নিজ দেশ তাড়াল, বাংলাদেশেই চার হাত এক হলো

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

ঠিক সন্ধ্যা নামার মুখে। পশ্চিমের লাল সূর্যটা একটু পরেই মিলিয়ে যাবে। উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ছোট ছোট তাঁবুগুলোতে চলছে আলো নামানোর প্রস্তুতি। নারীদের কেউ কেউ ব্যস্ত রান্না-বান্নায়। পুরুষরা ফিরছেন সদাইপাতি নিয়ে। এমনই একটি তাঁবুর সামনে বসে কিছু কলমি শাককে তরকারিতে রূপ দিচ্ছিলেন চল্লিশোর্ধ্ব নারী রশিদা বেগম।

সামনে গিয়ে বাংলাদেশে কবে এসেছেন প্রশ্ন রাখতেই রশিদার উত্তর, ‘কোরবানের ঈদের পরে। তারিখ মনে নেই।’ একইসঙ্গে জানাচ্ছিলেন মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনী ও স্থানীয় মগদের নির্যাতনের কথা। শোনাচ্ছিলেন পাঁচদিন হেঁটে এ পাহাড়-ও পাহাড় ডিঙ্গিয়ে মিয়ানমারের মংডুর বাড়ি থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার কষ্টকর বিবরণ।

মাকে কথা বলতে দেখে সেখানে এসে দাঁড়ালো বছর ষোলোর কিশোরী। মেয়েটির মাথা থেকে কাপড়টা একটু সরলো বটে! মায়ের নজর এড়িয়ে যায়নি সেই দৃশ্য। খুব চেঁচিয়ে মেয়েকে উদ্দেশ্যে করে মায়ের হাঁক-‘নুর ফাতেমা পুরুষদের সামনে পর্দা করতে হয়। বিয়ে হয়েছে কদিন হলো-ভুলে গেছস?’

লজ্জায় জবুথবু কিশোরী লহমায় নিজের একরাশ কালো চুল ঢেকে নিল ওড়নার আড়ালে। হাতে ঘড়ি, মধ্যমাতে বিয়ের আংটি। তাঁবুতে কাটুক দিন-মেয়ে সাজুগুজু করেই আছে বেশ। আর নতুন বউ তো এমনই থাকবে।

জানতে চাইলে রশিদা বেগম শোনালেন মেয়ের বিয়ে-কাহিনী।

‘কোরবানের ঈদের কিছুদিন পরই একই এলাকার আইয়ুব আলী ও খাদিজা বেগমের ছেলে দিনমজুর সালেহ আহমদের সঙ্গে আমাদের মেয়ের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। দু’পক্ষ মিলে সময়ও ঠিক করে রেখেছিলাম। কিন্তু ঈদের আগেই শুরু হয় ঝামেলা। আমাদের ওপর নেমে আসে নির্যাতন। আশপাশের পাড়ায় আর্মি ও মগরা মেয়েদের নির্যাতন করছিল, পুরুষদের হত্যা করছিল এমন খবর পাচ্ছিলাম। তাই বাঁচার জন্য অন্যদের সঙ্গে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসি।’

এদিকে রশিদা বেগমদের সঙ্গে একই ঢলে চলে আসে সালেহ আহমদের পরিবারও। এসেই কুতুপালং ক্যাম্পে জায়গা হয় দুই পরিবারের। ত্রাণের ওপর এক খণ্ড তাঁবুর নিচে ঘরহীন-রাষ্ট্রহীন অন্য রোহিঙ্গাদের মতোই কাটছে দিন।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়নে ঘরবাড়ি-সম্পদ সব হারালেও চার হাত এক হয়েছে বাংলাদেশের এই ক্যাম্পে।

প্রায় ২৫ দিন আগে হুজুর ডেকে তাঁবুতে বসেই বিয়ে পড়ানো হয় নুর ফাতেমা আর সালেহ আহমদের। সাক্ষী বলতেও ওই পাড়া থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা আত্মীয়রা। এর বাইরে অন্যকিছু হয়নি। একটি বিয়েতে কাবিন, দেনমোহর, কাগজপত্রসহ আরও যেসব গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ দরকার এসব সেখানে অনুপস্থিত। বিয়ে উপলক্ষে যে একবেলা ভালোমন্দ খাবার হলো তাও ওই ত্রাণের কল্যাণে।

‘চেয়েছিলাম ভালোভাবে বড় মেয়ের বিয়ে দেব। নানা আয়োজন করবো। কোনকিছুই হলো না।’-ছলছল চোখে আফসোস ঝরে রশিদা বেগমের কণ্ঠে

আপাতত মেয়ে আর জামাইকে নিজেদের সঙ্গে রেখেছেন রশিদা বেগম আর তার স্বামী সৈয়দ আহমদ।

‘এখানে কতোদিন থাকতে হয় জানি না। দেরি হলে তাদের জন্য ক্যাম্পে নতুন তাঁবু চাইবো।’-বলেন সৈয়দ আহমদ

বিয়ের তো কাগজপত্র হয়নি, পরে যদি মেয়ে জামাই ভিন্ন কিছু করে বসে, কি হবে? প্রশ্নের জবাবে বেশ উত্তপ্ত গলায় রশিদার বক্তব্য, ‘কোথায় পালাবে? মংডুতে? যেখানেই যাক খুঁজে বের করতে পারবো। আর বাড়ি ফিরতে পারলেই কাগজপত্রসহ সবকিছু করে নেব।’

ততক্ষণে কুতুপালং ক্যাম্পে নেমেছে সন্ধ্যা। উদ্ধাস্তু জীবন থেকে আরও একটা দিন শেষ হলো রোহিঙ্গাদের। বেঁধে দেওয়া গণ্ডিতে আলো-বাতাসে ১২ ঘণ্টা কাটিয়ে সবাই ঢুকে পড়ছেন তাঁবুর পৃথিবীতে।

নুর ফাতেমার স্বামী সালেহ আহমদকে অবশ্য পাওয়া যায়নি-তখনও তিনি বাইরে থেকে তাঁবুতে ফেরেননি।

সময় সংসার জীবন কেমন কাটছে নুর ফাতেমাকে প্রশ্নটা করতেই, ‘উদ্ধাস্তু জীবনে আবার সংসার’-বলেই মুচকি হেসে মিলিয়ে গেলো ১০ বাই ৫ হাতের তাঁবুর সংসারে।দুঃস্থ মুখের এই হাসির ভাষা সহজে পড়ে নেওয়া যায়। অচেনা হাসির গভীরে যেন মিশে আছে-কষ্টেরা।

সূত্র: বাংলানিউজ

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন