ডুমুরের ফুলে পার্বত্য চট্টগ্রামে অপ্রকাশিত বাস্তবতা তুলে ধরেছি- রোকেয়া লিটা

রোকেয়া লিটা

জি এম রুমি:

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের জীবনধারা নিয়ে ‘ডুমুরের ফুল’ উপন্যাস লিখে হুমকিতে থাকা লেখিকা বলেছেন, ওই অঞ্চলের বাস্তবতাই তুলে এনেছেন তিনি। সেখানে  অনেক কিছু ঘটে যা প্রকাশ হয় না। অনেকটা ডুমুরের ফুলের মতো। তাই উপন্যাসের নাম দিয়েছেন ডুমুরের ফুল।

গতকাল একান্ত আলাপচারিতায় লেখিকা রোকেয়া লিটা জানিয়েছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম অবস্থানকালে অনেক বাস্তব ঘটনা তিনি জেনেছেন এবং দেখেছেন। তার চিত্র উঠে এসেছে উপন্যাসে। ঢাকার অদূরে নিজ বাসায় লিটা কথা বলেন মানবজমিনের সঙ্গে। ‘ডুমুরের ফুল’ লেখার জন্য ধর্ষণের হুমকি পাওয়া লিটা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন।

উপন্যাসের নামকরণ সম্পর্কে রোকেয়া লিটা বলেন, ডুমুরের ফুল মূলত থাকে ফলের ভেতরে। এটা বাইরে থেকে দেখা যায় না। পার্বত্য এলাকার অবস্থাও একই রকম। সেখানে মানুষের জীবনধারা সম্পর্কে আমরা ঢাকায় বসে খুব কমই জানতে পারি। এছাড়া বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্যে জাতিগত দূরত্ব থাকায় সেখানে বাঙালিরা কোনো অপরাধ করলে তা খুব বেশি প্রচার করা হয়। পাহাড়িদের ক্ষেত্রে হয় পুরো উল্টোটা। পাহাড়িরা হত্যা ধর্ষণের মতো অপরাধ করলেও নামেমাত্র জরিমানা দিয়ে পার পেয়ে যান। অনেক ঘটনা ধামাচাপা দেয়ারও প্রচেষ্টা চলে নিখুঁতভাবে।

অন্যমিডিয়া

অথচ ঢাকায় বসে আমরা জানতে পারি পাহাড়িদের বাঙালিরা নির্যাতন করছে, তাদের নারীদের ধর্ষণ করছে। অপরাধ বাঙালিরাও করছে তা ঠিক, তবে বাঙালিদেরটা বেশি প্রচার করা হচ্ছে। তাই উপন্যাসের নাম রাখা হয়েছে ‘ডুমুরের ফুল’।  মানে যা খুব কাছ থেকে অবলোকন না করলে তার রূপ বোঝা যায় না।

দীর্ঘ আট মাস সেখানে থেকে সেখানকার প্রকৃতি, পরিবেশ, জীবনাচরণ ও রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করেন রোকেয়া লিটা। উপন্যাসে উঠে এসেছে, শান্তিবাহিনীসহ আরও যারা রয়েছেন তারা মূলত পাহাড়িদের প্রতিনিধিত্ব করছে না- এমন তথ্য। তারা সাধারণ পাহাড়িদের নির্যাতন চালিয়ে চাঁদা আদায় করছে। ইউপিডিএফ আর শান্তিবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে উঠে এসেছে অজানা অনেক কথা।

উপন্যাসের এক জায়গায় উঠে আসে যে, পাহাড়িরা শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে  শুরুতেই লেখা যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি উপজাতি অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত হবে। উপজাতি হিসেবে তারা নিজেরাই চুক্তিবদ্ধ হয়ে এখন আবার আদিবাসী স্বীকৃতি চায়। এই বিষয়টির যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে উপন্যাসটিতে। এছাড়া, পাহাড়ি নেতারা সাধারণ পাহাড়িদের স্বার্থরক্ষায় কাজ করতে আগ্রহী নয় এমন কিছু বিষয়ও উঠে এসেছে বইটিতে।

বৃটিশ-ভারতে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার সময় তখনকার পাহাড়ি নেতারা পাকিস্তানের বিপক্ষে গিয়ে সেখানে ভারতের পতাকা উত্তেলন করলো। আবার যখন বাংলাদেশ পাকিস্তান যুদ্ধ হলো তখন বাংলাদেশের বিপক্ষে গিয়ে পাহাড়িদের কয়েক জন নেতা  সেখানে পাকিস্তানের পক্ষ নিলো। এসব রাজনৈতিক বিষয়ও আলোচিত হয়েছে বইটিতে।

রোকেয়া লিটা বলেন, সেখানে আট মাস থাকা অবস্থায় আমি দুটি ধর্ষণের খবর পেয়েছি। দুটি ধর্ষণ হয়েছে পাহাড়ি পুরুষদের দ্বারা। অথচ এ জন্য কোনো মিটিং মিছিল হয়নি। চেপে যাওয়ার সব আয়োজন করা হয়েছে। একই ঘটনা বাঙালিদের দ্বারা হলে হইচই পড়ে যায়। আমি যা দেখেছি তাই লিখেছি। কারও বিরুদ্ধে নয়, কারও পক্ষে নয়। তবে সেখানে প্রচলিত অমানবিক বিচারব্যবস্থা আর স্বার্থের রাজনীতির চিত্র তুলে আনার কারণে আমাকে হুমকি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এটা কতিপয় উগ্র পাহাড়ি করছেন, সবাই নয়।

‘ডুমুরের ফুলে’র সিক্যুয়েল লেখার ইচ্ছা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, সিক্যুয়েল লিখতে হলে পাহাড়ে আবার যেতে হবে। কিন্তু হুমকি ধমকির কারণে এখন পাহাড়ে যাওয়া ঝুঁকি। কবে ফের সেখানে যেতে পারি তা অনিশ্চিত হলেও সিক্যুয়েল লেখার ইচ্ছা রয়েছে।

লিটা জানান, বইটিতে উল্লেখ আছে, পাহাড়িদের প্রথম সারির নেতারা ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির মতোই একটি শাসনব্যবস্থা চান বাংলাদেশ সরকারের কাছে। বৃটিশ আমলের ওই বিধি যদি পুরোপুরি বাংলাদেশের সংবিধানে সংযোজন করা হয়, তাহলে কি বাঙালিরা পাহাড়ি এলাকায় ঘনঘন যেতে পারবে, বাড়ি বানাতে পারবে কি না- এমন প্রশ্নও উঠেছে বইটিতে।

লেখক  বইটিতে উল্লেখ করেছেন, ব্রিটিশ আমলের ওই বিধি কার্যকর হলে সেখানকার জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সেখানে প্রবেশ করতে হবে বাঙালিদের। অথচ পাহাড়িরা দেশের যেকোনো অঞ্চলে স্বাধীনভাবে বাস করতে পারে জমি কিনতে পারে। তাদের সন্তানদের জন্য দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে আসনও সংরক্ষিত রয়েছে। মূলত পাহাড়ি নেতারা চান সেখানে রাজতন্ত্র চালু থাকুক। এতে করে তাদের স্বার্থ ও ক্ষমতা বজায় থাকবে।

তিনি বলেন, উপন্যাসের বড় একটি অংশ রয়েছে পাহাড়ি নারীদের জীবনধারা নিয়ে। তাদের দুঃখ দুর্দশা ও কষ্টগাঁথা উঠে এসেছে ডুমুরের ফুলে। পাহাড়ের রাজারা তাদের মেয়েদের বড় বড় ঘরে বিয়ে দিয়ে বিদেশ পাঠিয়েছেন। তাদের কোন বদমাশ পাহাড়ি বা বাঙালির হাতে ধর্ষিত হতে হয় না। আর কারবারির বিচারও মানতে হয় না। কারবারির বিচার শুধু মানতে হয় পাহাড়ের গ্রামগুলোতে পরে থাকা অসহায় তরুণীদের। এরা ধর্ষিত হলে নামেমাত্র বিচার হয়, বিচারে আবার ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে সারা জীবন ধর্ষিত হওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

ভাবতে অবাক লাগে এই পার্বত্য অঞ্চলে প্রচুর এনজিও কাজ করে, কিন্তু তারা কখনও এখানকার পাহাড়ি নারীদের এমন অবস্থা তুলে ধরে না! পাহাড়ি মেয়েদের ন্যূনতম সম্মান করে না কারবারিরা। কোনো মেয়ে যদি ধর্ষিত হয় এবং তার অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তখন যাদের টাকা এবং প্রভাব আছে সে খুব সহজেই পার পেয়ে যান। এমনটি ধর্ষিতা মেয়েকে ধর্ষকের সঙ্গেই বিয়ে দেয়া হয়। এমনকি পুলিশের কাছে বিচার চাইতে চাওয়া নাকি দোষের। সমাজ ছাড়া তো করা হয়, তার ওপর আবার পুলিশের কাছে যে যাবে তাকে উল্টো জরিমানা দিতে হয়। মেয়ের পরিবার যদি কারবারিদের কাছে গিয়ে সঠিক বিচার না পেয়ে যদি থানায় গিয়ে মামলা করেন এবং ওই ধর্ষকের যদি শাস্তি হয়, তাহলে মেয়ের পরিবারকে জরিমানা দিতে বাধ্য থাকবে, তা না হলে ওই পরিবার পাহাড়ে টিকতে পারবে না।

লিটা জানান, হুমকিতে তার লেখা থামবে না। তিনি নতুন একটি বই লিখছেন। রোকেয়া লিটার জন্ম ১৯৮৫ সালের ১২ই আগস্ট, দিনাজপুরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাকোত্তর করেছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস থেকে মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিষয়েও আরেকটি স্নাকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

বেশ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা আর টেলিভিশনে সাংবাদিকতা করার পাশাপাশি কাজ করেছেন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও। ছোটবেলা থেকেই ছড়া ও প্রবন্ধ লিখতেন। ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় রোকেয়া লিটার প্রথম উপন্যাস ‘সমকামিতা’।

সূত্র: মানবজমিন

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন