ঐতিহ্য হারিয়ে মৃতপ্রায় রামুর প্রাচীন ফকিরা বাজার

fec-image

কক্সবাজারের রামু উপজেলার বাঁকখালী নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠা ঐতিহ্যবাহি ফকিরা বাজার। একসময় পুরো জেলার অন্যতম বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র ছিলো এ বাজার। কালের পরিক্রমায় ঐতিহ্য হারিয়ে বাজারটি এখন মৃতপ্রায়। বাজারের আশপাশে ছড়িয়ে আছে ময়লা-আবর্জনার ছোট-বড় অসংখ্য স্তুপ। একটু বৃষ্টি হলেই কাঁদাপানিতে একাকার হয়ে যায় বাজারের অলিগলি। সরকারি নিলামের গাছ কাটার সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয় দুটি শেড। আরও একটি শেড় সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ হওয়ায় বাজারে বেচাকেনায় হিমশিম খাচ্ছেন ব্যবসায়িরা। বাজারে পণ্য বেচাকেনা করতে গিয়ে অতিরিক্ত টোল আদায়ের কারণে হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়িরা। বাজারকে ঘিরে গড়ে উঠেছে মাদক ব্যবসাসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। এসব কারণে ঐতিহ্য হারিয়ে বিলীন হতে চলেছে কক্সবাজারের রামু উপজেলার প্রাচীন এ বাজার।

বাজারের ব্যবসায়িরা জানান, ইজারাদারের খামখেয়ালিপনা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের অবেহলায় বাজারটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

রামু ফকিরা বাজার ব্যবসায়ি বহুমুখি সমবায় সমিতির সাবেক আহবায়ক মো. শফিক জানান, বতর্মানে পুরো বাজারজুড়ে ময়লা আবর্জনার স্তুপ। কখনো এসব আবর্জনা পরিষ্কার করা হচ্ছে না। এ কারণে বাজারে বেচাকেনার সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। সরকারিভাবেও কোন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। যারা বাজার ইজারা নেন, তারাও কোন উদ্যোগ নেয়না। বাজারটি শেষ পর্যন্ত বিলুপ্তির পথে। এ মুহূর্তে বাজারের শেডগুলো সংস্কার ও আবর্জনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। বাজার ইজারার ৫ ভাগ অর্থ বাজারের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য ব্যয় করার বিধান থাকলেও তা করা হচ্ছে না। তিনি আরও জানান, ইতঃপূর্বে বাজারে ঝূকিপূর্ণ হওয়ায় বড় গাছগুলো সরকারিভাবে নিলাম দেয়া হয়। কাটার সময় গাছ পড়ে দুটি শেড বিধ্বস্ত হয়। যা একবছর পার হলেও সংস্কার করা হয়নি। ফলে এসব শেডগুলোতে বেচাকেনা বন্ধ রয়েছে। ব্যবসায়িরা বিষয়টি ইতঃপূর্বে জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনকে জানালেও সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এছাড়া বাজারটি প্রাণহীন হওয়ার অন্যতম কারণ মাছ বাজারটি চৌমুহনীতে বসানো। মাছ বাজার এখানে স্থানান্তর হলে বাজারটি প্রাণ ফিরে পাবে। ব্যবসায়িরাও লাভবান হবে।

বাজার পরিচালনা কমিটির সদস্য জসিম উদ্দিন জানিয়েছেন, তিনি বাজার পরিচালনা কমিটিতে ৮ বছর সাধারণ সম্পাদক এবং ১০ বছর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি দায়িত্ব পালনকালে বাজারের এমন খারাপ পরিস্থিতি ছিলো না। প্রায় ৫ বছর এ বাজারে কোন ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা হচ্ছে না। বর্ষা হলে বাজারে হাঁটু পানি জমে যায়। ব্যবসায়িরা বসতে পারেনা, লোকজন চলাচল করতে পারেনা। সরকার প্রতি বছর এ বাজার থেকে ৬০-৭০ লাখ টাকা রাজস্ব পাচ্ছে। কিন্তু বাজারের উন্নয়নে কোন অর্থ ব্যয় করা হয়না। বাজারে একটি ইটও বসানো হয়নি। তাহলে এত বড় অংকের রাজস্ব কোথায় যায়?

তিনি আরও জানান, ইতঃপূর্বে প্রণয় চাকমা ইউএনও থাকতে বাজারের গাছগুলো কেটে নিয়ে যান। কিন্তু গাছ পড়ে ভেঙ্গে যাওয়া শেডগুলো সংস্কার করেননি। ময়লার স্তুপগুলো দিনদিন বড় হচ্ছে। ব্যবসায়িরা প্রতিদিন এখানে ময়লা আবর্জনা ফেলছে। এসব ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধে বাজারে আসাও কঠিন হয়ে পড়েছে। অথচ বাজারের ইজারা বাবদ অনেক টাকা জমা রয়েছে। এসব অর্থ দিয়ে সহসা বাজারটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার উদ্যোগ নেয়ার জন্য তিনি প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানান।

রামু ফকিরা বাজার ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতি লি. এর সাবেক সভাপতি এবং রামু ফকিরা বাজার পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব মোহাম্মদ নুরুল আলম বলেন, “দক্ষিণ চট্টলার অন্যতম প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী বাজার রামু ফকিরা বাজারে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় রামু উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় আধুনিকায়ন পদ্ধতি অবলম্বন করা গেলে হাট বাজার সম্পর্কিত জনসাধারণের প্রচলিত ধ্যান ধারণা আমূল পাল্টে যাবে। সংসদ সদস্য আলহাজ্ব সাইমুম সরওয়ার কমল এবং রামু ফকিরা বাজার পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও ফতেখাঁরকুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম ভুট্টো রামু ফকিরা বাজারের উন্নয়নে ইতোমধ্যে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন। আশাকরি খুব শীঘ্রই ব্যবসায়ী ও বাজারে আগত জনসাধারণ এর সুফল ভোগ করবেন।”

বাজার পরিচালনা কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বাদল জানিয়েছেন, বাজারটি এখন অনেক সমস্যায় জর্জরিত। বাজারে নানাপ্রকার অপরাধ কর্মকাণ্ড সংগঠিত হচ্ছে। এটি এখন ইয়াবা ব্যবসায়িদের অভয়ারণ্য হয়ে পড়েছে। এ বাজারের মতো বেহাল দশা দেশের কোথাও নেই। বাজারটিকে আগের মতো সরগরম করতে হলে চৌমুহনী স্টেশনের অস্থায়ী বাজারটি অবিলম্বে এখানে সরিয়ে আনতে হবে। এজন্য তিনি প্রশাসনের জোরালো হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

রামু ফকিরা বাজার ব্যবসায়ি কল্যাণ সমিতির সভাপতি, সাবেক ইউপি সদস্য আবদুল আজিজ জানান, কিছু প্রভাবশালী মহল বাজারটিকে লুটেপুটে খাচ্ছে। ব্যবসায়িরা প্রতিবাদ করলেও উল্টো তারা ব্যবসায়িদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। বাজারের নালা-নর্দমাগুলো ভরাট হয়ে এখন ময়লা-আবর্জনায় একাকার হয়ে গেছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজও দীর্ঘদিন বন্ধ। এখন উল্টো দোকানের সামনে ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। বাজারটি এখন গরু-ছাগলের চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে। অথচ ইজারাদার কেবল টোল আদায় করেই চলে যায়। বাজারের উন্নয়নে কোন উদ্যোগ নেয়না।

বাজারের ব্যবসায়ি (টেইলার্স মালিক) নুরুল হক জানান, বাজারের শেডগুলো বিধ্বস্ত ও জরাজীর্ণ, ড্রেনগুলো ভরাট হয়ে পানিতে একাকার, বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতারা আসা-যাওয়ার পরিস্থিতিও নেই। তাই বাজারের ব্যবসার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হলে বিরাজমান এসব সমস্যা অবিলম্বে সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।

ভুক্তভোগী কয়েকজন ব্যবসায়ি জানান, এ বাজারের ১০০ টাকার মালামাল বিক্রয় করতে হলেও ৫০ টাকা ইজারাদারকে দিতে হচ্ছে। এ কারণে অনেক ব্যবসায়ি এ বাজারে মালামাল বিক্রি করতে আসেনা। বাজারে গরু জবাই করার জন্য সরকারিভাবে স্থাপনা থাকলেও তাতে কেউ গরু জবাই করে না। মাঝে মাঝে গরু জবাই করলেও মাংস বিক্রি করা হয় বাজারের পরিবর্তে অন্যকোন স্থানে। অথচ মাংস বাজারে বিক্রি করলে অনেক ক্রেতা বাজারে আসতো।

ব্যবসায়িরা জানান, সুধীর বড়ুয়া নামের এক ব্যক্তি বাজার ইজারা নিয়েছেন। তিনি একাধিক ব্যক্তিকে বাজারের একেকটি অংশ ইজারা দিয়েছেন। মূল ইজারাদারের পরিবর্তে তার সাথে চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তিরা বাজারে অতিরিক্ত টোল আদায় করছে। এ কারণে বাজারের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাসহ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে মূল ইজারাদার কোন ভূমিকা রাখছেন না। যারা মূল ইজারাদারের কাছ থেকে চুক্তিভিত্তিক বাজার ইজারা নিয়েছেন তারাও বাজারের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও অবকাঠামো সংস্কারের প্রয়োজন মনে করছে না। ফলে বাজারের বেহাল দশা সৃষ্টি হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানার জন্য বাজার ইজারাদার সুধীর বড়ুয়া জানান, ইতঃপূর্বে বাজারের বিভিন্ন অংশ হতে যারা টোল আদায় করতেন তারাই সম্মিলতিভাবে বাজার ইজারা নিয়েছেন। প্রশাসনের কাছ থেকে বাজার ইজারা নেয়ার সময় কেবল তার নামে আবেদন করা হয়েছিলো। তাই বাজারের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার বিষয়টি তাদের দায়িত্ব।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) রামু উপজেলা প্রকৌশলী মঞ্জুর হাসান ভূইঁয়া জানিয়েছেন, বাজারের পণ্য বেচাকেনার শেডগুলো বিধ্বস্থ ও জরাজীর্ণ হওয়ার বিষয়টি জানার পর ৩টি শেড নির্মাণ করার জন্য একটি প্রকল্প ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করেছেন। এছাড়া বাজারের নিলামের অর্থের একটি অংশ বাজারের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, টয়লেট, কসাইখানা সংস্কার ও অন্যান্য স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ইজারাদারের কাছে থাকে। বাজার নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা ইজারাদারের নিয়মিত কাজের অংশ। কিন্তু এখন জানলাম, ইজারাদার এ কাজগুলো করছেনা। তাই বিষয়টি রামু উপজেলা পরিষদের আইনশৃঙ্খলা ও সমন্বয় কমিটির সভায় উত্থাপন করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

রামু উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফাহমিদা মুস্তফা জানিয়েছেন, বাজারে তিনি কয়েকবার গিয়েছিলেন। কিন্তু বিধ্বস্ত ও জরাজীর্ণ শেডগুলো তিনি দেখেননি। এখন বাজার পরিদর্শন করে এসব সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান তিনি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন