়া কাটাছড়া,ধামারখীল,হরিন মারা,দইল্যার খীল,শ্বেতছড়া,জিলতলী, হোক্কা ভাঙ্গা এলাকার লোকজনও রয়েছে ডাকাত আতংকে। এসব এলাকার কয়েকশত পরিবার এখন বিনিদ্র রজনী কাটাচ্ছে।

এলাকায় ঘন বসতি না হওয়ায় রাতের বেলায় ডাকাতির সময় বিষয়টি তেমন জানাজানি হয়না। এ ছাড়া প্রতিরোধ করারও কোন উপায় নেই স্থানীয় বাসিন্দাদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক ব্যবসায়ি জানান, ইউপিডিএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে এলাকার ডাকতরা গণ ডাকাতি চালাচ্ছে। অস্ত্রধারী ঐ সন্ত্রাসীরা রামগড়ের গরুকাটা, মরাকয়লা,গৈয়াপাড়া,গুজা পাড়া, বালুখালি প্রভৃতি এলাকা থেকে এসে ডাকাতি করে আবার ফিরে যায়। আবার কখনও কখনও এখানকার বাঙ্গালি ডাকাতরাও প্রতিকুল পরিস্থিতি দেখলে পাবর্ত্য এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নেয়।

স্থানীয় ইউপি সদস্য আলী আহম্মদ মাষ্টার জানান, এসব এলাকায় গত প্রায় তিনমাস ধরে সিরিজ ডাকাতি চলছে। ডাকাতের নির্যাতনে বহু পরিবার এলাকা ছেড়ে হাসনাবাদ,বেতুয়া,নারায়নহাট এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। প্রশাসনকে একাধিকার অবহিত করা হলেও কোন প্রকার সহায়তা মিলেনি। ডাকাতির বিষয়ে তিনি অবগত আছেন। এ ব্যাপারে ইউনিয়ন কমিউনিটি পুলিশের সভায় এবং ভূজপুর থানার ওপেন হাউস ডে মিটিংয়ে পুলিশ কর্তাদের অবহিত করেছেন। ডাকাত অধ্যুষিত এলাকা গুলোতে তড়িত যৌথ অভিযান চালানোর দাবী জানান তিনি।

গ্রামে গ্রামে ডাকাতির ঘটনা সম্পর্কে বক্তব্য জানতে চাইলে ভুজপুর থানার অফিসার ইনচার্জ জাহিদুল কবির বলেন, ডাকাতির ঘটনায় এ পর্যন্ত থানায় কেউ কোন মামলা বা অভিযোগ করেনি। কখনও কখনও লোকমুখে শুনলেও ঐ এলাকাগুলো অত্যন্ত দুর্গম হওয়ায় পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে কোন এ্যাকশন নিতে পারে না।

পার্বত্য এলাকার উপজাতি সন্ত্রাসীদের সমন্বয়ে স্থানীয় দুর্বৃত্তরা চুরি ডাকাতি সংঘটনের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, এসব দুর্বৃত্তদের নির্মূল করতে হলে ভুজপুর,জোরারগঞ্জ,মীরেরশ্বরাই, সীতাকুন্ড ও রামগড় থানার সমন্বয়ে যৌথ অভিযান চালাতে হবে। দুর্বৃত্তদের  বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ঈদের পর গ্রামবাসিদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভার আয়োজন করবেন বলে তিনি জানান।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন