পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা, মারমা এবং ত্রিপুরাদের পাশাপাশি বাঙ্গালী নববর্ষকে যুক্ত করে ‘বৈসাবিন’ পালনের আহবান

kkkkkkkllll

মুজিবুর রহমান ভুইয়া :

খাগড়াছড়িতে চলছে বৈসাবি উৎসবের আমেজ আর সাথে সাথে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় চলছে নানা আয়োজন। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী পাহাড়ি জনগোষ্ঠির ঐতিহ্যবাহী বৈসাবি উৎসবের বাকি আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। ত্রিপুরাদের বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাই আর চাকমাদের বিজু- এই তিনের আদ্যক্ষরের সম্মিলন হচ্ছে ‘বৈসাবি’।

অন্যান্য বছরে ১২ এপ্রিল শুরু হলেও এবছর চারদিন আগেই আগামী ৮ এপ্রিল শুরু হয়ে চলবে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও চাকমা, মারমা এবং ত্রিপুরাদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’ উপলক্ষে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে খাগড়াছড়ির পাহাড়ি জনপদগুলোতে।

আগামী ১২ এপ্রিল শোভাযাত্রা আর ফুল বিজুর মধ্য দিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে পাহাড়ীদের প্রাাণের উৎসব ‘বৈসাবি’। বৈসাবী উৎসবকে প্রানবন্ত করতে তিনদিনের বর্নাঢ্য কর্মসুচী গ্রহণ করেছে খাগড়াছড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ইনস্টিটিউট। নানা কর্মসুচীর মাধ্যমে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য সবার কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে জানিয়ে খাগড়াছড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ইনস্টিউট‘র উপ-পরিচালক সুসময় চাকমা জানান, ৮ এপ্রিল থেকে এ কর্মসূচির শুরু হবে। একই দিন উদ্বোধন করা হবে পাঁচ দিনব্যাপী বৈশাখী মেলার।

আগামী ১২ এপ্রিল চাকমাদের ফুল বিজুর মধ্য দিয়ে পাহাড়ে শুরু হবে উৎসবের সুচনা। এ বিজুর সাথে রয়েছে চাকমাদের ধর্মীয় অনুভূতির সম্পর্ক। আর ১৩ এপ্রিল অর্থাৎ নববর্ষের আগের দিন হারি বৈসু পালন করে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠির বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে। নতুন বছরের প্রথম দিন থেকে মারমাদের সাংগ্রাইয়ের সূচনা। বৈচিত্রময় আয়োজনে বর্ষবরণে খাগড়াছড়ির পাহাড়ি পল্লীগুলোতে চলছে নানা প্রস্তুতি।

সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে, প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠী এবার উৎসবমুখর পরিবেশে নিজ নিজ উৎসব পালন করবে। গত কয়েক বছর ধরে অনুকূল পরিস্থিতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠি বৈসাবি পালন করে আসছে উৎসব ও প্রাণোচ্ছল আমেজে। প্রত্যন্ত পাহাড়ি পল্লীতে এবারো বৈসাবি উৎসবের ব্যাপক প্রস্তুতি চুড়ান্ত পর্যায়ে। পাহাড় জুড়ে এখন সাজ সাজ রব। বৈসাবি উৎসবের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি নারীদের গৌরবোজ্জল ইতিহাস জড়িয়ে আছে। তাই উৎসবের প্রতিটি পর্বে নারীর পুর্বাপর ভূমিকার বিষয়টি মাথায় রেখে এবারও নারীদের জন্য ঐতিহ্যবাহী খেলাধূলা ও বয়নসহ নানা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হবে বলে জানা গেছে।

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসনের বাইরেও স্থানীয় পাহাড়িরা নিজেদের মতো করে বৈসাবি উদযাপনের প্রস্তুতি নিয়েছে। অন্যদিকে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্মিলিতভাবে বৈসাবি উদযাপন করবে এবারও। খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউটও পাহাড়ে ভিন্ন আমেজের সাথে নতুন বছরকে বরণের প্রস্তৃতি নিয়েছে। বর্ষবরণে চাকমা-মারমা আর ত্রিপুরাদের পাশাপাশি বাঙ্গালীরাও নববর্ষ পালনে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণে ব্যস্ত। একসময় বাঙ্গালীরা ধুমধামের মধ্য দিয়ে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করলেও ‘বৈসাবী’ উদযাপনে বাঙ্গালীদৈর কোন সম্পৃক্ততা রাখা হয়নি। পুরনো বছরের শেষ দিন ও বাংলা নর্ববর্ষকে ঘিরে বাঙ্গালীরা ব্যাপক আয়োজন করে থাকে নিজেদের মতো করেই। আর এতে স্থানীয়ভাবে সরকারী কোন পৃষ্ঠপোষকতাও থাকেনা। এ নিয়ে বাঙ্গালীদের মধ্যে মৃদু ক্ষোভও আছে।

অনেকের মতে, ত্রিপুরাদের বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাই আর চাকমাদের বিজু- এই তিনের সমন্বয়ে ‘বৈসাবি’ পালন করা হতে পারলে বাঙ্গালীদের কেন এ সম্মিলিত আনন্দের বাইরে রাখা হবে। ত্রিপুরাদের বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাই আর চাকমাদের বিজু‘র সাথে বাঙ্গালীদের ‘নববর্ষ’-কে যুক্ত করে কেন ‘বৈসাবিন’ পালন করা হবে না এমন প্রশ্নও উঠেছে।

তাদের মতে, বাংলা নববর্ষ বাঙ্গালীদেরই ঐতিহ্যের অংশ। যুগ যুগ ধরে বাঙ্গালীরা দিনটি সাড়ম্বরে উদযাপন করে আসছে। তাই তারা ত্রিপুরাদের বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাই, চাকমাদের বিজু আর বাঙ্গালীদের ‘নববর্ষ’ এ চারের সম্মিলন ‘বৈসাবিন’ পালনের দাবী করেছে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে।

স্থানীয় সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করেন, এ উৎসবে চাকমা-মারমা আর ত্রিপুরাদের পাশাপাশি বাঙ্গালীদেরকে যুক্ত করা হলে পাহাড়ীদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আরো বেশী অটুট থাকবে। নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হবে। তাই ত্রিপুরাদের বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাই, চাকমাদের বিজু আর বাঙ্গালীদের ‘নববর্ষ’ মিলে ‘বৈসাবিন’ উদযাপনের দাবী পাহাড়ের সুশীল সমাজের।

এদিকে সরেজমিনে দেখা গেছে, বৈসাবীকে সামনে রেখে এরই মধ্যে জেলা ও উপজেলা শহরের পাশাপাশি বিভিন্ন হাট-বাজারগুলোতে বেচাকেনার ধুম পড়েছে। বিভিন্ন শ্রেণী-বয়সের নারী-পুরুষ পাঁচন, শুটকি এবং নতুন কাপড় কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে দোকানগুলোতে। আর বৈসাবী উপলক্ষে ব্যস্ততা বেড়েছে ছোটবড় দোকানীদেরও। তারাও পাহাড়িদের সাথে একাকার হয়ে মিশে যাবে প্রানের উৎসবে। পাহাড়ীদের সাথে পাল্লা দিয়ে বাঙ্গালী বধুরাও বিশেষ ধরনের সবজি ‘পাঁচন’ রান্নায় পিছিয়ে থাকবে না।

খাগড়াছড়ি থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, পাহাড়ে বৈসাবির উৎসব ছড়িয়ে দিতে যা যা প্রয়োজন সবকিছু করা হবে। তিনি পাহাড়ের প্রতিটি নাগরিককে আগাম বৈসাবী শুভেচ্ছা জানান।

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী বৈসাবি উৎসব আনন্দমুখর করতে সবার সহযোগিতা কামনা করেছেন। তিনি পাহাড়ের প্রতিটি নাগরিককে বৈসাবী শুভেচ্ছা জানিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে সম্মিলিতভাবে বৈসাবী পালনের আহবান জানিয়েছেন।

এদিকে নববর্ষের পুর্বে খাগড়াছড়ি থেকে নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য ও খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সভাপতি ওয়াদুদ ভুইয়া বৈসাবী উপলক্ষে সকল সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠিকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, এ উৎসব কারো একার নয়, এটা সার্বজনিন উৎসব। এ উৎসবে পাহাড়ী-বাঙ্গালী সকলে একাকার হয়ে উৎসব পালন করবে। তিনি আশা করেন, বৈসাবী পাহাড়ের প্রতিটি নাগরিককে এক সুতোয় গেঁথে দেবে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন