দীপঙ্কর তালুকদার জুম্ম জাতির কুলাঙ্গার- সন্তু লারমা

10836306_10202082213615981_955378548_n

স্টাফ রিপোর্টার:
শুধু রাজপথে নয়, পাহাড়ের অন্দরে, মাঠে ঘাটে মোকাবেলার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি জনসংহতি সমিতি আহ্বান জানিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ১৭তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রাজাধানী ঢাকার আয়োজিত একটি হোটেলে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যেতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা একথা বলেন।

২০১৪ ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ১৭তম বর্ষপূর্তিতে রাজধানীর একটি হোটেলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির উদ্যোগে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা। দীপায়ন খীসার পরিচালনায় আলোচনা সভায় অংশ নেন ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পংকজ ভট্টাচার্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির উপদেষ্টা মঞ্জুরুল আহসান খান, বিশিষ্ট গবেষক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি উষাতন তালুকদার এমপি, বাংলাদেশেরওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য হাজেরা সুলতানা এমপি, পার্বত্য চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক কমিশনের সদস্য ব্যারিস্টার সারা হোসেন, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস প্রমুখ।

সভাপতির বক্তব্যে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বলেন,-“পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অন্যতম পক্ষ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ইতিমধ্যে তার করণীয় বিষয়গুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করেছে। এখন সরকারের দাায়িত্ব হচ্ছে চুক্তি বাস্তবায়নে রোডম্যাপ ঘোষণা করে চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসা। সরকারকে পূর্বের ঘোষিত কর্মসূচীর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, নির্ধারিত সময়সূচি ৩০ এপ্রিল ২০১৫-এর মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়নে কোন প্রকার গাফিলতি করলে ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী অসহযোগ আন্দোলনের পাশাপাশি জুম্ম স্বার্থবিরোধী সকল কার্যক্রম সর্বাত্মক প্রতিরোধ করা হবে।”

দীপঙ্কর তালুকদারকে জাতীয় কুলাঙ্গার আখ্যা দিয়ে তার উদ্দেশ্য করে সন্তু লারমা বলেন-“জুম্ম জাতির কুলাঙ্গার দীপঙ্কর তালুকদার সংবাদ সম্মেলন করে বলেন যে জন সংহতি সমিতি ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলন রাজপথে প্রতিহত করবেন। কিন্তু তিনি কি করে এই কথা বলেন, যেখানে জুম্ম জনতাই গণতান্ত্রিকভাবে ভোটের মাধ্যমে তার অতীত কুকীর্তির জবাব দিয়েছে।” তিনি আরো বলেন,“পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ যুগে যুগে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠারজন্য লড়াই-সংগ্রাম করে যাচ্ছে। জুম্ম জনগণ অধিকারের প্রশ্নে জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম করতে শিখেছে। তাই কোন দমন-পীড়নজুম্ম জনতার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে দাবিয়ে রাখতে পারবেনা।”

সরাকারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন ঘোষিত সময় সীমার মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ না করলে উদ্ভূত যে কোন পরিস্থিতির জন্য সরকারই দায়ী থাকবে।

আলোচনা সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, -“যেখানে অনেক আনন্দ-অনেক উৎসাহ নিয়ে চুক্তির বর্ষপূর্তি উদযাপিত হওয়ার কথা সেখানে ক্ষোভ নিয়ে, বেদনা নিয়ে আজ পার্বত্য চট্টগাম চুক্তির বর্ষপুর্তি পালন করতে হচ্ছে। চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম এখনো পৃথিবীর অন্যতম একটি সামরিক উপস্থিতি এলাকা হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জাতিগুলোর অধিকার প্রতিষ্ঠাকল্পে সাংবিধানিক স্বীকৃতি অত্যন্ত জরুরী অথচ তা না করে আদিবাসীদের অস্বীকার করে বাঙালি জাতীয়তাবাদই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন,পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিষয়ে সরকার রীতিমত বিভ্রান্তিমূলক অবস্থান নিয়েছে। সরকারের চালাকি চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের অনীহাকেই প্রকাশ করে। তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের অনীহা ওই অঞ্চলকে অশান্তই করে তুলতে পারে, যা কোনভাবেই কাম্য নয়।”

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশনের সদস্য বলেন ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, “বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে রাষ্ট্র সবচেয়ে ইতিবাচক কাজটি করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্তু চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো আজও বাস্তবায়িত নাহওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি বলেন, চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের মত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখনো যথাযথভাবে ক্ষমতায়ন করা হয়নি। সারা হোসেন আরো বলেন, যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি পাহাড়ী অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা সেখানে তার পরিবর্তে সকল ধরনের জাতিগত আগ্রাসন পরিচালিত হচ্ছে যা কোন ভাবেই কাম্য নয়।”

জনসংহতি সমিতির অন্যতম শীর্ষ নেতা উষাতন তালুকদার এমপি, তার বক্তব্যে বলেন, “পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর যেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো, সেখানে উল্টো চুক্তি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে কার্যত পার্বত্য চট্টগ্রামকে অশান্ত করেই রাখা হয়েছে। সেখানে চুক্তি বিরোধী নানা ষড়যন্ত্র পরিচালিত হচ্ছে। দালাল এবং সন্ত্রাসী সংগঠন সৃষ্টি করে হত্যা-অপহরণ-গুম প্রভৃতি অপতৎপরতা চালানো হচ্ছেপার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা উপস্থিতিকে বৈধতা দেওয়ার জন্য।” ঊষাতন তালুকদার আরো বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে লঙ্ঘন করে সেখানে জুম্ম স্বার্থ বিরোধী নানা অপতৎপরতা চালানো হচ্ছে। স্থানীয় জনগণের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও সরকার সেখানে মেডিকেল কলেজ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছে।”

হাজেরা সুলতানা এমপি বলেন, “সাংবিধানিক অধিকার একটি জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্বের প্লশ্নের সাথে জড়িত, কিন্তু বাংলাদেশে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির প্রশ্নে সরকার বরাবরই উদাসীন। তিনি বলেন পার্বত্য চট্টগ্রামে অসংখ্য সামরিক স্থাপনা কোনভাবেই একটি গণতান্ত্রিক চরিত্র সম্পন্ন রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরেনা।”

বিশিষ্ট গবেষক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন “যে কোন চুক্তি মানেই একটি অঙ্গীকার। কিন্তু সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নিয়ে তার অঙ্গীকার প্রতি পদে পদে লঙ্ঘন করে চলেছে। তা না হলে আজ চুক্তি বাস্তবায়ন না করে এবং চুক্তি লঙ্ঘন করে সেখানে মেডিকেল কলেজ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার উদ্যোগ নিতেন না। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার আগে যা দরকার তা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির উপদেষ্টা মঞ্জুরুল আহসান খান বলেন, “একজন বাঙালি যেমন কখনোই একজন চাকমা হতে পারেন না, তেমনি একজন চাকমা বা একজন মারমা, গারো বা হাজংও কখনো একজন বাঙালি হতে পারেন না। এই সাধারণ সত্যটিই রাষ্ট্র অস্বীকার করছে অনেক কাল থেকে। তিনি আরো বলেন, আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম কেবল আদিবাসীদের নয়, দেশের আপামর মেহনতী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামেরই একটি অপরিহার্য দিক।”

ঐক্য ন্যাপের সভাপতি ও প্রবীণ রাজনীতিক পংকজ ভট্টাচার্য বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে পার্বত্যবাসীর পাশাপাশি দেশের আপামর মেহনতী জনগণ সদা প্রস্তুত রয়েছে। তাই সরকারের প্রতি আহবান থাকবে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ঘোষিত আল্টিমেটাম এর পূর্বেই যেন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা হয়।”

আলোচনা সভায় অন্যান্যের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন কমিউনিস্ট কেন্দ্রের আহবায়ক ডা: অসিত বরণ রায়, কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ মমতাজ লতিফ এবং বাংলাদেশ যুব মৈত্রীর মোস্তফা আলমগীর রতন প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন