রয়টার্সের বিশ্লেষণ

জীবনের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে এরদোয়ান

fec-image

দুই দশকের বেশি সময় ধরে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান তুরস্কের সব নির্বাচনে চমক দেখিয়েছেন।

রোববার (১৪ মে) দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এবারের নির্বাচনে এরদোয়ানের সামনে কঠিন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কামাল কিলিচদারোগলু। কিন্তু তুরস্ককে কঠোর হাতে শাসন করা এরদোয়ান সহজে পরাজয় মেনে নিয়ে নীরবে প্রস্থান করবেন, এমন কথা বিশ্বাস করা কঠিন।

তুরস্কের নির্বাচন ঘিরে ইতিমধ্যে অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ ছড়িয়েছে। নির্বাচনের ফলাফল ঘিরে উত্তেজনা থেকে ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশটিতে সংঘাত রাজপথে ছড়ানোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সাড়ে আট কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে নতুন প্রজন্মের ভোটারসহ অনেক তুরস্কবাসী পরিবর্তনের প্রত্যাশা করছেন।

দেশটির জনগণ ব্যাপক মূল্যস্ফীতি, মুদ্রার দরপতন ও জীবনযাত্রার মান কমে যাওয়া নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছেন। এর মধ্যেই গত ফেব্রুয়ারিতে দেশটিতে ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে। এতে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া লাখো মানুষ গৃহহীন হয়েছেন।

দেশটিতে নির্বাচনের আগে করা জনমত জরিপে এরদোয়ানের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে রয়েছেন কিলিচদারোগলু। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এরদোয়ান তাঁর চমক দেখাতে পারেন। আনাতোলিয়া অঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে তাঁর ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। এ সমর্থনের কারণে চিত্র বদলে যেতে পারে।

যাঁরা গত তিন দশকে এরদোয়ানের উত্থান দেখেছেন, তাঁদের যুক্তি হচ্ছে ক্ষমতায় থাকতে এরদোয়ান সর্বশক্তি দিয়ে লড়বেন। জয় ছিনিয়ে আনতে বা পরাজয় ঠেকাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ব্যবহার থেকে শুরু করে যেকোনো সুবিধা নিতে দ্বিধা করবেন না তিনি।

কলাম লেখক কাদরি গারসেল বলেন, ‘ফলাফল যদি এরদোয়ানের পক্ষে না যায় বা ব্যবধান খুব কম হয়, তবে তিনি তা নিয়ে চ্যালেঞ্জ করবেন। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী যদি ভূমিধস জয় পান, সে ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ কিছু করতে পারবেন না। এরদোয়ান তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় রয়েছেন।’

প্রেসিডেন্ট অফিসের একজন কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, নির্বাচনে কোনো অনিয়ম দেখা গেলে এরদোয়ান নির্বাচন বোর্ডের কাছে আবেদন জানাবেন। একইভাবে তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কুমহুরিয়েত হাল্ক পার্টির (সিএইচপি) পক্ষ থেকেও আবেদন জানানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু তিনি নির্বাচনে হেরে গেলে ক্ষমতা ছাড়বেন না, এ কথা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে হলে কোনো প্রার্থীকে মোট ভোটের ৫০ শতাংশের বেশি পেতে হবে। সাম্প্রতিক জনমত জরিপে দেখা গেছে, তরুণ ভোটারদের কাছে দুই প্রার্থীর আবেদন রয়েছে। এ কারণে প্রধান বিরোধী জোটের সমর্থকেরা আশঙ্কা করছেন, কিলিচদারোগলুর ভোট ভাগ হয়ে গেলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দ্বিতীয় দফার ভোটাভুটিতে গড়াতে পারে। কোনো প্রার্থী ভোটারদের ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পেলে দুই সপ্তাহ পর দ্বিতীয় রাউন্ডের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে কেউ যদি অর্ধেকের বেশি ভোট পান, তাহলে তিনিই সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন।

আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের পর সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা মনে করা হয় এরদোয়ানকে। তিনি গত কয়েক দশকে ক্ষমতা একদিকে যেমন পোক্ত করেছেন, তেমনি ভিন্নমত কঠোরভাবে দমন করেছেন। সমালোচক, বিরোধী গণমাধ্যমের মুখ বন্ধ করেছেন তিনি। বিচার বিভাগ এবং অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। গত দুই বছরে তিনজন গভর্নরকে বরখাস্ত করেছেন। ২০১৬ সালে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানচেষ্টার পর তিনি শক্তিশালী জেনারেলদের কোণঠাসা করেছেন। সেনাবাহিনীকে অকার্যকর করে রেখেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে চলা সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় এনেছেন।

এরদোয়ান ও তাঁর দল একে পার্টি (একেপি) তুরস্ককে আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষ দেশের অবস্থান থেকে ইসলামপন্থী দেশ হিসেবে তুলে ধরেছে। বিরোধীরা তাঁকে সুলতান হিসেবে মন্তব্য করেন। কলাম লেখক গারসেল বলেন, এরদোয়ান নিজে এত বেশি ক্ষমতা করায়ত্ত করেছেন, যাতে সংকট সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া এ ব্যবস্থায় ব্যবস্থাপনার সংকটসহ অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় স্তরে সংকট দেখা যায়। অনেক অর্থনীতিবিদ দেশটির লাগামছাড়া মূল্যস্ফীতির কারণ হিসেবে এরদোয়ানের গোঁড়া নীতি ও অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেন।

নির্বাচনের তিন দিন আগেও এরদোয়ানকে টিভির পর্দায় প্রচার চালাতে দেখা যায়। তিনি প্রতিরক্ষা, গ্যাস ও শিল্পক্ষেত্রের বড় প্রকল্পগুলোকে নিজের সফলতা হিসেবে তুলে ধরেছেন। ইস্তাম্বুলভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইডিএএমের পরিচালক সিনান উলগেন বলেন, ‘এরদোয়ান একটি মিশনে রয়েছেন। এ অনুভূতিই তাঁকে ক্ষমতায় টেনে আনে। তিনি কামাল আতাতুর্কের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চান।’

অবশ্য এরদোয়ানের কপালে বড় আঘাত হয়ে এসেছে ভূমিকম্প। ভূমিকম্পে তাঁর সরকার যেভাবে সাড়া দিয়েছে, তা নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। ভূমিকম্পের পর কিছু এলাকায় ভবন নির্মাণ নিয়ে দুর্নীতির বিষয়টি সামনে আসায় এরদোয়ানের সরকার সমালোচনার মুখে পড়েছে।

বিশ্লেষকেরা বলেন, এর আগে তুরস্কের যত সরকার পতন হয়েছে, তার জন্য মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক সংকট দায়ী ছিল। উলগেন বলেন, অর্থনৈতিক সংকটের কারণেই এরদোয়ানের জনপ্রিয়তা কমেছে। তুরস্কের বর্তমান অর্থনীতি অবাধ ও স্বচ্ছতার নীতি অনুসরণ করে না, বরং তা স্বার্থের অর্থনীতি।

তুরস্কের নাগরিকদের খাবার, স্কুলের খরচ, বাড়িভাড়া মেটাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ২০০৩ সালে এরদোয়ান যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন দেশটির অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। তুরস্কের সফলতা প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য উদাহরণ তৈরি করেছিল। ওই সময় কট্টর সমালোচকেরাও তাঁর প্রশংসা করেছিলেন।

কিন্তু এখন সমালোচকেরা বলছেন, এরদোয়ান তাঁর সফলতার সঙ্গেই একশ্রেণির দুর্নীতিগ্রস্ত ‘আনাতোলিয়ান টাইগার’ বা অলিগার্ক তরি করেছিলেন। পরপর নির্বাচনী বিজয়ের পর এরদোয়ানের সহনশীলতা কমে আসতে শুরু করে এবং স্বৈরাচারী শাসন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আজকের ভোট বাঁকবদলের মোড় হয়ে উঠতে পারে। এরদোয়ানের পরাজয় তুরস্ককে আরও ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক অতীতে ফেরাতে পারে।

কিলিচদারোগলু সেই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। আর এরদোয়ান জিতলে তাঁর রাজনৈতিক শত্রুরা আরও বেশি দমন–পীড়নের শিকার হবেন বলেই মনে করছেন তাঁর সমালোচকেরা।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: এরদোয়ান, তুরস্ক, নির্বাচন
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন