সাংবাদিকদের পুঁতে ফেলার প্রকাশ্যে হুমকি!

ঈদগাঁওতে শত একর উপকূল রক্ষা বন নিধন করে অবৈধ চিংড়ি ঘের তৈরির মহোৎসব

fec-image

কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার উপকূলীয় এলাকা পোকখালী ইউনিয়নের পশ্চিম গোমাতলী হান্নান মিয়ার ঘোনা সংলগ্ন উপকূলীয় বন বিভাগের আওতাধীন প্রায় ২শ একর উপকূল রক্ষা বন “ম্যানগ্রোভ” নিধন করে উক্ত বন এলাকা দখল পূর্বক অবৈধ চিংড়ি ঘের তৈরির মহোৎসব চলছে মাসাধিককাল ধরে। এই প্যারাবন ধ্বংস ও বাঁধ দিয়ে চিংড়ি ঘের তৈরির কাজ দিনরাত প্রকাশ্যে অব্যাহত থাকলেও নাকের ডগায় থাকা উপকূলীয় বন বিভাগের রহস্যজনক ভূমিকা জনমনে ব্যাপক প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে ।

হুমকি ধমকি ও মামলা হামলার ভয়ে স্থানীয়রা বিভিন্ন দপ্তরে মৌখিক জানালেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনো পর্যন্ত কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগকারীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, অস্ত্রের মহড়ায় প্রকাশ্যে মাসব্যাপী সরকারি সম্পদ ধ্বংসলীলায় দখলবাজচক্র মেতে থাকলেও কেউ তাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস করে না। কাউকে কিছু জানালে এলাকা ছাড়া করা কিংবা মামলা হামলার ভয়ভীতিও প্রদর্শন করে বলে জানান তারা। এমন কি কতিপয় সাংবাদিককে প্রকাশ্যে মাটিতে পুঁতে ফেলার প্রকাশ্যে হুমকি দেন বলেও অভিযোগ উঠে।

প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের মহেশখালী গোরাকঘাটা রেঞ্জের অধীন চৌফলদন্ডী বিট অফিসের আওতাধীন পোকখালী ৬নং সুইস গেইটস্থ হান্নান মিয়ার ঘোনা নামক ঘেরের পশ্চিমে প্রায় ২শ একর জায়গার উপর থাকা ম্যানগ্রোভ বন এলাকা দখল করে বাঁধ দিয়ে চতুর্দিকে ঘেরাও করে রেখেছে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। এ দখলযজ্ঞে কেটে ফেলা হচ্ছে হাজারো বাইন, কেওড়াসহ হরেক প্রজাতির ববায়নের গাছ। পরিবেশ প্রতিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি আবাসস্থল হারাচ্ছে ম্যানগ্রোভ অরণ্যে আশ্রয় নেয়া নানান প্রজাতির প্রাণী।

সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শনে দেখা যায়, হান্নান মিয়ার ঘোনার পশ্চিমে উপকূলীয় দুর্গম নদী পথ পাড়ি দিয়ে মহেশখালী চ্যানেলের একটু পূর্বে শত শত শ্রমিক দিয়ে উপকূলীয় বন উজাড় করে মাটি কেটে দখলকৃত জায়গার চারপাশে বাঁধ তৈরি করছে দখলবাজ চক্রটি। ওই এলাকায় দেশী বিদেশি অস্ত্র হাতে পাহারায় রয়েছে বিভিন্ন এলাকা থেকে ভাড়ায় আনা অর্ধ শতাধিক দাগি অপরাধীরা। গণমাধ্যম, বন বিভাগ, পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতাকর্মীসহ অন্যন্যা সংস্থার লোকজন ঘটনাস্থলে গেলে অস্ত্রধারীরা এগিয়ে এসে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে বলেও জানান কয়েকজন সাংবাদিক। ঘটনাস্থল সাগরের পাশাপাশি হওয়ায় দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে যাওয়া যেহেতু দুরূহ ও দুর্গম, তাই দুর্ঘটনা ও জীবনহানির আশঙ্কায় সহজে কেউ যেতে চাই না। সেটিকে পুঁজি করে হরহামেশাই স্কেভেটরসহ শতশত শ্রমিক দিয়ে দখল যজ্ঞ চালাচ্ছে রাতদিন সমানতালে ।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, গোমাতলী এবং চরপাড়ার প্রায় ২শ পরিবার থেকে ১ জন করে ২শ জনকে সদস্য করে গোষ্ঠী ভিত্তিক পৃথক একটি সমিতি গঠন করে। এসব সংগঠনের প্রতিটি সদস্য থেকে তোলা হয়েছে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা। এ টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে সরকারি কোটি টাকার উপকূলীয় জমি দখল ও বন এলাকা ধ্বংসে।

স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সংবাদ পেয়ে চৌফলদন্ডী বিট কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন যান। পরিদর্শন পরবর্তী দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও এখনো পর্যন্ত রহস্যময় কারণে কোন ব্যবস্থা নিতে চোখে পড়েনি। বরং দখলবাজরা আরো দাপটের সাথে দখল কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এলাকায় চাউর হয়েছে বিট কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের লাখো টাকায় ম্যানেজ করে এসব উপকূলীয় বনজসম্পদ দখল প্রতিযোগিতা চালাচ্ছে। বিষয়টি ব্যাপক জানাজানি এবং গণমাধ্যম কর্মীদের নজরে আসলে জনরোষে পড়ার শঙ্কায় বিট কর্মকর্তা ১ লাখ টাকা ফেরতও প্রদান করেন বলে জনমুখে প্রচার পাচ্ছে।

এদিকে কক্সবাজারের স্থানীয় পত্রিকা দৈনিক হিমছড়ির স্টাফ রিপোর্টার এইচএন আলমকে সামনে পেলে দখলবাজ চক্রের প্রধান হোতা জনৈক আশরাফ দখলকৃত এলাকায় কোন সাংবাদিক পেলে কাঁদা মাটিতে পুঁতে ফেলার প্রকাশ্যে হুমকি দেন বলে দাবি করে তিনি সাংবাদিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত বলে স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান।

ঘটনার বিষয়ে উপকূলীয় বন বিভাগের গোরকঘাটা রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আইয়ুব আলী জানান, সংবাদ পেয়ে স্থানীয় বিট কর্মকর্তাকে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছিল। সত্যতা পেয়ে দখলকৃত এলাকায় দেয়া কয়েকটি বাঁধ কেটে দেয়া হয়েছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে।

চৌফলদন্ডী বিট কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের সাথে কথা হলে অর্থ লেনদেনের বিষয়টি সত্য নয় দাবি করে বলেন, যে পরিমাণ জায়গা বলা হচ্ছে আসলে ততটুকু নয়। সংবাদ পাওয়া মাত্রই বোটযোগে ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখি সেখানে প্যারাবন নিধন করে ঘের তৈরির মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। তিনি আরও বলেন, স্থানীয় কিছু জেলে সাগরে মাছ শিকার করতে ১৬০ ফিট মতো চর দখল করেছিল, সেটি কেটে দেয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা দায়ের করা হবে বলে জানান। বিট কর্মকর্তার কথার সাথে ওই স্থানের অবস্থার কোন মিল পাওয়া যাইনি।পুরোপুরি বিপরীতমুখী বক্তব্যে প্রমাণ হয় তিনি রক্ষক হয়েও ভক্ষকের ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এমনকি তিনি দখলবাজদের বাঁচাতে নিরীহ জেলেদের উপর দোষ চাপাচ্ছেন।

স্থানীয়রা জানান, চৌফলদন্ডী বিট কর্মকর্তার সাইফুল ইসলামের রহস্যজনক ভূমিকার কারণে দখলবাজরা দিনদিন বেপরোয়া গতিতে অস্ত্রের মহড়ায় সরকারের কোটি টাকার উপকূলীয় বনভূমি দখলে নিচ্ছে। তারা উপকূলীয় বন সম্পদ দখলকারী এবং অসাধু বন কর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্মকতাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও স্থানীয় সংবাদকর্মীদের মাধ্যমে এ সংবাদ জানতে পেরে বৃহস্পতিবার সকালে ঈদগাঁও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুবল চাকমা সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন বলে জানা গেছে ।

এ বিষয়ে জানতে ইউএনও সুবল চাকমার মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সংযোগ না পাওয়ায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের কক্সবাজারের উপ পরিচালক নুরুল আমিন জানান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে বৃহস্পতিবার পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন, এখনো রিপোর্ট পেশ করেননি পরিদর্শন টিম। রিপোর্ট পেলে বিস্তারিত জানবো এবং পরিবেশ ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান এ কর্মকর্তা।

এদিকে ঈদগাঁও উপজেলার সচেতন জনগণ ক্ষোভের সাথে জানান, সম্প্রতি ঈদগাঁও উপজেলা জুড়ে পাহাড়,বাজার ও নদী উপকূলীয় সরকারি সম্পদ নিজের দাবি করে চিহ্নিত দখলবাজচক্র প্রকাশ্যে দখল কার্যক্রম ও স্থাপনা নির্মাণ কাজ চালিয়ে গেলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে রহস্যময় কারণে কোন ব্যবস্থা নিতে চোখে পড়েনি। বিশেষ করে অতি সম্প্রতি ঈদগাঁও বাজারের শত বছরের মাছের শেডর জায়গা এতযুগ পর নিজের দাবি করে একটি পক্ষ দখল পূর্বক বহুতল ভবন নির্মাণ কাজ দিনরাত অব্যাহত রাখলেও এখনো পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ । যার কারণে উপজেলা জুড়ে মূল্যবান সরকারি সম্পদ দখলের মহড়া দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপকূলীয় বন উজাড় করে জায়গা দখল পূর্বক ঘের নির্মাণও এর ধারাবাহিকতা মাত্র । তাই উপজেলার সচেতন জনগণ এসব দখলদারদের হাত থেকে সরকারি সম্পদ ও পরিবেশ রক্ষায় জেলা প্রশাসনের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন