দুটি হাত কেটে ফেলার পরেও চেয়েছিলেন স্বামীর সংসার

fec-image

নিজের জীবনের সাথে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর ঘটনার বর্ণনা দেন সবুরাণী দে’ (৫০)। তিনি কক্সবাজার সদর উপজেলা খুরুশকুল দক্ষিণ হিন্দু পাড়ার প্রয়াত লক্ষ্মীচরণ দে’র স্ত্রী। স্বামী লক্ষ্মীচরণ দে’ তার হাত দুটি কেটে ফেলেছিলেন।

সবুরাণী দে জানান, সেদিন বিকেলে খুবই বৃষ্টি। মাতাল অবস্থায় আমার স্বামী ঘরে ফিরেন। কোনো কারণ ছাড়াই মারধর শুরু করেন। নেশা করলেই তিনি অত্যাচার করে। কিন্তু ওই দিনের চিত্রটি ছিল খুবই ভয়ংকর। আমাকে মারতে মারতে এক পর্যায়ে হাত-পা বেঁধে গলায় ফাঁস লাগিয়ে টাঙ্গানোর চেষ্টা করে। এরমধ্যে আমি মাটিতে পড়ে যাই। দুই হাত বাঁধা ছিল ছিল পিছনদিকে। হাত দুটি গাছের উপর রেখে কুপিয়ে কুপিয়ে কব্জি থেকে বিচ্ছিন্ন করে। সেই মুহূর্তেও যন্ত্রণা এখনো ভুলতে পারি না। আমি চিৎকার করছিলাম বাঁচার জন্য। হয়ত বৃষ্টির কারণে লোকজন শুনতে পায়নি। হাত কাটা অবস্থায় গড়াতে গড়াতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি বৃষ্টির মাঝে। অজ্ঞান হওয়ার কারণে এরপর আর কিছু মনে পড়ে না।

তিনি আরও জানান, পরে শুনেছি তিনি পালিয়ে যাওয়ার সময় লোকজন ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। সেদিন রাতে জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমি মেডিকেলে ভর্তি। দুই হাতে ব্যান্ডেজ আর কব্জি দুইটি নাই। প্রায় মাস খানেক মেডিকেলে থাকতে হয়েছে। এদিকে আমার হাত কেটে ফেলার অপরাধে তাকে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়। আমার ছোট ৪ সন্তান। ২ মেয়ে ২ ছেলে। বড় মেয়ের বয়স মাত্র ৬। একদিকে মাকে ছাড়া বাচ্চাদের কান্না অন্যদিকে শ্বশুর বাড়ির লোকজনসহ আত্মীয়-স্বজনের অবহেলা।

অনেকটা কাটা হাত না শুকানোর আগেই মেডিকেল ছাড়তে হয়েছে। এরপর শুরু হয় দুই হাত ছাড়া নতুন এক যুদ্ধ। একে একে সব আত্মীয়-স্বজন আমার কাছ থেকে দুরে সরে যায়। ৪ সন্তানের লালনপালন আর খাবার নিয়ে খুবই কষ্টে পড়ে যাই। বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করেছি পাড়ায় পাড়ায়। সেই দিনগুলো মনে পড়লে এখনো চিৎকার করে কান্না আসে।

আজ থেকে প্রায় ২৪ বছর আগে ২০০১ সালের আষাঢ় মাসের ৪ তারিখে নিজের জীবনের সাথে ঘটে যাওয়া সেই ভয়ংকর ঘটনার বর্ণনা দেন সবুরাণী দে’ (৫০)।

সবুরানী দে’ আরো জানান, মানুষ মা-বাবার কাছে ঋণী হয় কিন্তু আমি ঋণী সন্তানদের কাছে। তারা না থাকলে হয়ত এতদিন বাঁচতে পারতাম না। ওই সময় আমার ৬ বছর বয়সী ছোট্ট মেয়ে রান্না করত। পাশে দাঁড়িয়ে তাকে দেখিয়ে দিতাম। ছোট্ট ছেলেটি আমার মাথা আচঁড়িয়ে দিত। তারাই আমাকে খাইয়ে দিত, গোসল করিয়ে দিত এবং পরিষ্কার করিয়ে দিত। আজও তাদের হাতেই পালিত। আমার দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আমার ছেলের ছোট্ট একটি দোকান আছে। যা দিয়ে কোনোভাবে জীবন চলে। জানিনা সামনের দিনগুলো কীভাবে কাটে। এমন কষ্ট যেন কোনো শত্রুরও না হয়।

এরপর তার স্বামী লক্ষ্মীচরণ দে’র কি অবস্থা হয়েছিল জানতে চাইলে বলেন, এই ঘটনায় তার সাজা হওয়ায় প্রায় ১২ বছর জেল হাজতে ছিল। জেলে থাকা অবস্থায় সবুরানী বেশ কয়েকবার খাবার নিয়ে স্বামীকে দেখতে গিয়েছিল। শ্বশুর বাড়ির লোকজনকে জামিনের জন্য সহযোগিতা করেছিল। ভেবেছিল হয়ত জেল থেকে বের হয়ে তাকে পুনরায় গ্রহণ করবে। কিন্তু না। তিনি জেল থেকে বের হয়ে পুনরায় অত্যাচার শুরু করে। সব সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে দেয়। শ্বশুর বাড়ির লোকজন মিলে সবুরাণী’র বিরুদ্ধে ২০ লাখ টাকার মামলা দেয়। তারা তাকে খুবই ঘৃণার চোখে দেখে। এরমধ্যে ২০২০ সালের ২০ নভেম্বর খবর আসল খুব অসুস্থ অবস্থায় তার স্বামী ডিজিটাল হাসপাতালে ভর্তি। গিয়ে দেখি সে মারা গেছে। ওইসময় তার সব আত্মীয়-স্বজন তাকে ফেলে চলে গেছে। পরে স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছ থেকে টাকা ধার করে স্বামীর লাশ নিয়ে আসেন এবং দাহ সম্পন্ন করে।

এত কষ্টের মাঝে আপনার কি চাওয়ার আছে এমন প্রশ্নের উত্তরে সবুরানী বলেন, ‘কি আর চাইব। যাকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম সেই আমার হাত দুটি কেটে ফেলেছে। এর পরেও সংসার করতে চেয়েছি তাও হলো না। এর মধ্যে পাল্টে গেছে আমার নাম। শুধু আইডি কার্ডে লিখা আছে সবুরানী দে, কিন্তু বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাই ডাকে হাত কাটা। কষ্ট লাগে হাত কাটা নাম শুনলে। কোথাও যেতে পারি না। যেতে চাইও না। নিজেকে লুকিয়ে রাখি। খুবই ইচ্ছে হয় যদি দুটি হাত থাকত। আসল হাত তো আর পাবনা যদি কৃত্রিম দুটি হাত পেতাম। আর এই হাত দুটি নিয়ে মানুষের সামনে যেতাম।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন