টেকনাফে চরম ভোগান্তিতে রোহিঙ্গারা খাবার ও পানির জন্য হাহাকার

টেকনাফ প্রতিনিধি:

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত ২৫ আগস্ট থেকে বর্মী বাহিনীর নির্যাতনের কারণে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে বানের স্রোতের মতো অনুপ্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। তারা টেকনাফে এসে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। এমনিতেই মিয়ানমারে (তাঁদের ভাষায়) চতুর্মুখী হামলায় দিশেহারা। উপরন্ত অর্ধাহারে, অনাহারে সহায় সম্পদ ফেলে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও পেটের ক্ষিধায় বিশেষতঃ শিশু এবং বৃদ্ধ ও অসুস্থদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। তার উপর ছিল খোলা আকাশের নিচে। সঙ্গী ছিল রোদ আর বৃষ্টি। তাদেরকে সেখানে জমা করা হচ্ছে সেখানে নেই পানি ও টয়লেটের ব্যবস্থা।

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাদের প্রতিবেদনে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকার কথা বললেও বাস্তবে চিত্রতা ভিন্ন। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে গেল দেড় সপ্তাহে অন্তত তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এসব রোহিঙ্গা জঙ্গলে, পাহাড়ি টিলায় আশ্রয় নেয়ায় পানীয় জল পাচ্ছেনা। খাবারের জন্য করছে হাহাকার।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থাগুলো ৭৩ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে জানিয়েছে তবে স্থানীয় লোকজন ও পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারদের ভাষ্যমতে, এবারে অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা আরো অনেক বেশি। তাদের দাবি, এবারে প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। এদের মধ্যে কুতুপালং রেজিস্টার্ড ও আনরেজিস্টার্ড ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে দেড় লাখ, বাকিরা তুমব্রু ঘুমধুম, বালুখালি, উখিয়া-টেকনাফ, নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন পাহাড়ে ইতোমধ্যে তারা আশ্রয় নিয়েছে।

লেদা অনিবন্ধিত ক্যাম্পের আবুল ফয়েজ বলেন, আমাদের ক্যাম্পে গত ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত অর্ধ লাখেরও বেশি নতুন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশপাশে আশ্রয় নিয়েছে। কুতুপালং এবং নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। হোয়াইক্যং রইক্ষং আশপাশে অন্তত ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নতুন করে ঝুপড়ি ঘর তৈরি করে অবস্থান নিয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন খালি জায়গায় নতুন রোহিঙ্গা বসতি গড়ে ওঠছে।

বালুখালী ক্যাম্পের মাঝি ইলিয়াছ ও ছৈয়দ নূর জানান, তাদের ক্যাম্প ও আশপাশ এলাকায় নতুন করে অর্ধলাখ রোহিঙ্গা খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে। যে যেভাবে পারছে, যেখানে পাচ্ছে সেখানেই আশ্রয় নিচ্ছে। যখন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে এসব ক্যাম্পে আসে তখন তাদের তাড়িয়ে দেয়ার সুযোগ থাকে না।

কুতুপালং ও বালুখালী এবং লেদা রোহিঙ্গা বস্তি নিয়ন্ত্রণকারী মাঝিদের দাবি, তাদের একেক বস্তিতে নতুন করে ৫০ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। নতুন করে থাইংখালীতে বস্তি গড়ে তোলা হয়েছে। সব মিলে নতুন করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা দেড় লাখের বেশি।

এদিকে, প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আসা এসব রোহিঙ্গা প্রয়োজনীয় ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা পাচ্ছেন না। খাবার ও পানির তীব্র সঙ্কটে খোলা আকাশের নিচে দিনাতিপাত করছেন তারা। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিগত সহিংসতার শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আশা রোহিঙ্গারা আশ্রয়ের খোঁজে পাহাড়-সমতল ও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। অচিন এলাকায় যে যেখানে পারছেন সেখানেই মাথা গোঁজার ঠাঁই নিচ্ছে। ফলে উখিয়া-টেকনাফ সীমান্তের পাহাড়ি এলাকায় নতুন করে গড়ে উঠছে ঝুপড়ি ঘর। তবে, বিভিন্ন ভাষ্যে ওঠে এসেছে, অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য বিষফোঁড়ায় পরিণত হবে। তাদের প্রতিবেশী অনুকম্পা দেখানো উচিত হবেনা। রোহিঙ্গা বাংলাদেশে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ পেলে নিয়ন্ত্রণ করা দায় হয়ে যাবে। হুমকির মুখে পড়তে পারে আইন শৃঙ্খলা।সীমান্তবর্তী বাংলাদেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নতুন করে কয়েক হাজার ঝুপড়ি ঘর তৈরি করেছে নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা। সেই সঙ্গে প্রতিদিন বানের স্রোতের মতো রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকছে। যে যেখানে পারছে সেখানেই আশ্রয় নিচ্ছে।

মিয়ানমারের দংখালী থেকে পালিয়ে আসা জাবেদ ইকবাল বলেন, তাদের প্রতিবেশী ছমুদা বেগম মিয়ানমার সেনাদের গুলিতে খুন হওয়ার পরই তাদের এলাকার সবাই পালিয়ে এসেছে। প্রতিটি সীমান্ত দিয়ে দলে দলে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকছে। শিশু-বৃদ্ধদের কোলে-কাঁধে করে নিয়ে আসছে তারা। যেসব সীমান্তে বিজিবির কড়া অবস্থান রয়েছে সেখানের জিরো পয়েন্টে অবস্থান করছে রোহিঙ্গা। রাতে কিংবা বৃষ্টিতে যে যার সুযোগ মতো বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। গত কয়েকদিনে এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে।

এদিকে, সীমান্তের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে গেছেন জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন, পুলিশ সুপার ড. একেএম ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে প্রশাসনের উর্ধ্বতনমহল।রোহিঙ্গা হিন্দুদের বর্তমান অবস্থা ঘুরে দেখেছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা। সরেজমিন নির্যাতিত হিন্দুদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনেছেন আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত।

সীমান্ত এলাকা ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিগত সময়ের চেয়ে এবার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেছে অনেক বেশি। উখিয়া-টেকনাফ উপজেলার বন বিভাগের জায়গা দখল করে আরও ৩টি অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে। ফলে সীমান্ত এলাকার মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এরা সহায়-সম্বল রেখে প্রাণ বাঁচাতে এদেশে আশ্রয় নিলেও বাঁচার তাগিদে এরা অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

নতুন করে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে স্বীকার করেছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন। তিনি বলেন, গত কয়েকদিন আশঙ্কাজনকহারে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকেছে। ঠিক কত সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে এর সংখ্যা এক লাখের বেশি।

গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের আরকান রাজ্যে পুলিশ পোস্টে হামলা চালায় সে দেশের একটি বিদ্রোহী গ্রুপ। এতে ১২ পুলিশ সদস্য বহু রোহিঙ্গা হতাহত হয়। এ ঘটনায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অভিযানের নামে সাধারণ মানুষ হত্যা, ধর্ষণ,বাড়িঘরে আগুনসহ নানা নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে। এ কারণে প্রতিদিন বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে আসছে অসংখ্য রোহিঙ্গা।

এর আগে গত বছরের ৯ অক্টোবর একই ধরনের ঘটনা ঘটে। এসময় প্রাণ ভয়ে পালিয়ে আসে প্রায় ৮০ হাজার রোহিঙ্গা। এরপর আন্তর্জাতিক মহল নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে মিয়ানমার সরকারের ওপর। তবে তারা এর তোয়াক্কা না করে আরকানে ফের সেনা মোতায়েন করলে বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে সংঘর্ষ জড়িয়ে পড়ে সেনাবাহিনী ও পুলিশ।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন