দরপতনের কারণে হুমকির মুখে রবার শিল্প, হাজারো শ্রমিকের ভাগ্য অনিশ্চিত

নিউজ নাইক্ষ্যংছড়ি

নাইক্ষ্যংছড়ি প্রতিনিধি:
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার জনবহুল অধ্যুষিত ও রাবার শিল্প নগরী হিসাবে খ্যাত বাইশারীতে রয়েছে শত শত ব্যক্তি মালিকানাধীন রাবার বাগান। স্থানীয়রা রাবারকে বাংলাদেশের সাদা সোনা হিসাবে উল্লেখ করে থাকেন। বিগত দিনে দেশের মাটিতে সাদা সোনার বিপ্লব ঘটলেও এখন সাদা সোনার দর পতনের কারণে রাবার শিল্প বর্তমানে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।

রপ্তানীর সুযোগ থাকলেও বেপরোয়াভাবে বিদেশ থেকে রাবার আমদানীর ফলে এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন রাবার বাগান মালিকরা সস্তা দরে শিট বিক্রি করায় দেশীয় উৎপাদিত পণ্যের বাজার দর এখন কমে গেছে। এর ফলে রাবার চাষিদের পারিশ্রমিক ও লভ্যাংশ প্রদান বন্ধ থাকায় যে কোন সময় উৎপাদন ব্যবস্থা বন্ধ হতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।

সূত্রে জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে ১৯৮০ সাল থেকে তিন দফায় বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় প্রায় ১৩ হাজার একর পাহাড়ি ভূমিকে রাবার চাষ প্রকল্পের আওতায় নেওয়া হয়। এ প্রকল্পের মাধ্যমে তিন হাজার ৩০০ উপজাতি জুম্মু পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়। উঁচু ভূমি বন্দোবস্তীকরণ প্রকল্পের আওতায় ২য় পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের (জিওবি) অর্থায়নে বান্দরবান জেলায় পরিবার পিছু পাঁচ একর ২৫ শতক করে এক হাজার পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়।

তাদের মাধ্যমে প্রতি মাসে ১২০ মেট্টিক টন প্রক্রিয়াজাত রাবার শিট উৎপাদন করে বছরে ৪০ কোটি টাকার রাবার বিক্রি করা হচ্ছিল। বর্তমানে ১৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা ব্যয় করে উৎপাদিত একই পরিমাণ রাবার বিক্রি করতে হচ্ছে মাত্র ১২ কোটি টাকায়।

বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার বাইশারীসহ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট ও টাংগাইলের মধুপুরে রাবার বাগান রয়েছে। তবে দেশের সব চাইতে বেশী রাবার চাষ রয়েছে পার্বত্য জেলার বান্দরবানের বাইশারীতে। এই বাইশারীকে অনেকেই রাবার শিল্প নগরী হিসাবে খ্যাত বলে মনে করেন। বর্তমানে বান্দরবানের বাইশারীতে ব্যক্তি মালিকানা ও ঘরোয়া বাগান মিলে আনুমানিক পনের হাজার একরের অধিক পরিমাণ রাবার বাগান রয়েছে। উক্ত বাগান গুলোতে শ্রমিক হিসাবে নিয়োজিত রয়েছেন ৬ হাজারের অধিক পরিমাণ লোক। এসকল শ্রমিকেরা তাদের পরিবারবর্গ নিয়ে এতদিন ভালভাবেই দিন কাটিয়েছিলেন।

কিন্তু গত এক বছর যাবৎ বিদেশী রাবার বাংলাদেশে আমদানীর ফলে রাবারের দাম একেবারেই নিচে নেমে গেছে বলে জানালেন একাধিক বাগান মালিক। বিগত বছরগুলোতে প্রতি কেজি রাবার বিক্রি হয়েছে ৩০০ থেকে ৩৮০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু বর্তমানে বাজার দর পতনে প্রতি কেজি রাবার বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১০০ থেকে ১০৫ টাকা দরে।

আচমকা দর পতনে রাবার মালিকেরা হতাশ হয়ে পড়েছে বলে জানান। এই অবস্থায় রাবার বিক্রি করে শ্রমিকদের মাসিক বেতন ভাতা পরিশোধ করতে মালিকগণ হিমশিম খাচ্ছে বলে জানালেন রাবার বাগান মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহ সিরাজুর রহমান (সজল)।

গতকাল এই প্রতিবেদক বাইশারীর বিভিন্ন রাবার বাগান সরেজমিনে ঘুরে মালিক, শ্রমিক ও ব্যবস্থাপকদের সাথে কথা বললে তারা জানান, বর্তমান অবস্থায় বাজারে দর পতনের কারণে উৎপাদিত রাবার বিক্রি করে মাসিক বেতন ভাতা পরিশোধ করা মুশকিল হয়ে পড়েছে।

পিএইচপি ল্যাটেক্স এন্ড রাবার প্রোডাক্ট লিঃ এর সিনিয়র ব্যবস্থাপক আমিনুল হক আবুলের সাথে আলাপকালে তিনি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন, তার বাগানে বর্তমানে নিয়মিত অনিয়মিত মিলে পাঁচ শতাধিক শ্রমিক কাজ করছেন। বিগত মাসের উৎপাদিত রাবার বিক্রি করে শ্রমিকদের বেতন ভাতা পরিশোধ সম্ভব হয় নাই। তিনি আরো বলেন, এই অবস্থায় চলতে থাকলে বাগান মালিকেরা উৎপাদন বন্ধ রাখতে বাধ্য হবে। এখন আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশী হয়ে পড়েছে যা এ শিল্পকে ক্ষতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

অপর দিকে নাজমা খাতুন রাবার বাগানের চেয়ারম্যান ও রাবার বাগান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মো: আরিফ হাসনাইন রাজিব বলেন, বর্তমানে উৎপাদিত রাবার পণ্যও বিক্রি হচ্ছে না। গত মাসের উৎপাদিত রাবার এখনো গুদামে মওজুদ রয়েছে। দিন দিন ব্যবসায়ীরাও এ শিল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

স্থানীয়দের দাবী রাবার সেক্টর বন্ধ হলে শ্রমিকদের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। তাই এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তারা সরকারের দৃষ্টি আর্কষণ করেন। একাধিক ব্যবসায়ীর দাবী দেশীয় পণ্যের বাজারজাত করে দেশ ও শ্রমিকদের বাঁচানো সম্ভব। অন্যদিকে সচেতন মহল রাবার সেক্টরের প্রতি সরকারের নজর দিয়ে রাবারের দাম বাড়িয়ে এ শিল্পকে চলমান রাখতে সরকারের প্রতি দাবী জানান।

ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে বলেন, একটি মহল নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য দেশীয় পণ্যকে ধংশের মুখে ঠেলে দিয়ে বিদেশী পণ্য আমদানী করে বাজার সয়লাভ করেছে। অথচ রাবারের দর পতন হলেও রাবার থেকে উৎপাদিত পণ্য সামগ্রীর কোন ধরণের দাম কমে নাই। বাজারে বর্তমানে রাবার থেকে উৎপাদিত পণ্যের দাম এখনো চড়া। রাবারের দাম নিয়ে প্রশ্ন তুলে ব্যবসায়ীরা ও রবার বাগানমালিকরা দেশীয় এ শিল্পকে বাঁচানোর জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন