গাজায় স্থল অভিযান চালাতে গিয়ে হামাসের তোপের মুখে ইসরায়েল বাহিনী

fec-image

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সাথে ইসরায়েলি বাহিনী যুদ্ধ ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছে। প্রায় এক সপ্তাহ হল ইসরায়েলি বাহিনী উত্তর গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে বড় আকারে স্থল হামলা চালাচ্ছে।

তবে বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, হামাসও ব্যাপক প্রস্তুতি ও দক্ষতার সঙ্গে এসব হামলা মোকাবিলা করছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, এখন পর্যন্ত ইসরায়েলিদের স্থল হামলা ‘মুখ থুবড়ে’ পড়েছে।

শনিবার (৪ নভেম্বর) এসব তথ্য জানায় কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরা।

তবে স্থল অভিযান শুরুর এক সপ্তাহ পর ইসরায়েল দাবি করে, তারা উত্তরে গাজা শহরকে ঘিরে ফেলেছে। এ ছাড়া ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ৭ অক্টোবরের হামলার নেপথ্যের মূল পরিকল্পনাকারী ১০ কমান্ডারকেও হত্যার দাবি জানায় তারা। প্র

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জানিয়ছেন, এসব হামলায় ‘প্রশংসনীয় সাফল্য’ পেয়েছে দেশটি।

গত এক সপ্তাহে ইসরায়েল হামলার ক্ষেত্রে যে কৌশল অবলম্বন করেছে, তা হল, গাজা উপত্যকার উত্তরে একই জায়গায় (উপত্যকার এক তৃতীয়াংশে) বারবার হামলা চালিয়ে হামাস ও তাদের মিত্রদের দুর্বল করা। তবে এই কৌশলে ঐ অংশে বসবাসকারী বেসামরিক গাজাবাসীদের ওপর নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ এবং সারা বিশ্বের কাছে ইসরায়েলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এই কৌশলের কারণে গাজা শহরের উত্তরে এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির জাবালিয়া বারবার আক্রান্ত হচ্ছে। ইসরায়েলের দাবি, এই শিবির হামাসের ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কের কেন্দ্রস্থল। এখানে মাটির নিচে অস্ত্রের মজুত, রকেট নিক্ষেপের অবকাঠামো ও উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত সুড়ঙ্গপথ রয়েছে। তবে তাদের এই দাবির স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি ইসরায়েল।

তা সত্ত্বেও, গত তিন দিন বিমানহামলায় জাবালিয়ার বড় একটি অংশ মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে ইসরায়েল। এসব হামলায় অন্তত ৫০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় এক হাজার ৪০০ ইসরায়েলি নিহত হওয়ার পর থেকে প্রতিশোধমূলক, নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। শুরুতে বিমানহামলায় সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন সঙ্গে স্থল হামলাও চলছে। প্রায় এক মাসের এই হামলায় এখন পর্যন্ত নয় হাজার ৪০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে প্রায় চার হাজারই শিশু।

গত শুক্রবার গাজা শহর থেকে দক্ষিণ গাজার দিকে আগাতে থাকা অ্যাম্বুলেন্স বহরের ওপর বোমাবর্ষণ করে ইসরায়েল। এবারও ইসরায়েল কোনো প্রমাণ ছাড়াই দাবি করে, অ্যাম্বুলেন্সে হামাসের যোদ্ধারা ছিলেন। এই হামলায় ১৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন।

ব্যাপক হামলা সত্ত্বেও হামাসের রকেট নিক্ষেপ অবকাঠামোর তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারেনি ইসরায়েল। গত এক সপ্তাহজুড়ে প্রায় প্রতিদিনই ইসরায়েলি ভূখণ্ডের দিকে গড়ে ১২টি করে রকেট ছুঁড়েছে হামাস। তবে ৩ নভেম্বর রকেটের সংখ্যা কমে ৯ হয়েছিল। ইসরায়েল সরকার ও গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া হতাহতের সংখ্যা অনুযায়ী, উভয় পক্ষেই নিহতদের মধ্যে বেসামরিক ব্যক্তির সংখ্যা বেশি।

ইসরায়েল জানিয়েছে, স্থল হামলা শুরুর পর তাদের ২৫ সেনা নিহত হয়েছে। যার ফলে এই সংঘাতে নিহত সেনার সংখ্যা বেড়ে ৩৩২ হয়েছে। আরও ২৬০ জন সেনা আহত হয়েছেন। ইসরায়েল আরও দাবি করে, হামাসের হাতে জিম্মি হিসেবে আছেন ২৪২ জন বেসামরিক ব্যক্তি।

২৫ অক্টোবর হামাসকে ‘নিশ্চিহ্ন’ করার অঙ্গীকার করেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। এরপর সীমিত আকারে উত্তর গাজায় স্থল হামলা চালাতে শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। শুরুতে একটি সশস্ত্র ব্যাটেলিয়ন ও বুলডোজার নিয়ে হামলা চালায় তারা। ইসরায়েল দাবি করে, ‘তারা অসংখ্য হামাস যোদ্ধাদের চিহ্নিত করে তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে এবং তাদের অবকাঠামো ও ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র ধ্বংস করেছে’।

২৭ অক্টোবর রাতে আবারও ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় স্থল হামলা চালায়। এবার তাদের সঙ্গে ছিল হেলিকপ্টার গানশিপ। সেদিন ইসরায়েলি নৌবাহিনী দাবি করে, তারা রাফাহ সৈকতে হামাসের নৌ কমান্ডোদের ব্যবহৃত একটি কমপাউন্ড ধ্বংস করেছে। এরপর, ২৮ অক্টোবর ইসরায়েল পূর্ণমাত্রার স্থল হামলা শুরু করে। হামলার শুরুতেই তারা গাজার টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা বিকল করে দেয়। যার ফলে গাজা উপত্যকায় ইন্টারনেট ও টেলিফোন সংযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় গাজা।

এদিকে বিশেষজ্ঞরা আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, হামাসের হামলা ও ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া, এই দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাতের মাত্রা ও ধরনকে ছাড়িয়ে গেছে।

লামসা মাস্টার স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বিষয়ের অধ্যাপক মাত্তেও ব্রেসান বলেন, ‘৭ অক্টোবর থেকে আমরা যা দেখেছি, তা এক নতুন ধরনের যুদ্ধ।’

ব্রেসান বলেন, ‘হামাস ইসরায়েলে ছয় হাজার রকেট নিক্ষেপ করে। এই সংখ্যাটি হামাসের নজিরবিহীন সামরিক সক্ষমতার পরিচয় দেয়। এখানে প্রশ্ন হল, কীভাবে হামাস ২০টি ভিন্ন ভিন্ন গ্রামে ২০টি যুগপৎ হামলা চালাতে সক্ষম হল? এর অর্থ, হামাস এর জন্য প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি পেয়েছে।’

হামাসের সশস্ত্র বাহিনী আল-কাসাম ব্রিগেড জানায়, তারা ইসরায়েলের পারমাণবিক চুল্লী ও দিমোনায় অবস্থিত গবেষণা কেন্দ্র লক্ষ্য করে রকেট ছুঁড়েছে। এর আগে কখনোই তারা এ ধরনের হামলা চালায়নি। এসব কারণে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া আগের চেয়ে ভিন্ন। এবার আর বিষয়টি সহজ-সরল নেই। এবং ইসরায়েল সময় নিয়েই হামলার জবাব দিচ্ছে’।

মার্কিন স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডার ডিমেট্রিয়াস অ্যান্ড্রু গ্রাইমস আল জাজিরাকে বলেন, ‘হামাস এই যুদ্ধের জন্য দীর্ঘসময় ধরে প্রস্তুতি নিয়েছে। এখন যেসব রকেট নিক্ষেপ করছে তারা, সেগুলো অনেক আগে থেকেই প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। হামাসের অনেক রকেট ব্যাটারি মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা আছে। অনেকগুলোই গাজার মাটির নিচে সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কে মোতায়েন করা হয়েছে’।

তিনি হামাসকে নিশ্চিহ্ন করার ইসরায়েলি লক্ষ্যমাত্রাকে ‘অত্যন্ত কঠিন’ বলে অভিহিত করেন।

হামাস দাবি করেছে, তারা ইসরায়েলের বেশ কিছু ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান ধ্বংস করেছে। ১ নভেম্বর হামাস জানায়, তারা চারটি ইসরায়েলি মেরকাভা ট্যাংক ধ্বংস করেছে। বেইত হানৌন এলাকার এই সংঘাতে হামাস তাদের নিজেদের তৈরি ইয়াসিন-১০৫ ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করার কথা জানায়। তবে এসব দাবি নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

২৯ অক্টোবর হামাসের আল-কাসাম ব্রিগেড দাবি করে, তারা বেইত হানৌনে সুড়ঙ্গপথ ব্যবহার করে ইসরায়েলি বাহিনীর পেছন দিকে যেয়ে হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েল এই অঞ্চলকে ইরেজ বলে অভিহিত করে। এটি ইসরায়েল ও উত্তর গাজা সীমান্তে অবস্থিত।

হামাস জানায়, ‘যোদ্ধারা সীমান্ত পার হয়ে ইসরায়েলি ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানের দিকে বর্ম-ভেদ করতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। এই হামলায় অধিগ্রহণকারীদের (ইসরায়েলের) বেশ কিছু সেনা নিহত হন।’

গ্রাইমস মত প্রকাশ করেন, সংঘাতের অল্প কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ইসরায়েলের অসংখ্য সেনা নিহত হয়েছে, যা দেশটির সামরিক সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

কাসাম ব্রিগেডের এসব দুঃসাহসিক ও কার্যকর হামলার কথা উল্লেখ করে হিজবুল্লাহ বাহিনীর প্রধান ইসরায়েলকে ‘দুর্বল’ বলে অভিহিত করেন।

৩ নভেম্বর প্রথম বারের মতো হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ নিয়ে জনসম্মুখে বক্তব্য রাখেন লেবানন ভিত্তিক সশস্ত্র দল হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরাল্লাহ। তার এই ভাষণ টেলিভিশনে প্রচার হয়। তিনি বলেন, ‘(হামাসের হামলায়) ইসরায়েলের দুর্বল ও ভঙ্গুর পরিস্থিতি প্রকাশ্যে চলে এসেছে। তারা মাকড়শার জালের চেয়েও ভঙ্গুর’।

তিনি বলেন, ‘অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ইসরায়েলের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মাধ্যমেই বোঝা যায় আল-আকসা ফ্লাড অপারেশন (হামাসের অভিযানের সাংকেতিক নাম) শুরুর পর ঠিক কতটুকু দুর্বল হয়ে পড়েছে ইসরায়েল।’

নাসরাল্লাহ আরও জানান, এই যুদ্ধের মাধ্যমে এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছে।

‘এটা আগের কোন ঘটনার মতো নয়। এটি একটি ফলাফল নির্ধারণী যুদ্ধ, একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধ। এই যুদ্ধের পর যা হবে, তা এর আগে আর কখনোই দেখা যায়নি’, যোগ করেন তিনি।

গত সপ্তাহের পুরোটা সময়জুড়ে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে। মূলত, তাদের যুদ্ধকৌশল সমালোচনার মুখে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে নিজেদের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছে দেশটি।

প্রাথমিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের কাছ থেকে আসা ‘মানবিক কারণে’ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে অস্বীকার করেন নেতানিয়াহু। তিনি দাবি করেন, এতে হামাস আবারও সংঘবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পাবে।

তবে ৩ নভেম্বর তিনি তার এই অবস্থান থেকে কিছুটা সরে আসতে বাধ্য হন যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট মানবিক কারণে যুদ্ধবিরতির স্বপক্ষে মত দেন।

ইসরায়েল শর্ত দিয়েছে, হামাসের হাতে বন্দী জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হলে তারা যুদ্ধবিরতির বিষয়টি বিবেচনা করবে। যতক্ষণ না আমাদের জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ইসরায়েল সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে সম্মতি দেবে না।

গাজায় ত্রাণসামগ্রী প্রবেশ বিষয়েও খানিকটা নমনীয় অবস্থান নিয়েছেন নেতানিয়াহু। শুরুতে অল্প কয়েক ট্রাক খাবার, পানি ও ওষুধ প্রবেশের অনুমতি দেন তিনি। তবে ৩১ অক্টোবর নেতানিয়াহু দিনে ১০০ ট্রাক প্রবেশে সম্মতি জানান। তবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, ১০০ ট্রাকও যথেষ্ট নয়।

তবে গত বৃহস্পতিবার প্রথমবারের মতো ইসরায়েল বিদেশী পাসপোর্টধারী ফিলিস্তিনি ও বিদেশী নাগরিকদের গাজা ছেড়ে মিশর যাওয়ার অনুমতি দেয়। এছাড়াও, রাফাহ সীমান্ত দিয়ে প্রায় ৮০ জন আহত ফিলিস্তিনিকে চিকিৎসার জন্য মিশরে যেতে দেয় দেশটি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন