ক্যাম্প থেকে পালিয়ে রোহিঙ্গা শিশুরা যুক্ত হচ্ছে পথশিশুদের সাথে, পড়ছে ঝুঁকিতে

fec-image

কক্সবাজার শহরের সুগন্ধা পয়েন্ট এলাকার ট্যুরিস্ট পুলিশ বক্সের পাশে ১০-১২ জন পথশিশু ফুটপাতের উপর আড্ডা দিচ্ছিল। এই শিশুদের সাথে গল্পের এক পর্যায়ে জানতে চাওয়া হয় তাদের মধ্যে কে কে রোহিঙ্গা? সহজ স্বীকারোক্তিতে ৭ জন শিশু হাত উঠায়।

তাদের মধ্যে থেকে ১২ বছরের করিম উল্লাহ (ছদ্মনাম) জানান, গত দুই বছর আগে চেকপোস্ট ফাঁকি দিয়ে উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা পরিবারের কাছ থেকে পালিয়ে শহরে চলে আসে। রোহিঙ্গা বন্ধুর সহযোগিতায় পালিয়ে এসে যুক্ত হয় শহরের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সাথে। প্রথম ৩-৪ দিন খারাপ লাগলেও আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে উঠে প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়ে ভাঙ্গারীর দোকানে বিক্রি করা জীবন। করিম উল্লাহর রাত-দিন কাটে রাস্তায়। দিনে ভাঙ্গারী কুড়িয়ে বিক্রি করে খাবারের টাকা জোগাড় করে আর গভীর রাতে ক্লান্ত শরীরে অন্য শিশুদের সাথে ফুটপাতে ঘুমিয়ে পড়ে। ক্যাম্প থেকে আসার ৩ মাস পর শহরের গাড়ির মাঠ এলাকার এক চায়ের দোকানে গ্লাসবয় হিসেবে কাজ পায় করিম উল্লাহ। কিন্তু প্রায় ২০ দিন পর ওখান থেকে বের করে দেওয়া হয় কাজের সময় খেলতে যাওয়ার অভিযোগে। পরে আবারো সেই পুরাতন রাস্তায় পথশিশু বন্ধুদের সাথে। খেয়ে না খেয়ে ঝড়-বৃষ্টির মাঝে চলছে জীবন। প্রতিনিয়ত অবহেলা আর মারধরের শিকার হচ্ছে। যদিও এরই মধ্যে তার সাথে পরিবারের যোগাযোগ হয়। পরিবার শুরুর দিকে চিন্তিত থাকলেও এখন স্বাভাবিক। সে পরিবারকে জানিয়েছে চায়ের দোকানে চাকরি করে। কিন্ত আসলে সে পরিণত হয়েছে একজন পথশিশু’তে।

মোহাম্মদ আবদুল্লাহ্ (ছদ্মনাম) নামে আরেক রোহিঙ্গা শিশুর সাথে কথা হয়। তার বাম হাতের কবজির বেশিরভাগ অংশ পুড়ে দুইটি আঙ্গুল বেঁকে গেছে। কিভাবে এমন হল প্রশ্নে জানায়, ছয় মাস আগে ডিসের তার মনে করে বৈদ্যুতিক তার টান দেওয়াও এই দুর্ঘটনা হয়। সে গত দেড় বছর আগে বালুখালী ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এসেছে।

চেকপোস্ট কীভাবে ফাঁকি দেয় এমন প্রশ্নের উত্তরে বলে, আগে সমস্যা হলেও এখন কোন ব্যাপার না। স্থানীয়দের মত পোষাক, কথাবার্তা আর চলাচল করতে পারলেই চেক পোস্ট ফাঁকি দেওয়া যায়। এছাড়া ধরা খেলে ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়। পরে আবার চেষ্টা করে চলে আসা যায়।

আব্দুল আলিম নামে আরেক রোহিঙ্গা শিশু জানায়, গত ৯ মাস আগে শহরের নাজিরারটেক থাকা পুরাতন এক রোহিঙ্গা আত্মীয়ের মধ্যমে শহরে আসে শুটকি পল্লীতে কাজ করার জন্য। তারা শুরুর দিকে ভাল ব্যবহার করলেও পরে ঘর থেকে বের করে দেয়। একবেলা খেতে দিয়ে আরেক বেলা দেয়না। তাই গত ৬ মাস ধরে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সাথে যুক্ত হয়েছে। যেখানে তার পরিচিত রোহিঙ্গা শিশুরা আছে।

আব্দুল আলিম আরো জানান, মাস খানেক আগে তার কাছে থাকা ১০০ টাকা ছিনিয়ে নেয় মাতাল এক ছিনতাইকারী। ওই সময় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে হাত ও পিঠে মারাত্মকভাবে জখম হয়। এরপর থেকে তেমন ভাঙ্গারী কুড়াতে পারেনা। যদিও পর্যটকদের কাছে চেয়ে খাবারের টাকা যোগাড় করছে। এত কষ্ট করে পথশিশুদের সাথে থাকছে কেন এমন প্রশ্লে বলে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এই ধরণের ভাঙ্গারী কুড়ানোর সুযোগ নেই। কষ্ট হলেও এখানেই ভাল লাগে।

শুধু এই ৩ পথশিশু বলে কথা নয়। কক্সবাজার শহরের সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের কল্যাণে কাজ করা ‘নতুন জীবন’ সংগঠনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে শহরে থাকা পথশিশুদের মধ্যে প্রায় ৩ ভাগের এক ভাগই রোহিঙ্গা শিশু। তারা প্রতিনিয়ত ঝুঁকির সম্মুখিন হচ্ছে। থাকা-খাওয়ার অনিশ্চিয়তার পাশাপাশি অসুস্থ হচ্ছে। পতিত হচ্ছে দুর্ঘটনায়।

নতুন জীবন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সুমন শর্মা জানান, এই শহরে আড়াই’শ এর বেশি সুবিধাবঞ্চিত শিশু রয়েছে। তার মধ্যে প্রায় ১’শ রোহিঙ্গা শিশু রয়েছে। এই শিশুদের রাত্রী যাপন যেমন অনিশ্চিত ঠিক তেমনি খাবারও অনিশ্চিত। তারা শহরের কলাতলী, সুগন্ধা পয়েন্ট, গাড়ির মাছ, সমিতি পাড়া, পেশকার পাড়া ও কবিতা ”ত্বর এলাকায় অবস্থান করে। তাদের রাত কাটে ফুটপাত, মার্কেটের বারান্দা ও ভাঙ্গারী দোকানে। খাবারের টাকা যোগাড় করছে ভাঙ্গারী কুড়িয়ে আর ভিক্ষাবৃত্তি করে। প্রতিনিয়ত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ভাঙ্গারী ব্যবসায়ীরাও ওজনে কম দিয়ে এবং টাকা না দিয়ে ঠকাচ্ছে। প্রতিনিয়ত অসুস্থ, দুর্ঘটনা ও হামলার শিকার হচ্ছে। এই অবস্থায় ঝঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা কোমলমতি শিশুদের সহযোগিতায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ সকলের এগিয়ে আসা উচিত।

এই প্রসঙ্গে কক্সবাজার শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পূর্নবাসন কেন্দ্রের উপ-প্রকল্প পরিচালক জেসমিন আকতার জানান, রোহিঙ্গা শিশুদের পূর্নবাসন কেন্দ্রে রাখার নিয়ম নেই। যদিও অনেক সংগঠন পথশিশুদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য পাঠায়। রোহিঙ্গা শিশুদের ফিরিয়ে দিতে খারাপ লাগলেও কিছু করার থাকে না। এই কোমলমতি শিশুদের নিরাপত্তার জন্য স্থায়ী সমাধান জরুরী হয়ে পড়েছে।

উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী সুগন্ধা পয়েন্টের নালায় পর্যটকের পড়ে যাওয়া মোবাইল তুলতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মর্মান্তিভাবে মারা যায় লালু (১০) নামে এক পথশিশু। এই শিশুটি ছিল রোহিঙ্গা শিশু।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বিভীষণ কান্তি দাশ (সার্বিক) জানান, রোহিঙ্গা শিশু ক্যাম্প ছেড়ে আসার জরিপ তাদের কাছে নেই। তবে কোমলমতি শিশুরা ক্যাম্প ছেড়ে আসটা কোনভাবেই কাম্য নয়। এই ক্ষেত্রে সার্বিক প্রচেষ্টা থাকতে হবে যাতে করে শিশুরা নিরাপদে থাকে।

কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের পুলিশ সুপার মো. জিল্লুর রহমান জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা আরো জোরদার করতে হবে। যেসব শিশু ইতিমধ্যে আসছে এই শিশুদের খুঁজে বের করে নিরাপদে ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো দরকার। শুধু রোহিঙ্গা শিশু বলে কথা নয় সব শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সমষ্টিগতভাবে কাজ করতে হবে।

এই প্রসঙ্গে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনা মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, রোহিঙ্গাদের সার্বিক সমস্যা সমাধানে প্রত্যাবাসনের বিকল্প নেই। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন অবশ্যই মর্যাদাপূর্ণ টেকসই এবং হবে এই জন্য বাংলাদেশ সরকার কাজ করে যাচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন