একজন দায়িত্বশীল শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের কৃতজ্ঞতা

fec-image

আন্তরিক অভিনন্দন শামীমা ম্যাডাম, সহকারী শিক্ষক, কাচালং মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এবারের ‘শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষিকা’, বাঘাইছড়ি উপজেলা। আপনার জীবনের উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তির দিনে বলছি আমার জীবনের সেরা প্রাপ্তির একটি আপনাকে শিক্ষক হিসেবে পাওয়া।

চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। পাবলাখালী আমতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সকালের কুয়াশা তখনো কাটেনি। প্রধান শিক্ষকের সরু কক্ষে অপরিচিতা একজন বসে আছেন। এর মাঝে রটে গেছে উনি আমাদের নতুন টিচার। স্যারের রুমের সামনে দিয়ে আসা-যাওয়ার ছলে আমরা উঁকিঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করছি। এইটুকু আমার স্পষ্ট মনে আছে।

তারপর ক্লাস নেওয়া শুরু করলেন। একজন শিক্ষকের আসলে নানাগুণে গুণান্বিত হতে হয়। পেশাগত আচরণের মধ্যেই পড়ে ভালো পড়ানো, দায়িত্বশীল আচরণ করা। আমাদের মতো পিছিয়ে পড়া গ্রামীণ পরিবেশে পরিশীলিত জীবনবোধের যেটুকু শিক্ষা তার বড় অংশই আসে শিক্ষকদের থেকে। শিক্ষকের এই দায়িত্বশীল আচরণের ব্যাপ্তি সীমাহীন। ম্যামকে স্মরণ করতে পারি আমাদের সস্নেহে যত্ন নিয়ে পড়ানোর জন্যে। একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদেরকে ক্লাস রুমের ভিতর-বাহিরে দায়িত্ব নিয়ে দেখভাল করার জন্যে। একাডেমি ক্লাসের বাহিরেও যখন যেভাবে সমস্যা হতো ম্যামের বাসায় গিয়ে পড়া বুঝে নিয়ে আসতাম।

আমার স্কুল-কলেজ দু’টোই এই আধুনিক শহরের স্কুল-কলেজের তুলনায় যোজন যোজন পিছিয়ে। সেখান থেকে একজন ছাত্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে আজকের যেটুকু অবস্থানেই আসা তার পিছনে বড় ভূমিকা আমাদের স্কুল-কলেজের শিক্ষকদেরই। আর আমার বেলায় উনাদের সে ভূমিকা অপরিসীম। ম্যামের মতো শিক্ষকের প্রভাব আমাদের জীবনে ভীষণরকম প্রভাব ফেলে। যা উৎসাহ-উদ্দীপনা ও সাহসের সাথে স্বপ্নের সঞ্চার ঘটায়।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যোগদানের পর ট্রেনিং-এ যেতে হয়। ম্যাম প্রশিক্ষণে চলে গেলেন হঠাৎ করে। আট-ন’মাসের ব্যবধানে সম্ভবত। তখনতো আর মোবাইল নেই। যোগাযোগ সহজ ছিল না। ম্যাম একটা চিঠি আর তার নিচের অংশে চব্বিশ (২৪) ঘন্টার রুটিন (সাপ্তাহিক) করে আমার মামার বন্ধুর মাধ্যমে পাঠিয়ে ট্রেনিং-এ চলে গেলেন। এই চিঠির প্রতিটা সম্বোধনে কোথাও আমি উনার দুষ্টু ছাত্র, আদরের ছোট ভাই কিংবা স্নেহের পুত্র। দীর্ঘদিন এই রুটিনটা আমার কাছে ছিল। এক সময় হারিয়ে ফেলি। এর বাহিরেও যে কাজটি করলেন, উনি চলে গেলে আমার পড়াশোনার কি হবে সেটা ভেবে ম্যাম পার্শ্ববর্তী আরেকটি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক নিজাম উদ্দিন স্যারকে বলে রেখে গেলেন যেনো আমাকে পড়ায়। পরবর্তীতে নিজাম স্যার আর উনার বোনও আমাকে পড়িয়েছেন।

একজন শিক্ষক-অভিভাবক ম্যামের সাথে একজন ছাত্র-সন্তান আমার নিয়মিত যোগাযোগ হয়। ম্যামকে সবসময় এপ্রিশিয়েট করি উনার দায়িত্বশীল আচরণের জন্য। একইসাথে আক্ষেপ প্রকাশ করি যারা এই মহান পেশায় গিয়ে স্বীয় দায়িত্ব পালনে চরম অপেশাদারিত্বের সাক্ষর রেখে যাচ্ছেন তাদের নিয়ে। আমাদের পিছিয়ে পড়া এলাকার ছেলেমেয়েদের এগিয়ে নিতে হলে একজন শামীমা ম্যামের মতো অসংখ্য পেশাদার ও মানবিক শিক্ষক প্রয়োজন।

আমাদের দিয়েই ম্যামের আনুষ্ঠানিক শিক্ষকতা শুরু হয়। ম্যাম আজকের স্বীকৃতি আপনার দায়িত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে নিশ্চয়ই। আপনার আরও বহু গুণগ্রাহী শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গিয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধারা অব্যাহত থাকুক সে প্রার্থনা রাখছি। আমাদের জন্যেও দোয়া করবেন।

এই লিখা আমার পরিচিত-অপরিচিত অনেক শিক্ষক পড়বেন। আমার অনুরোধ আপনাদের দায়িত্ব পালনে এমন পেশাদারিত্বের ছাপ রাখুন যেনো আপনার শিক্ষার্থীরা আপনাকে নিয়ে গর্ব করে দু’কলম লিখতে পারে, দু’টা কথা বলতে পারে।

এখনও আমাদের গ্রামের স্কুলটি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জনাব হামিদুর রহমান (সুজন) এর নেতৃত্বে তিনজন সহকারি শিক্ষকে টানাপোড়েনে চলছে। এলামনি এসোসিয়েশনের মাধ্যমে করোনার আগে খণ্ডকালীন শিক্ষক দেওয়াসহ নানাভাবে সহায়তার চেষ্টা করেছি। পিছিয়ে পড়া এলাকা হিসেবে আমাদের দায়িত্ব অনেক বেশি এই এলাকার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করে এগিয়ে যাবার পরিবেশ সৃষ্টিতে। আর তার প্রেরণা হতে পারেন বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকগণ ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যগণ। আপনাদের দায়িত্বশীল আচরণ আমাদের প্রেরণা যোগায় আর বিপরীতে ঘটায় হৃদয়ের রক্তক্ষরণ।

উপজেলা প্রশাসন ও শিক্ষা অফিসার মহোদয়গণকে অনুরোধ করবো শিক্ষকদের মূল্যায়ন করার পাশাপাশি ‘হঠাৎ পরিদর্শন’-এ গিয়ে বিশেষত দূরবর্তী এলাকার বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের উপস্থিতি ও কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে। প্রায়ই এমন খবর পাই যে দূরের স্কুলগুলোতে কারো পোস্টিং হলে সে সেখানে না গিয়ে স্থানীয় কাউকে টাকার বিনিময়ে রিপ্লেস করে দিচ্ছে। এটা চরম অন্যায়, অনিয়ম ও আইনের লঙ্ঘন। এর ফলে বঞ্চিত হচ্ছে আমাদের মতো প্রান্তিক এলাকার ছেলেমেয়েরা। পাশাপাশি বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক সংকট বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক দেওয়ার আহবান রাখছি।

লেখক: ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি অফিসার, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন