মানিকছড়ির রাইংগাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অব্যবস্থাপনা

এক মাসে স্কুল ছেড়েছে ২৩ শিক্ষার্থী! প্রধান শিক্ষককে বদলির সুপারিশ

fec-image

২০১৩ সালে সারাদেশে একযোগে অসংখ্য বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কর্মরত শিক্ষকদের জাতীয়করণে খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলার ১৯টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ হয়। এদের একটি রাইংগা পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

উপজেলা ৪ নম্বর তিনটহরী ইউনিয়নের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর এই বিদ্যাপীঠে ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন আবদুল মন্নান। আর একই বছরের ৭ মার্চ যোগদান করেন দম্পতি মো. আবুল কাশেম ও হাসনা বেগম। করোনার ধকলে এলোমেলো শিক্ষা ব্যবস্থার দুই বছর পেরিয়ে যায়! ২০২২ সালে পরিপূর্ণ পাঠদানে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সময়োপযোগী পাঠ পরিকল্পনা নেওয়া হলেও এখানে সব যেন সেকালের! বছরের শুরুতে প্রাক-প্রাথমিক থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত মোট শিক্ষার্থী ছিল ৮১ জন, শিক্ষক ৫ জন। উপজেলা শিক্ষা অফিসে দাখিলকৃত গত অক্টোবরের মাসিক রিটার্ন অনুযায়ী ছাত্রছাত্রী ৮০ জন দেখানো হলেও বাস্তবে অনেক শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে ঝরে পড়েছে। বছর শেষে এখন ছাত্র-ছাত্রী ৫৭ জন। নভেম্বর মাসে স্কুল ছেড়েছে ২৩ শিক্ষার্থী!

বিদ্যালয়ে পাঠদান, অফিস ব্যবস্থাপনায় প্রধান শিক্ষকের অদক্ষতা ও একগুঁয়েমিতায় স্কুলে অভিভাবক ও এসএমসি’র সমাবেশ না করে তা কাগজে-কলমে দেখানো হয়! ফলে প্রধান শিক্ষক ও দুই সহকারী শিক্ষকের বিরুদ্ধে উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা শিক্ষা অফিস ও জেলা শিক্ষা অফিসে সম্প্রতি লিখিত অভিযোগ করেন এসএমসি’র সভাপতি মো. সোহাগ মিয়া।

অভিযোগের প্রেক্ষিতে উপজেলা চেয়ারম্যান মো. জয়নাল আবেদীন ও ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা ইতোমধ্যে স্কুল পরিদর্শন করেন এবং উপজেলা শিক্ষা কমিটির বৈঠকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে অবহেলার সত্যতা পেয়ে তাকে অন্যত্র বদলি করার সুপারিশ করেন।

অন্যদিকে গত ২৩ নভেম্বর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সাহাব উদ্দীন অভিযোগ তদন্তে রামগড় উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ইম্রাচিং চৌধুরীকে নির্দেশ দেন । ফলে গত ৪ ডিসেম্বর রামগড় উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ইম্রাচিং চৌধুরী সরজমিনে তদন্ত করেন। এসময় মানিকছড়ি উপজেলা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা জবরুদ খান, এসএমসি’র সভাপতি মো. সোহাগ মিয়া, ইউপি সদস্য মো. শাহ আলম খাসহ এসএমসি কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. জবরুত খান অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, ‘প্রধান শিক্ষক ও এসএমসি’র সভাপতির মধ্যে নানা বিষয়ে মতানৈক্য ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় শিক্ষকের গাফিলতি ও অদক্ষতায় স্কুলে পড়ালেখা বিঘ্ন হচ্ছে। ফলে উপজেলা শিক্ষা কমিটির বৈঠকে প্রধান শিক্ষক আবদুল মন্নানকে বদলির সুপারিশ করা হয়েছে।’

অন্যদিকে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার গঠিত তদন্ত কর্মকর্তা ও রামগড় উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ইম্রাচিং চৌধুরী বলেন, ‌‘আমি জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার আদেশে সরজমিনে অভিভাবক, এসএমসির সদস্য ও অভিযুক্তদের সাথে কথা বলে একটা রিপোর্ট ইতোমধ্যে দাখিল করেছি। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা তদন্ত রিপোর্ট পর্যালোচনাসহ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মনোন্নয়নে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন। ’

এদিকে গত ১১ ডিসেম্বর রবিবার সাড়ে ১১টার পর বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। ওই দিন গণিত বিষয়ে পরীক্ষা দিচ্ছেন ১ম শ্রেণীতে ১১ জন, ২য় শ্রেণীতে ১২ জন, ৩য় শ্রেণীতে ৩ জন, ৪র্থ শ্রেণীতে ১২ জন ও ৫ম শ্রেণীতে ৪ জন! আর প্রাক প্রাথমিকের ১৫ জনের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। বার্ষিক পরীক্ষার উপস্থিতি অনুযায়ী শিক্ষার্থী সংখ্যা এসে দাঁড়ালো ৫৭ জনে! এছাড়াও নভেম্বর মাসে স্কুল ছেড়েছে ২৩ শিক্ষার্থী!

ইউপি সদস্য মো. শাহ আলম খা বলেন, ‘এই প্রধান শিক্ষক এতই অদক্ষ যে, কর্মরত ৫ জন শিক্ষক মিলে ৫০-৬০ জন শিশুকেও ঠিকমতো পাঠদানে অনগ্রসর জনপদে আলো ফোটাতে পারলো না! অ্যাসেম্বলি, জাতীয় সঙ্গীত, শপথ বাক্য পর্যন্ত স্কুলে নিয়মিত হয় না!’

এসএমসি’র সভাপতি মো. সোহাগ মিয়া বলেন, ‘এলাকায় শিক্ষার আলো নেই! ঘরে ঘরে অভিভাকেরা অশিক্ষিত! আমি সামান্য পড়ালেখা করেও এখন ‘ডে লেবার’! তারপরও অভিভাবকদের অনুরোধে দায়িত্ব নিয়েছি। এখন দেখি এ পদে সৎ মানুষের মূল্যায়ন নেই। প্রধান শিক্ষক কমিটি বা অভিভাবকদের নিয়ে মিটিং করতে অনিহা দেখায়। বিদ্যালয়ে গিয়ে সবাই অফিসে বসে মোবাইল চালান! জিজ্ঞেস করলে বলে আজকাল ইন্টারনেট থেকে শিখে ক্লাস করাতে হয়! তাই মোবাইল দেখছি, আপনি এসব বুঝবেন না।’

অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক আবদুল মন্নান অপকটে সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘এসব আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র! এসএমসি কমিটির সভাপতি অসৎ উদ্দেশ্যে মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ দিয়ে কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনকে বিভ্রান্তি করছেন। করোনার সময় নিয়মিত অ্যাসেম্বলি, জাতীয় সঙ্গীত ও শপথ গ্রহণ করানো হয়নি। তবে এখন সব স্বাভাবিকভাবে চলছে।’

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: অব্যবস্থাপনা, রাইংগাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন