জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা নির্বাচিত

চিরসবুজ জনপদের শিক্ষকদের অনন্য দৃষ্টান্ত “জাহানারা পারভীন লাকী”

fec-image

দেশের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান থেকে পাঠ চুকিয়ে ২০০৬ সালে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় যোগদান করেন জাহানারা পারভীন লাকী। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন মেধাবী এ নারী শিক্ষিকা। চিরসবুজ জনপদ বান্দরবান পার্বত্য জেলার আলীকদম উপজেলার চম্পট পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারি শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত তিনি।

জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ-২০২৩ আলীকদম উপজেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা নির্বাচিত হওয়ার পর দ্বিতীয় বারের মতো আবারও জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা নির্বাচিত হয়ে চমক দেখিয়েছেন মেধাবী শিক্ষিকা জাহানারা পারভীন লাকী।

বান্দরবান জেলার ৭টি উপজেলার নির্বাচিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ সহকারি শিক্ষিকা থেকে গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২৩ইং তারিখ জেলা পর্যায়ের যাচাই-বাছাই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পাঠদান, উদ্ভাবনী কৌশল, পাঠ প্রস্তুতি, মূল্যায়ন, সহ: শিক্ষাক্রমিক পারদর্শিতা, শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া রোধসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের উপর পর্যালোচনা ও নিরীক্ষণ পূর্বক যাচাই-বাছাই করে জেলা পর্যায়েও তিনি শ্রেষ্ঠ সহকারি শিক্ষিকা নির্বাচিত হন।

জানা গেছে, জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা জাহানারা পারভীন লাকী ছোটবেলা থেকেই ছিলেন সংস্কৃতিমনা। মা-বাবা, ভাই-বোনের উৎসাহ উদ্দীপনা নিজের ইচ্ছা শক্তি, দৃঢ় বিশ্বাস এবং মনোবল নিয়ে অদ্যবদি পর্যন্ত কর্মক্ষেত্রে একেরপর এক অভাবনীয় সাফল্যেরধারা অব্যাহত রেখে এগিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে নানা ধরণের অসমান্য অবদান রাখায় জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ২০২৩ প্রতিযোগিতায় জেলা পর্যাযে শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা হিসেবে তাঁকে নির্বাচিত করা হয়।

দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে শিক্ষাকতা পেশায় সুনামের সহিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। বর্তমানে আলীকদম উপজেলার চম্পট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অত্যান্ত দক্ষতা ও নিষ্টার সাথে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শিক্ষামূলক এবং সামাজিক কর্মকান্ডের সাথে নিজেকে জড়িত রেখেছেন। একাধারে তিনি একজন শিক্ষিকা, কন্ঠশিল্পী, লেখক, সাংস্কৃতিক কর্মী, উপস্থাপক ও সমাজকর্মী।

এছাড়াও মেধাবী এ নারী শিক্ষিকা তাঁর নিষ্ঠা ও কর্তব্যপরায়নতা, অধ্যবসায় এবং কঠোর পরিশ্রমের কারণে শিক্ষার্থী ও অভিভাবক মহলের কাছে জনপ্রিয় শিক্ষিকা হিসেবে দ্রুতি ছাড়িয়েছেন। তিনি বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের মাঝে নিত্য নতুন আকর্ষনীয় পাঠদান থেকে শুরু করে সমাবেশ, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, বিশেষ ক্লাস নেওয়াসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই রযেছে সক্রিয় অংশগ্রহণ। এছাড়াও শিক্ষা মেলা, উন্নয়ন মেলা, বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালন, প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত যে কোন কর্মসূচিতে তিনি নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।

পেশাগত জীবনে মেধাবী এ নারী শিক্ষিকার রয়েছে অজস্র কৃতিত্বের সাক্ষর। বিগত ২০১৬ সালেও তিনি চট্টগ্রাম বিভাগের শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা নির্বাচিত হয়ে জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন।

২০১৭ সালে মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের রাঙ্গা সকাল অনুষ্ঠানে “আপন ঠিকানা খ্যাত” আর জে কিবরিয়ার উপস্থাপনায় এক ঘন্টার লাইভ সাক্ষাৎকার প্রচারে অংশগ্রহন করেন তিনি।

২০১৮ সালে সরকারিভাবে শ্রীলংকায় শিক্ষা সফরের সুযোগ পান। ২০২২ সালে সারা বাংলাদেশ থেকে পরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন ধাপে শিক্ষক বাছাই করে সিএসএসআর (CSSR) প্রজেক্টের আওতায় রেডিও টেলিভিশন ক্লাস নেওয়ার জন্য প্রতিটি ধাপে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সংসদ টেলিভিশনে ক্লাস নেওয়ার সুযোগ হয়। টেলিভিশনে পাঠদানে অনেকগুলো তাঁর ক্লাস রেকর্ড হয় এবং অনেকগুলো ক্লাস সম্প্রচার হয়েছে। বর্তমানেও তাঁর পাঠদান ক্লাস সম্প্রচার চলমান রয়েছে। এছাড়া সারা বাংলাদেশ থেকে ইংরেজি বিষয়ের প্রশিক্ষক নির্বাচনের জন্য ব্রিটিশ কাউন্সিলের আওতায় এপিটিআইএস টেস্ট (APTIS TEST) নেওয়া হলে তিনি ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে টিএমটিই (Training of Master Training in English) Cohort 5 এ ঢাকা পিটিআইতে ৪ মাসের প্রশিক্ষনেও সফলতা বয়ে আনেন। বলতে গেলে তিনি সংগীত বিষয়ের একজন প্রশিক্ষকও।

টিচার্স ট্রেনিং কলেজ চট্টগ্রাম থেকে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে এমএড এ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তাছাড়া তিনি একসময় বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রামে গান পরিবেশন করেছেন। যা দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছবিসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক আয়োজিত বিভিন্ন জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে অত্যান্ত সাবলীল ভাষায় চমৎকারভাবে উপস্থাপনা করে মানুষের নজর কেড়েছেন মেধাবী এ নারী শিক্ষিকা।

তিনি ETAB-(English Teacher Association of Bangladesh) একজন লাইফ টাইম মেম্বার। বৈশ্বিক মহামারী করোনাকালীন সময়ে তিনি জুম এবং google মিটে প্রায় দুই শতাধিক ক্লাস পরিচালনা করেন, যার অনেকগুলোই ছিল লাইভ ক্লাস। এসব ক্লাসের অনেকগুগল মিট ক্লাস জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, উপজেলা শিক্ষা অফিসার, সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার, ইউ আর সি ইন্সট্রাক্টর পর্যবেক্ষণ করেন।

শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নানা অবদান রাখায় বিভিন্ন সময়ে উপজেলা পরিষদ, প্রশাসন, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও অনলাইন পেইজের পক্ষথেকে সম্মাননা বয়ে আনেন। বিভিন্ন সময়ে নানা প্রতিকূলতা পেছনে ফেলে তিনি আজ নামকরা সফল একজন শিক্ষিকা।

জাহানারা পারভীন লাকী আলীকদম উপজেলার সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ৫ বোন এক ভাইযের মধ্যে তিনি সবার ছোট। তিনি আলীকদম সদর ইউনিয়ন পরিষদের ৩ বার নির্বাচিত চেয়ারম্যান নাছির উদ্দীন এবং কক্সবাজার সদরের উত্তর নুনিয়ারছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ফোরকান আরা বেগমের ছোট বোন। সংসার জীবনে এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জননী। তিনি সাংবাদিক বশির আহম্মেদ রুবেলের সহধর্মিণী।

উপজেলার একাধিক শিক্ষকের কাছ জানতে চাইলে তারা জানান, লাকী ম্যাডামের মতো শিক্ষিকা আলীকদম তথা বান্দরবানের জন্য গর্ব। প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত সকল কাজে তার আগ্রহ, উদ্দীপনা, দায়িত্ববোধ, বিভিন্ন দিকনির্দেশক ও মতামত আমাদের সকলকে মুগ্ধ করে তোলে। শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি খুবই জনপ্রিয়। জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহের শিক্ষিকা নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাছাই কমিটি সঠিক গুণাবলী সম্পন্ন একজন সত্যিকারের আদর্শিক শিক্ষককে নির্বাচিত করেছেন। তাঁর জন্য বাছাই কমিটিকে অশেষ ধন্যবাদ। আশারাখি বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়েও তিনি শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট বান্দরবানের শিক্ষা পরিবারকে উপহার দিয়ে কৃতিত্বের সাক্ষর রাখবেন।

জেলা পর্য়ায়ে দ্বিতীয় বারের মতো শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা হওয়ার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, প্রথমে আল্লাহর কাছে শোকরিয়া জ্ঞাপন করি। উপজেলায় ৫০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পেছনে ফেলে শ্রেষ্ঠ সহকারি শিক্ষিকা নির্বাচিত হওয়ার পর গেল বছরের ন্যায় এবারেও জেলায় শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা নির্বাচিত হলাম। আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্তরিকতা ও অনুপ্রেরণায় উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা নির্বাচিত করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সকলের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

তিনি আরো বলেন, ১৭ বছর শিক্ষকতা জীবনে প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তি অনেক বেশি। আমি কর্মে বিশ্বাসী। কর্মের মাধ্যমে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে বেঁচে থাকতে চাই। যতদিন বাঁচব ততদিন ভালো কাজ করে যাবো। আমার ভাল কর্মগুলো যেন বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা নিজের ভেতর লালন করে একজন আদর্শিক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠে। সেদিনই আমার শিক্ষাকতা পেশা ও কর্মজীবন সার্থক হবে যেদিন আমার শিক্ষার্থীরা সত্যিকারে একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন শিক্ষার্থীদের ভালোবাসা। তাদের ভালবাসা নিয়েই আমি আমার বাকি পথ চলতে চাই। আমার স্বামীর অনুপ্রেরণাতেই আমার কর্মময় জীবনের এগিয়ে চলা এবং তার অনুপ্রেরণায় সকল অর্জন। শিক্ষার্থীদের নিয়ে করা আমার কাজগুলো যেন জাতীয় অঙ্গনে স্বীকৃতি পাক। আমি সকলের দোয়া প্রত্যাশী।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন